Thikana News
০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

জনগণের সঙ্গে আর  নয় প্রতারণা...

জনগণের সঙ্গে আর  নয় প্রতারণা...
বাঘ আর সেই রাখাল বালকের গল্প আমরা কে না জানি। রাখাল বালকটি মজা নেয়ার জন্য বনের ধারে গরু চরাতে গিয়ে ‘বাঘ এসেছে বাঘ’ এমন চিৎকার করত। গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করতে ছুটে এসে দেখত রাখাল বালক হাসছে। বাঘ আসলে আসেনি। সে মজা করছিল। এভাবে সহজ-সরল গ্রামবাসীকে ‘ডজ’ দিয়ে দিচ্ছিল। 
তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এলো। রাখাল বালক তারস্বরে প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল ‘বাঘ এসেছে বাঘ’। ওই দিন গ্রামবাসীর কেউই আর এগিয়ে এলো না। বাঘ খেয়ে ফেলল রাখাল বালকটিকে। এই গল্পের ভাবার্থ বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলালে কি ভুল হবে- আমি বলব, মোটেই না। ’৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপক্ষে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে আমাদের। স্বাধীন ও নিজস্ব ভৌগোলিক কাঠামো নিয়ে একটি বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র পেয়েছি ঠিকই- কিন্তু প্রকৃত মুক্তি বা স্বাধীনতার স্বাদ আজও পাইনি। দেশ-বিদেশের নানা জরিপে বাংলাদেশ নিয়ে সম্ভাবনার গল্প শুনে আসলেও আমরা সেইভাবে সফলতা পাইনি। দেশে দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যায় স্খলন বেড়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসক আসছেন, শাসক যাচ্ছেন- নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশপ্রেমে ব্রত হননি তারা। যে কারণে গত ৫৩ বছরেও জনগণ মাথা উঁচু করে এখনো বলতে সাহস পায় না- তারা সত্যিকারভাবে বৈষম্যমুক্ত বা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের এমন দৈন্যদশার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বে আসা ওইসব শাসকশ্রেণিই দায়ী। 
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমাদের শাসকশ্রেণি নিজেদের চালাক মনে করে জনগণকে বারবার বোকা বানানোর দিন শেষ। গত ৫ আগস্ট তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নয় কি? বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলটির সম্পর্ক তাদের ফ্যাসিবাদী ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনব্যবস্থায় দেশের মানুষ পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়েছিল। জনগণের বিপক্ষে গিয়ে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগ জুজুর ভয় দেখিয়ে দেশ শাসন করত। প্রতারণার নানা কৌশলেও জিম্মি ছিল দেশের জনগণ। কিন্তু আখেরে শেষ রক্ষা হয়নি। তাদের কায়েমি আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঘের গর্জনে গর্জে উঠেছিল তরুণসমাজ। বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে তারা এক ঐতিহাসিক আন্দোলন শুরু করেন। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে হটাতে রক্তগঙ্গায় ভাসতে হয়েছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীসহ দেশের মানুষকে। অবশেষে জনগণের ওপর জগদ্দলপাথরের মতো চেপে বসা আওয়ামী লীগ সরকারকে ৫ আগস্ট করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পালাতে হয়েছে দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মীও। এখনো পলাতক রয়েছেন আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী। রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান অবস্থান এখন শূন্যের কোটায়। যদিও বর্তমানে আত্মগোপনে থেকে আবারও মিথ্যা গল্প সাজানোর চেষ্টা করছে দলটি। নিজেদের বিগত সময়ের ব্যর্থতার দায় স্বীকার না করে জনগণের সামনে আসতে চায় তারা। কিন্তু দেশের জনগণ যে এখন আর বোকা নেই; তারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে এতো সহজে গ্রহণ করবে না বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞরা। 
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের আমলে যেসব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী মাঠছাড়া, দেশছাড়া ছিল- তারা আজ বীরদর্পে সিনা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা না নিয়ে ওইসব নেতাকর্মীর অনেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় মুক্ত পরিবেশ পেয়ে খুব অল্প সময়েই যেন তারাও ভুলতে বসেছেন বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-সমর্থকদের কী ভূমিকা থাকা উচিত। আমরা স্পষ্টত দেখছি, নতুন বাংলাদেশ গঠনে যে সোনালি সূর্য গত ৫ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এনে দিয়েছে তাদের সেই অর্জন ম্লান করতে দেশে-বিদেশে এক ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বসেই চলছে নানা নীল-নকশা। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আর বায়নার গ্যাঁড়াকলে ফেলতে প্রতিদিনই যেন সরকারের বিরুদ্ধে আলটিমেটাম আসছে। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অভিজ্ঞমহল শংকিত, আবারও নতুন ফ্যাসিজম ফিরে আসে কি না। কারণ রাষ্ট্র মেরামতের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারা দ্রুত নির্বাচনের দিকে হাঁটতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নানা চাপের সঙ্গে তারাও বর্তমান সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। সবকিছু উপেক্ষা করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশকিছু সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, এর মধ্যে কয়েকটি কমিশন তাদের সুপারিশও জমা দিয়েছে। তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র সংস্কারের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে পুরো সংস্কার কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই রাষ্ট্র সংস্কারে দায়িপ্ত পালন করা উচিত। এ জন্য হয়তো বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কালবিলম্ব সহ্য হচ্ছে না।
রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে তারাও তাদের ফর্মুলায় বলছে, রাষ্ট্র সংস্কারের গুরুদায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। তবে এই ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান বিপরীতমুখী। তাদের দাবি, আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, খুন, গুম, অত্যাচার-নির্যাতনের বিচার। এজন্য যৌক্তিক সময় নিতে চায় তারা। কিন্তু যৌক্তিক সময় কবে থেকে কবে শেষ হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যদিও প্রথমে বলা হয়েছিল- তিন মাসের মধ্যে সংস্কার কমিশন গঠন ও প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। বাস্তবিক অর্থে গত ৫ মাসেও অনেক কমিশন তাদের কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। এক ধরনের ধীরগতি লক্ষ  করা যাচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে। অনেকে বলছেন, এমন সুযোগে বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের লেজুড়বৃত্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্ল্যাটফর্ম থেকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন সহজতর হতে পারে। 
এ ইস্যুতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বাঁক লক্ষ করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে প্রধান শক্তি বিএনপি এখন প্রকাশ্যেই বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা সরকারে থেকে নতুন দল গঠন সমুচিত হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দল গঠনে আপত্তি না থাকলেও সরকারের বাইরে থেকে তা করার পক্ষে জোরালো অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে বিএনপি। যদিও জামায়াতসহ ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে বা গোপনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞরা। বিএনপি এখানেই ভয় দেখছে, অন্য দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে যদি আগামী নির্বাচনে এক ধরনের নতুন মেরুকরণ তৈরি করে তাহলে তাদের ক্ষমতায় বসা কঠিন করে তুলতে পারে। যে কারণে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও বর্তমান সরকারে তাদের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির দিকে আঙুল তুলে বলছেন, ‘বিএনপি আরেকটি ১/১১ জন্ম দিতে চাচ্ছে। দুই পক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কার ব্যবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক মাঠের বড় শক্তি বিএনপি একটি বড় ফ্যাক্টর। বিএনপির নৈতিক সমর্থনকে পাশ কাটিয়ে অন্য ছোট ছোট দলকে নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের কাঠামোতে তেমন পরিবর্তন আসবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগও সেই সুযোগটি নিতে যাবে। এখন প্রশ্ন- আওয়ামী লীগকে সুযোগী দিয়ে খাল কেটে কুমির আনার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে কি না। এ জন্য বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দ্রুত ঐক্য গড়ে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই নিশ্চিত করতে হবে। তা নাহলে- শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না। এটি বললে ভুল হবে না- গত ৫২ বছর আমাদের রাজনৈতিক পটভূমি সে একই সংকটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। জনকল্যাণে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মানুষ বর্তমানে তাদের প্রকৃত অধিকার চায়। আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংস্কারের বিকল্প নেই। নতুন বাংলাদেশ গঠনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের সংস্কার ও প্রস্তাবনার কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে না পৌঁছালে রাষ্ট্র সংস্কারে সমাধানের পথে কোনো সুফল আসবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
উপসংহার : দেশের জনগণের সঙ্গে আর প্রতারণা করা ঠিক হবে না। ইতিহাস থেকে আমাদের সঠিক শিক্ষা নেয়া উচিত। বৈষম্যহীন সুষম বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস, ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের সুযোগ এসেছে, এ যাত্রার জন্য আরও কিছু সময় ও পথ আমাদের একসঙ্গে অবশ্যই পাড়ি দিতে হবে।  
লেখক: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক সবুজ বাংলা
ই-মেইল : shamsurjabber@gmail.com




 

কমেন্ট বক্স