লেখাটি শুরু হোক মাইকেলের বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পঙ্্ক্তির উল্লেখ করে। এর কারণ আছে। সেই ব্যাখ্যায় পরে আসছি। মাইকেল মধুসূদন লিখেছেন :
‘আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু হায়।
জীবনপ্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায়,
ফিরাব কেমনে?
রে প্রমত্ত মন মম কবে পোহায়িবে রাতি,
জাগিবি রে কবে?...’
‘বাঙালি খুব আবেগপ্রবণ জাতি। মনটা এদের খুব নরম। এদের মনটা ঠিক দেশের পলিমাটির মতোই। সেই মাটিতে যা লাগানো যায় সবকিছুই ফলে।’ এমন আবেগভরা কথা বাঙালি জাতিকে নিয়ে বলা যেতেই পারে। সত্যি, বাঙালির মতো এত থরথর কাঁপা কাঁপা আবেগ অন্য কোনো জাতির মধ্যে দেখি না। তবে এরা যখন কাউকে ভালোবাসে, চোখ বুজে বুক চিতিয়ে ভালোবাসে আবার যখন কারও প্রতি আক্রোশের জন্ম হয়, তখন তার গুষ্টি উদ্ধার না করা পর্যন্ত তারা থামে না। বিষয়টা ভয়াবহ! এরা খানিক আবেগতাড়িত আবার খানিক প্রতিহিংসাপরায়ণ। এর কারণ কী? বাঙালি নৃতত্ত্ববিদেরা এসবের ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তবে যখন খুব একা থাকি, চুপচাপ নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াই, তখন শুধু নিজেকেই জিজ্ঞেস করি, ‘জাগিবি রে কবে?’
নিউইয়র্কের বাঙালিদের ‘বাঙালিপনা’ থেকে ‘আমেরিকাপনা’য় উত্তরণের কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি। ইস্ট রিভারের ওপারে ম্যানহাটনে গিয়ে মেইনস্ট্রিম সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের কোনো ওঠাবসা নেই। যদিও এই জাতির গোড়াপত্তনের ইতিহাস প্রায় তিন যুগ হয় হয়, তার পরও এখানকার বাঙালিরা সেই জ্যাকসন হাইটস-কেন্দ্রিক দলাদলিতেই এখনো আটকে আছে। ওপি ওয়ান লটারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত হিসাব করলে সময়কাল ঠিক এমনই দাঁড়ায়। ধরে নিলাম, এখানকার মেইনস্ট্রিমে বাঙালির যাওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই বা তারা ওই মুখো হতে চান না কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, গত ৩০ বছরে বাঙালির সাফল্যের পাল্লায় খুব বেশি কিছু জমা হয়েছে কি? বাঙালি নতুন প্রজন্মের কথা বাদ দিলাম। তারা নিজেদের পথ নিজেরাই বেশ ভালো করে চিনে নিয়েছে। কিন্তু এই যে আমরা বুড়োরা এ দেশে এত বছর ধরে আছি, আমাদের মানসিকতায় এবং শিক্ষায় সত্যি কোনো উত্তরণ ঘটেছে কি? আমরা বুড়ো হয়েছি বটে কিন্তু দেশ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা মারামারি-কাটাকাটির ঐতিহ্যকে বিদায় জানাতে পেরেছি কি? এখনো দেখি এখানে কোনো সংগঠন, কোনো প্রতিষ্ঠান, এমনকি উৎসাহী ছেলে ছোকরাদের তৈরি করা নতুন কোনো গানের দলও জন্ম হতে না হতেই ভেঙে দু-তিন খণ্ড হয়ে গেছে। আর না ভাঙলেও দেখা যাবে সংগঠনের ভেতরে ভেতরে নানা রকম পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। এর পেছনের কারণ কী? এটিই কি আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্য?
