প্রবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘ইমিগ্র্যান্ট’ (Emigrant)। ইমিগ্র্যান্ট বা অভিবাসীর বিভিন্ন শ্রেণি আছে। একজন ব্যক্তি যখন সাময়িকভাবে তার নিজ দেশ ত্যাগ করে চাকরি অথবা পড়াশোনার জন্য অন্য কোনো দেশে যান, সাধারণত তাকে প্রবাসী বলা হয়। আবার যারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে অন্য দেশে আশ্রয় লাভ করেন, আশ্রয়দাতা দেশ নিয়ম অনুপাতে তাকে স্থায়ীভাবে বৈধতার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারে। আবার যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ কিংবা ভয়ংকর অপরাধ সংঘটিত করে অন্য দেশে পালিয়ে যান, সাধারণভাবে তারাও অভিবাসী অথবা প্রবাসী।
তবে যারা জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে উপার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন এবং তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠান, তারাই মূলত প্রকৃতার্থে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে চাকরি করতে যান। অনেকে আবার দালালচক্র দ্বারা প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে হয়রানিরও শিকার হন। একইভাবে পড়াশোনা ও উচ্চশিক্ষা অর্জন করার পরও নিজ দেশে ফিরে অনেকেই দেশের নাগরিকদের সেবা প্রদান করেন এবং নানান ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে জনকল্যাণধর্মী অবদান রাখেন। প্রবাসীদের অধিকার প্রশ্নে মূলত আমি তাদের কথাই বলছি।
প্রবাসে অবস্থান করেও যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অবদান রেখেছেন, তাদের প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা। একই সঙ্গে দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদানের কথা সর্বদা আমাদের মনে রাখতে হবে।
স্বাধীনতার পর প্রবাসীদের নিজস্ব উদ্যোগে স্বদেশে যার যার এলাকায় মানবকল্যাণধর্মী কার্যক্রমেও প্রবাসীদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। একইভাবে বহির্বিশ্বে চাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করার মধ্য দিয়েও দেশের কল্যাণে তারা ভূমিকা রাখেন।
এটা সর্বজনস্বীকৃত, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স শক্তিশালী অবদান রাখছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ও জাতীয়ভাবে প্রবাসীদের এই অবদানের কথা ও স্বীকৃতির যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। বাংলাদেশে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সুফল প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাননি। বরং এসব মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতি করার পথ খুলেছে এবং দুষ্টচক্রই লাভবান হয়েছে। দেশের আদম ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী চক্রের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঘুষ ও দুর্নীতির রমরমা ব্যবসা হয়েছে। দালালচক্র ও আদম বেপারীর খপ্পরে অনেক মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। তাদের প্রতিকারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ কিছুই করেনি বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
আগেই উল্লেখিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ে প্রবাসীদের বিরাট ভূমিকা ছিল। তেমনি ২০২৪ এর বিপ্লব ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ও গণবিপ্লবে প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রবাস থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আন্দোলনকারীদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র-জনতার সমর্থনে তারা অর্থায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
বাংলাদেশে বিনা ভোটের সংস্কৃতি চালুর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছে। কথিত একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পতিত সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফ্যাসিজম প্রচলনেরও অভিযোগ রয়েছে। দেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় ব্যাপক দুর্নীতি, চোরাচালানি কার্যক্রমসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থা চালু হয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতি দমন ও সকল অরাজক পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনের বাইরে চলে গিয়েছিল। যখন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী, দলীয় নেতা-কর্মীরা দেশের অর্থ পাচার করার মধ্য দিয়ে ব্যাংকগুলো খালি করে ফেলেছিলেন, দেশি ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের চরমে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ওপরই ছিল শেষ ভরসা। প্রবাসীরা পুনরায় দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো বৃদ্ধি করেছেন। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সর্বস্তরের অর্থনীতির পথ সুগম করে তুলতে হবে। প্রবাসীদের সকল দুর্ভোগ কমিয়ে তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধার দিকগুলোকে প্রসারিত করতে হবে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারের নানাবিধ জটিলতার জন্য বহির্বিশ্বে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রতি সুনজর দেওয়ার মতো এখনো কাউকে খুব একটা পাওয়া যায় না। দেশে এলে প্রবাসীদের অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। প্রবাসীদের আয় বাড়ানো এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সরকারের ভূমিকা থাকতে হবে।
