Thikana News
০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

স্বৈরাচারের দেড় দশক

স্বৈরাচারের দেড় দশক
বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে আর তা হলোÑ ‘কি বছর গাঙ্গে গাঙ্গে দেখা হলেও বইনে বইনে দেখা হয় না’। অর্থাৎ এক মায়ের পেটের বোন সে দুইজন কিংবা দুইয়ের অধিক হতেই পারে। এক সময়ে সেই বোনেরা হাত ধরাধরি করে কিংবা গলায় গলায় ভাব করে, শৈশব কাটিয়ে কৈশর এবং যৌবনের প্রথম বেলায় ওঠা পর্যন্ত বন্ধুর মতো বড় হয়ে উঠলেও সেই বোনেরা বিয়ের পিঁড়িতে বসে এর পরে আর আগের মতো সম্পর্ক ধরে রাখা যায় না। এক ধরনের টানাপড়েনের পথ মাড়িয়ে দুস্তর ব্যবধানের জন্ম নেয়া সেই বোনদের মধ্যকার দূরত্ব কিছুতেই আর মসৃণ পথে হাঁটে না। এক থেকে একাধিক পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠা বোনদের সামনে তখন নানা মাত্রার বিধি-নিষেধ এবং সেই নিষেদের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে এক সঙ্গে ফেলে আসা পিতৃ-পুরুষের বাড়িতে যাওয়াও হয়ে উঠে না তাদের, সে কারণে মাস শেষে বছরের হিসাব নিতে নিতে একেকজনের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলার শব্দটা পর্যন্ত বাতাসে শিস তুলে কানে এসে ধাক্কা মারলেও বদলায় না তাদের নিয়তির মার। অথচ বাংলার ছয় ঋতুর ধারাবাহিকতায় বছর ঘুরে বর্ষা ঠিকই নিয়ম মেনে ফি বছর কড়া নাড়ে মানুষের মনের গহিন বন্দরে। বানের পানির ধাক্কায় মাঝ নদীর বুকে জেগে ওঠা চরাচর তখন আর ধরে রাখতে পারে না নিজেকে, উপচে পড়া পানির তোড়ে ভেসে যায় নিষেধের দেয়াল। সে কথা মনে রেখেই প্রচলিত সেই প্রবাদের জন্ম। ‘ফি বছর গাঙ্গে গাঙ্গে ঠিকই দেখা হয়Ñ কেবল বইন দেখতে পায় না বইনকে।’ কথাটা সবার ক্ষেত্রে খাটে না, তার প্রমাণ হলো শেখ হাসিনা আর শেখ বেহানার জীবনের ঘটনাবলী। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আগে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন। কিন্তু এখানে ছোট দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়েতে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে ছিলেন তিনি ছোট দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে। বিয়ের সব কাজ শেষ হয়ে গেলে জার্মানিতে ফেরত যাওয়ার সময়ে পিতা-মাতার অনুমতি নিয়েই ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলেন তিনি। আর সত্য হলো সেই যাওয়াটাই দু’জনের জীবনকে এক সূত্রে গেঁথে দিলো। বেঁচে গেলেন দুই বোন, দেশে থাকলে অন্য ইতিহাসের জন্ম হতো। সেই থেকে দুইজনের এক পথে চলার ইতিহাস এক সঙ্গে সুখ-দুঃখের পথ মাড়িয়ে এক সঙ্গে পথ চলা। 
আর আশ্চর্য বিষয় হলো মাঝখানে কয়েকটা যুগ পার হয়ে দুই ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের পাঁচ তারিখ যেদিন ক্ষমতার মসনদ থেকে ছিটকে পড়লেন শেখ হাসিনা; সেই চরম দুঃসময়ে যখন দেশ ছেড়ে পালাতে যাবেন, জীবনের কঠিক সেই দুঃসময়েও বোন রেহানা তার সফর সঙ্গীর ভূমিকায়।
অদৃষ্ট নিয়তি দুই বোনকে অদৃশ্য এক গৃন্থীতে বেঁধে কি নির্মমভাবে খেলা দেখাল।
তবে শেখ রেহানা কেবল বড় বোনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন না, বড় বোনের শাসনামলের পুরোটা সময়জুড়ে ছিলেন সব অসৎকামের সম অংশীদারও।
তার বড় প্রমাণ হলো- হাসিনা উৎখাতের পরে যখন তার আশপাশের রাঘব বোয়ালরা গ্রেফতার হলেন, তার ভেতরের অন্যতম এক শরিক ছিলেন সালমান এফ রহমান। তিনি হাসিনা সরকারের ছায়া মন্ত্রী ছিলেন। অনেকে বলতেন শেখ হাসিনার পরেই ছিল তার অবস্থান অনেকটা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতেন দরবেশ নামক ওই অসৎ লোকটি। যিনি কি না দেশের সব ক’টি ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠানকে নিংড়ে ছুবড়ে নিঃস্ব করে দিয়েছিলেন। তিনি সদ্য স্বৈরাচার মুক্ত পরিবেশে বন্দিত্ব বরণের পর্যায়ে এসে যখন-রিমান্ডের শিকারে পরিণত হলেন, সেই সময়ে দরবেশ বলেছিলেন, এস আলমের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া দেড় লাখ কোটি টাকার অর্ধেকই দেয়া হয়েছে শেখ হাসিনা এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে। তার বর্ণনা মতে ওই বিষয়ে দেখভাল করতেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার ছিল না কিছুই। দেশের মানুষ এই বিষয়ে বেশ কিছুদিন থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন।
এ নিয়ে কানাঘুষাও ছিল। কিন্তু বড় গলায় কিছু বলতে পারছিলেন না, কারণ দম বন্ধ এক অসহনীয় পরিবেশে বাস করতে করতে অনেকটা যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন দেশের ৭০ ভাগ মানুষ, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। অধিকন্তু দেশের সর্বোচ্চ স্থানে থাকা মানুষটি নিজেকে দলীয় পরিচয়ের বাইরে নিয়ে এসে সার্বজনীন হয়ে ওঠার কোনো উদারতাই দেখাতে পারেনি যে কারণে ‘দিনে দিনে বহু বাড়িছে দেনা’। যার খবর রাখার কোনোই প্রয়োজনবোধ করেননি তিনি।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরে দুই বোন যখন একেবারে রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু জীবনের আঙ্গিনায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই সময়ের কিছুটা কাল লন্ডনে কাটানোর পরে ভারত সরকারের বদন্যতায় দিল্লিতে ঠাঁই হলো তাদের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। অন্য দিকে তিনি বঙ্গবন্ধুও একজন কাছের মানুষ ছিলেন। ’৭১-এর যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাশ্রয় এক কোটি অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের বিবেক সম্পন্ন মানুষদের কাছে এক সীমাহীন উচ্চতায় নিজেকে তুলে ধরে ছিলেন সেই তারই বদন্যতায় পরিবার হারা। দেশহারা সেই দুই বোনকে দিল্লিতে আশ্রয় দিয়ে ছিলেন ভারত সরকার। সেই অবস্থায় দিল্লিতেই কাটিয়ে ছিলেন তারা পুরো ছয় বছরের মতো সময়। সেই সময়ে তারা দুইজন অনেকটাই ইতিহাসের এক বিচ্ছিন্ন সময়ের হাতে বন্দী। দেশে তখন দলীয় রাজনীতি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এর দুঃসময় চলছে। নিষিদ্ধ দলের তকমায় বন্দী আওয়ামী লীগ। তখনও শেখ হাসিনা লন্ডনে অবস্থান করছেন দিল্লিতে আসার আগের ঘটনা। বিবিসি থেকে তার একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য শেখ হাসিনার অস্থায়ী বাস ভবনে এসেছেন সাংবাদিক। একপর্যায়ে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন তিনি হাসিনার কাছে, যদি কোনো দিন দেশ থেকে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার জন্য কোনো ডাক আসে আপনি কি তাতে সাড়া দেবেন? শেখ হাসিনা ত্বরিত উত্তর ছিল অবশ্যই। আমার পরিবারকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য একবার হলেও আমি ক্ষমতায় যেতে চাই। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের একটানা শাসন ক্ষমতায় থাকা এবং যত ধরনের অন্যায় কাজকে আইনে পরিণত করার সব অপপ্রয়াস তার সেই সব কিছু প্রতিশোধ নেয়ারই বহিঃপ্রকাশ ছিল। তিনি কোনদিনই ভুলতে পারেননি কিভাবে সব হারিয়ে ছিলেন তিনি। অবশ্য এটা যে কারুর জন্যই ভয়ংকর এক মর্ম যাতনার কাহিনী। ভুলা সম্ভব নয়। কোন মানুষের জন্যই সম্ভব নয়। এমন করে নির্বংশ হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য কোনোভাবেই মেনে নেয়ার বিষয় নয়। আর তিনি তো ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা। রক্তে যার রাজনীতির বীজ লুকিয়ে ছিল। একই সঙ্গে প্রতিশোধ গ্রহণের অদম্য এক স্পৃহাও দিনে দিনে যার ডালপালা মেলে ছিল।
দেশে তখন আওয়ামী লীগ নতুনভাবে মাথা তুলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু দলীয় একটা কোন্দলও তখন মাথা উঁচু করে আছে। এই অবস্থায় দলের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নামটা উচ্চারণ করলেন কেউ কেউ। অনুচ্ছারিত নামটা শেষ পর্যন্ত জোরালো হয়ে উঠলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, দলের বর্ষীয়ান নেতা ড. কামাল হোসেন এবং দলের তৎকালীন নেত্রী সাজেদা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন দিল্লিতে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে দলের ওই সিদ্ধান্ত জানানো হবে তাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সেই প্রতিনিধি দলটি দিল্লিতে গিয়ে দেখা করলে অনেকটাই অজাচিতভাবেই সাড়া দিলেন হাসিনা। ছিয়াত্তর সালে শেখ রেহানার সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী শফিক সিদ্দিকীর বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেননি হাসিনা। এবার পিতৃপরিবারের অনুপস্থিতিতে রেহানা তার সফর সঙ্গী হতে পারলেন না দেশে ফেরত আসার সময়ে। শেষ পর্যন্ত ৮১ সালেরÑ ১৭ মে ঢাকায় এসে পৌঁছলেন তিনি দেশে তখন জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। শেখ হাসিনার নতুন জীবনের এক অনন্য অধ্যায়ের শুরু। দিল্লিতে থাকতেই তার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন দলের সব শ্রেণির নেতা, নেত্রীরা। দেশে ফেরত আসার পরে জিয়াউর রহমানের সরকার বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেছিল। ১৯৬১ সালের পয়লা অক্টোবর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সে বাড়িতে কেটেছে শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সুদীর্ঘ সময়। কিছু বিপদগামী সেনাসদস্যের হাতে ৭৫ সালে সপরিবারে নিহত হওয়ার পর থেকে বাড়িটি সেই নারকীয় তাণ্ডবের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কালের সাক্ষী হয়ে। ১৯৯৩ সালে বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন শেখ হাসিনা। তারপর ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, সেই জাদুঘরটি শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই ভাঙনের কবলে পড়ে। শেখ হাসিনার কৃতকর্মের দায় বর্তালো বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের উপরে। অন্য আর সব কিছু মতো। ইতিহাসও মাঝে মধ্যে প্রতিশোধ নেয়। শেখ হাসিনার কাছে চিহ্নিত শ্রেণি শত্রুর নাম হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া।
তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া দু’জনই রাজনীতিতে এসেছিলেন, তাদের পূর্ব সূরিদের অকাল প্রয়াণের পথ ধরে। একজন পিতাকে হারিয়ে এবং অন্যজন স্বামীকে হারিয়ে। দুইজনের এসব হারানোর কাহিনী ইতিহাসের মর্মান্তিক এক অধ্যায়। তবে শেখ মুজিবের মৃত্যুর কারণ হিসেবে শেখ হাসিনা সবসময়ে জিয়াউর রহমানের নামটা খুব জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন। আর সেই জন্য জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে তার বিধবাপত্নী বেগম খালেদা হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনার প্রতিশোধ গ্রহণের প্রথম টার্গেট সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সপরিবারে দীর্ঘদিন থেকে সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন। ৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে প্রতিপক্ষ কিছু সেনাসদস্যের হাতে মর্মান্তিকভাবে নিহত। হওয়ার পরে জিয়াউর রহমান পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার সেনা সদরের ৬ নম্বর শহীদ মইনুল রোডে ২ দশমিক ৭২ একর জায়গার উপর স্থাপিত বাড়িটি বছরে এক টাকা খাজনা দেয়ার শর্তে খালেদা জিয়ার নামে লিজ দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল বাড়িটার কোনো ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা বিক্রি করার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবেন না খালেদা জিয়া কিংবা তার পরিবার। এই বাড়িটি ছিল জিয়া পরিবারের অনেক ধরনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পরÑ ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ওই বাড়ি থেকে জিয়াউর রহমানের পরিবারকে উচ্ছেদ করেছিলেন। এক প্রকার বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাড়ি থেকে বেগম জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ওই দিন গুলশানের তার দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে কান্নারত অবস্থায় বেগম জিয়া বলেছিলেন ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে আমাকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি থেকে উৎখাত করা হয়েছে’। মূলত ওই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ওপর নাম হলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অন্য এক পথ এই বাড়িটি ভোগ দখলের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার একটা ব্যক্তিগত ক্রোধ ছিল। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত গণভবন এক সময়ে ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন। এই ভবনের উত্তর কোণে জাতীয় সংসদের অবস্থান। তবে শেখ হাসিনার আগে আর কোনো প্রধানমন্ত্রী এই ভবনে বাস করেননি। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব মিন্টো রোডে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট ভবনে অফিস করতেন। ওই প্রেসিডেন্ট ভবন তখন গণভবন হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি নিজে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত বাস করে গেছেন। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার পরে সামরিক শাসন জারি হলে ওই গণভনকে সামরিক আদালতে পরিণত করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ ভবনটির সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং সংস্কার শেষে পরের বছর গণভবনকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পরিণত করে নাম দেয়া হয়েছিল করতোয়া ভবন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণে পরে মন্ত্রী সভার এক বৈঠকে মাত্র এক টাকা ইজারা মূল্যের বিনিময়ে গণভবনকে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই গণভবনে শেখ হাসিনার দখলি স্বত্ব আরোপের ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। বিএনপিও এই বিষয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে ছিল।
যার কারণে শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে কিছু দিনের মধ্যে বাইরে বের হয়ে এসেছিলেন এবং ২০০১ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধয়াক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লুতিফুর রহমান গণভবনের ইজারা বাতিলও করে দিয়েছিলেন। এই অপমানটা শেখ হাসিনার জন্য চূড়ান্ত ধরনের একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছিল যার প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা তিনি হৃদয়ের গহিন জায়গায় যত্নের সঙ্গে ধারণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ‘বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তরাধিকারীদের জন্য ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যদের নিরাপত্তা আইন ২০০৯ সংসদে পাস করে নেয়া হয়। সেই নিরাপত্তা আইনে দোহাই দিয়ে শেরেবাংলা নগরের গণ ভবনটি শেখ হাসিনার বসবাসের জন্য আবার বরাদ্দ দেয়া হলে-২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান শেষে দেশ ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনা ওই গণভবনেই কাটিয়ে গেছেন।
তবে অপমান করে ২০০১ সালে গণভবন থেকে শেখ হাসিনাকে যেদিন বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেদিনই তিনি মনে মনে শপথ নিয়েছিলেন ‘এর বদলা তিনি নেবেন। সেনা সদরের মইনুল রোডের বাসা থেকে খালেদা জিয়াকে জোরপূর্বক বের করে দেয়ার সেই অপমানজনক ঘটনা হচ্ছে শেখ হাসিনার বদলা নেয়ার ঘটনা। অনেকের মতে শেখ হাসিনার মনে প্রতিশোধ পলায়ন এক ধরনের মনোবৃত্তি সবসময় কাজ করতÑ যার তাড়নায় তার প্রতি মুহূর্তের সব ধরনের কাজসম্পন্ন করতেন তিনি।
খালেদা জিয়াকে শুধু মইনুল রোডের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তার প্রতিশোধ গ্রহণের প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করেননি, বের করে দেয়ার পরেই সেই বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেন ছিলেন একজন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যেও তিনি একজন। আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীদের মধ্যে তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালনকারী এই প্রবীণ রাজনীতিবিদদের আগস্ট পরিবর্তী সময়েÑ শেখ হাসিনা যখন ভারতে আশ্রিত জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন তাকে সম্মানের সঙ্গে দেশে ফেরত আনার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। যার কারণে ৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন জোহরা তাজউদ্দিন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন। ১৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী ঘটনার পরবর্তী সময়ে যখন বাদবাকি রাজনীতিবিদরা কারাগারে ছিলেন। নেতৃত্ব শূন্য আওয়ামী লীগের সেই চরম দুর্দিনে জোহরা তাজউদ্দিন দলের হাল ধরেছিলেন। তোফায়েল আহমদ একবার বলেছিলেন, জোহরা তাজউদ্দিন তাকে নিয়ে দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন শুধু দলকে সংগঠিত করার কাজে, যখন কোনো গাড়ি পাওয়া যেত না তখন তিনি জোহরা তাজউদ্দিনকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যেতেন। শেখ হাসিনা দেশে ফেরত আসার পরে এই দুই ত্যাগী নেতাকে আস্তে আস্তে দলের বাইরে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ড. কামাল হোসেনকে চূড়ান্ত মাত্রায় অপমানে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। ‘কা কা করা কাউয়া’ কামাল হোসেনকে এমন শব্দ উচ্চারণ করেও উপহাস করতে ছাড়তেন না হাসিনা। এতটাই রুচি বিকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। তার ওই সব রুচিহীন কথাবার্তার ধরন ছিল অনেকের মতে, একজন কাজের বুয়ার মতো অনেকটা মাতারি টাইপের রাতচিতের মতো শুনে মাঝে মধ্যে কানে আঙ্গুল দিতে হতো। কোনোভাবেই দেশের একজন সরকারপ্রধানের বক্তব্য বলে মনে হতো না কারুর কাছেই। আর তার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন কাউয়া কাদের। যার কথা শুনলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের ভেতরে এক ধরনের ঘৃণার উদ্রেক হতো। দুর্ভাগা জাতির- কলক তিলকের মতো এই সব নেতার নেতৃত্ব দেয়ার কোনো যোগ্যতা ছাড়াই দেশ শাসিত হয়েছে এদের দ্বারা। (ক্রমশ)
 

কমেন্ট বক্স