এর প্রধান তিনটি সম্ভাব্য কারণ আমি আমার অভিজ্ঞতায় চিহ্নিত করেছি। প্রথম কারণ হলো আমরা খুব কর্তৃত্বপরায়ণ জাতি। নিজেদের ভুল স্বীকার করতে আমরা চাই না। সহজে বশ্যতাও স্বীকার করতে আমরা চাই না। নিজের অন্যায়কে ‘ন্যায়’ বলে চাপিয়ে দিতে আমরা জীবনপণ যুদ্ধে নামি। আমরা নিজেদের মনে করি ‘আমিই একমাত্র রাজা আর পৃথিবীর সবাই আমার প্রজা।’ এই আইডেন্টি ক্রাইসিস বুকে নিয়ে আমরা ঘুমাই আবার জেগে উঠি। অতএব, আমাদেরকে কোনো কাজে এক জোট করা এত সহজ নয়। দ্বিতীয় কারণটা আরও কঠিন। বাঙালির ডিকশনারিতে ‘টলারেন্স’ বলতে কোনো শব্দ নেই। অন্য কারও কথা আমরা পারতপক্ষে শুনতে চাই না এবং মেনেও নিতে চাই না। কারণ মনের দিক থেকে আমরা র্যাশনাল নই। আমরা শুধু নিজের কথাটি বলি এবং সেই কথাটি যদি কেউ না শোনে, তাহলে তাকে দ্রুত শনাক্ত করি এবং তার বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচারে নেমে যাই। এই অপপ্রচারে নেমে যাওয়ার জন্য আমরা দ্রুতই একটা নিজেদের বাহিনী তৈরি করি এবং একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তৃতীয় দৃশ্য আরও ভয়াবহ। যথাযথ শিক্ষার অভাব। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ডিগ্রি নিই বটে, কিন্তু নিজেকে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারি না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে মানবিক করে, বিনয়ী করে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে পরস্পর ভালোবাসতে শেখায়। কিন্তু যেহেতু আমাদের এই বিদ্যাটি নেই, তাই আমরা যাকে পছন্দ করি না, তার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লাগি। প্রথমে তার চরিত্র হনন করি, তারপর তার জীবন ও কর্ম নিয়ে নানা রকম কল্পনার রং মাখিয়ে নেতিবাচক গল্প ফাঁদি। এসব হলো বাঙালির দীর্ঘদিনের রোগ। এই রোগ এক দিনে তৈরি হয়নি। আর এই রোগের রোগীদের নিয়ে বাঙালির কোনো সংগঠন টিকেও থাকতে পারে না।
আরেকটি বিষয় আপনাদের ভাবনা-চিন্তায় রাখা জরুরি। সেটা হলো বাঙালি কখনো কোনো শাসকের জাতি ছিল না। সেন বলেন, পাল বলেন, হিয়েন, মোগল, ইংরেজ এবং পাকিÑসবাই বাঙালিদের শোষণ করেছে, শাসন করেছে। ইতিহাস বলছে, শাসিত হতে হতে বাঙালি নিজেরাই নিজেদের কচুকাটা করেছে। বাঙালিদের কেউ কেউ বীর গলায় গর্জে উঠেছে বটে কিন্তু তাদের জাত ভাইরা সুযোগ বুঝে সেই বীরদের বুকে ছুরিও চালিয়েছে। এসবই হলো ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় পাতায় এমন ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
জগৎ পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় মানুষের মন। কিন্তু বাঙালির কোনো পরিবর্তন হয় না। গত ৩০-৩৫ বছরে নিউইয়র্কে বাঙালিদের বিশাল বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, বড় বড় দালান-ইমারত গজিয়েছে, বিভিন্ন পথে প্রচুর অর্থও বাঙালির পকেটে এসেছে। কিন্তু চিন্তা, মনন, শিক্ষা ও রুচিশীলতায় বাঙালির কোনো পরিবর্তন হয়নি। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি হানাহানির খবর, ভাঙাভাঙির খবর, পেশিশক্তির খবর, মাস্তানির খবর। ভালোবাসার খবর খুব একটা পেয়েছেন কি? মিল-মহব্বতের খবর খুব একটা শোনা যায় কি?
এখানে আরেকদল লোক বসবাস করেন, যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী এবং শিল্প-সংস্কৃতির বাহক বলে মনে করেন। তারা অনুষ্ঠানের সভাপতি হোন, তাদের কেউ কেউ মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা দেন। ঠিক এ পর্যন্তই। লক্ষ করলে দেখবেন, তাদের স্বার্থ সামান্যতম ক্ষুণ্ন হচ্ছে এমন কোনো অবস্থান দাঁড়ালে তারা তাদের আসল চেহারাটি প্রকাশ্যে সামনে নিয়ে আসেন। তখন লোকগুলো আর ‘সুশীল সমাজভুক্ত’ থাকে না। তাদের কদর্য রূপটি তখন মানুষ দেখতে পায় এবং আশাহত হয়। তখন জ্যাকসন হাইটসে বাঙালি সবজি বিক্রেতা পর্যন্ত বলে ফেলেন, ‘বাঙালি আমেরিকা আইসাও মানুষ হইল না।’ কবির ভাষায়, ‘তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা, হেতায় তুরে মানাইছে না রে, এক্কেবারে মানাইছে না রে।’ কিন্তু লাল পাহাড় বলেন আর রাঙামাটি বলেন, এরা কিন্তু কোথাও যায় না। এরা নিউইয়র্কের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে বসে থাকে আর বাতাস দূষিত করে।
আমি জ্যামাইকার যে এলাকায় থাকি, সেখানে একই রাস্তায় পাশাপাশি একটা মন্দির আর একটা মসজিদ আছে। মন্দিরের রং কমলা আর মসজিদের রং সাদা। এই সাদা আর কমলা রং দূর থেকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারেন, এখানে হিন্দু আর মুসলমান গলাগলি করেই থাকেন। সেদিন জুমার নামাজের আগের দিন মসজিদের সামনে দেখি, একদল কিশোর বয়সী ছেলেপেলে পানির পাইপ হাতে নিয়ে মসজিদের চারপাশটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত। কেউ মসজিদের সিঁড়ি পরিষ্কার করছে, কেউ দরজা-জানালা পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার করছে। এসব কাজের তদারক করছেন মসজিদেরই একজন বয়স্ক মুসল্লি। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম, বয়স্ক মুসল্লি লোকটা জোরে হাঁক দিয়ে ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, ‘এই যে প্রণব আর বিকাশ, তোমরা দুজন এবার মসজিদের পেছন দিকটায় চলে যাও। সেখানে গিয়ে জায়নামাজগুলো একটু ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলো, বাবা।’ আমার কান এবার খাড়া হয়ে গেল। মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নেমেছে হিন্দু ছেলেরা? আমি দাঁড়িয়ে থাকা মুসল্লি ভাইয়ের খুব কাছাকাছি এসে খুব আস্তেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, বিষয়টা বুঝলাম না। এই যে ছেলেপেলেরা মসজিদের ধোয়া-মোছার কাজ করছে, তারা কি সবাই হিন্দু?’ তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন? তারপর বললেন, ‘এরা হিন্দু কি না জানি না, তবে এরা সবাই আমাদের ছেলেপেলে। এই এলাকাতেই থাকে। এই যে মন্দিরটা দেখছেন, এটাও যেমন আমাদের মন্দির আর এই যে মসজিদটা, এটাও আমাদের। আমরা যে যখন সময় পাই তখনই একজন আরেকজনের পাশে এসে দাঁড়াই। আমি নিজেও মন্দির পরিষ্কার করি। এটাই তো ধর্ম? তাই না? আর এই ছেলেপেলেরা সব সময়ই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। নানাভাবে আমাদের সাহায্য করে। আমারও তাদের কাজে লাগাই।’
আমি সেদিন আর কোনো কথা বললাম না। নিজের মতো করেই আবার পথ চলতে শুরু করলাম। তবে কেন জানি সেদিন একটা উজ্জ্বল আলোও চোখের সামনে বেশ স্পষ্টভাবেই দেখতে পেলাম। চিৎকার দিয়ে উঠলাম! ইউরেকা! এই নতুন প্রজন্মই তো আমাদের শক্তি! এদের মধ্যে নিশ্চয় দলাদলি, মারামারি, কাটাকাটি নেই! মুক্ত হাওয়ায় মুক্ত মানসিকতা চর্চা করতে করতে এরা বড় হচ্ছে। আমাদের বুড়োদের কুটিল ছাপ তাদের গায়ে এখনো লাগেনি। এই মোক্ষম সময়ে মনে পড়ল কবিগুরুর কয়েকটা লাইন :
‘হেথা হতে যাও পুরাতন
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে।
আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি,
বসন্তের বাতাস বয়েছে।’
আমি আমার হিসাবের ভুল ঠিক দেখতে পেলাম। নিজেই নিজেকে বলছি ‘জাগিবি রে কবে?’ অথচ আমার অজান্তেই বাঙালি রক্তের আরেক প্রজন্ম কী অসাধারণ আর সুন্দর করেই না জেগে উঠেছে! আমি দেখতে পেলাম, এক ঝাঁক মাধবীলতা একটা বাড়ির দরজায় ঝুলে আছে। দেখতে পেলাম, নাম না-জানা অসংখ্য ফুলের দল তাদের বাহারি রং আর ঘ্রাণ নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ির জানালাগুলো ঢেকে দিয়েছে। আমি এক নতুন বাঙালির জোয়ার আবিষ্কার করলাম। নতুন প্রজন্মের বাঙালি! নতুন সময়ের বাঙালি!
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও অনুবাদক।