অতএব, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সকল ব্যবস্থা নেবে, সে প্রত্যাশা সবার। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে যেন প্রবাসীদের বৈদেশিক বৈধতা-সংক্রান্ত বিষয়াদি এবং উন্নতির জন্য তাদের প্রয়োজন মেটাতে সার্ভিস প্রদান করা হয়। দূতাবাস এবং দেশের বিমানবন্দরে প্রবাসীদের দুর্ভোগ নিরসনের ব্যবস্থা করতে হবে। শুনেছি, ইতিমধ্যে বিমানবন্দরে যাত্রীদের সুবিধার্থে ইউনূস সরকার কিছু সুবিধা চালু করেছে। যদি চালু হয়ে থাকে, সেটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। একই সঙ্গে কাস্টমস হয়রানি এবং অন্যান্য বিড়ম্বনা নিরসনে এবং প্রবাসী যাত্রীদের উন্নয়নে যাবতীয় ব্যবস্থা সচল করবে বলে সবার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক লোকের বেকারত্ব নিরসনে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে দেশের শিক্ষিত, অশিক্ষিত নানান পেশার লোকদের ব্যাপকহারে পাঠানোর সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও দক্ষ লোকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার মধ্য দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুষ্ঠু নিয়োগপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। যার ফলে বাংলাদেশ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। দেশের দারিদ্র্য বিমোচন ঘটবে, অর্থনীতি চাঙা হবে এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্প্রসারিত হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রবাসীদের যে ব্যাপক ভূমিকা ছিল, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় রেমিট্যান্সকে বিপ্লব সাফল্যের হাতিয়ার হিসেবে নিতে, অধিকাংশ প্রবাসী সেটি গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় জুলাই মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের মাসের চেয়ে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার কমে যায়। আগস্ট বিপ্লবের বিজয়ের পর রেমিট্যান্স ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
বিগত দিনে প্রমাণিত হয়েছে, প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছেন। জাতীয় রাজস্ব আয়ে প্রবাসীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের সেটি খেয়াল রাখতে হবে। প্রবাসীরা সব সময় নিজেদের অবাঞ্ছিত ভাবলেও এ আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণে যে ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্যই যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন প্রবাসের রেমিট্যান্স-যোদ্ধারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলছে। অথচ প্রবাসীদের বিদেশে যেতে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। বেশির ভাগ সময় এয়ারপোর্টের কর্মকর্তাদের হাতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
বিমানবন্দরে বিদেশগামীদের তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, যা রীতিমতো অসম্মানজনক ও অমানবিক। বিমানবন্দরের এসব অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে যাত্রীদের মধ্যে স্বস্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। বিদেশে থাকা শ্রমিকেরা প্রতিবছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার পাঠান। প্রতিবছর এর পরিমাণ বাড়ছে। ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়। বিভিন্ন সময় অনেক প্রবাসী মিডিয়ার কাছেও এ-সম্পর্কিত নানা কথা জানিয়েছেন। বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোতে যেভাবে বিপুলসংখ্যক যাত্রীকে সেবা দেওয়া হয়, এখানেও সে রকম আধুনিক ব্যবস্থা করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা ছাড়া রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ, পর্যটন ও দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। তাই বিমানবন্দরগুলোতে কাস্টমসের জটিলতা নিরসন এবং যাত্রীদের নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি যাত্রীদের জন্য গতিশীল, ঝামেলামুক্ত ও সম্মানজনক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে প্রবাসীদের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তাদের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করায় সরকারের সুদৃষ্ট থাকতে হবে। একইভাবে বহির্বিশ্বে অবস্থানরত প্রবাসীদের উচিত সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের নিয়ম-নীতি মেনে চলা। কোনো অবৈধ পথ যেন তাদের কোনো বিপদে না ফেলে। বাংলাদেশের সুনাম রক্ষা করেই বিদেশে আমাদের জীবনযাপন করতে হবে।
কানেক্ট বাংলাদেশ একটি অরাজনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক আন্তর্জাতিক সংগঠন। বাংলাদেশের বাইরে যেকোনো দেশেই প্রবাসীদের অধিকার রক্ষার্থে এর শাখার বিস্তার ঘটতে পারে। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের প্রাপ্য অধিকার আদায়, সংরক্ষণ, ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রেনউইক সংগঠন কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশি ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা, সামাজিক অবস্থিতি, শিক্ষা, সুচিকিৎসাসহ সকল মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য কানেক্ট বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। বিশেষ করে, ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যাংকগুলোর দেউলিয়াত্বের কারণে গ্রাহকেরা তাদের গচ্ছিত টাকা উত্তোলন করতে পারছেন না। কারণ, ব্যাংকে টাকা নেই। প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশি কমিউনিটির রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল সরকারকে ব্যাংকিং সেক্টরকে গতিশীল রাখতে হবে। প্রবাসীর অধিকার রক্ষার্থে বহির্বিশ্বের বাংলাদেশিদের সকল মর্যাদা রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। প্রবাসীদের নিরাপত্তা বিধানসহ সকল বৈধতা প্রদান করতে হবে।
প্রবাসীদের অধিকার রক্ষার্থে কানেক্ট বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন-২০২৪ আগামী ২৬-২৭ অক্টোবর পর্তুগালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের স্বার্থে বেশ কিছু প্রস্তাবনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে প্রবাসীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন হিসেবে কানেক্ট বাংলাদেশ স্বদেশের সঙ্গে প্রবাসের সেতুবন্ধনে বিরাট ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। এবারের সম্মেলন-২০২৪ সার্থক ও সফল হোক। সবাইকে অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক