Thikana News
০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

স্বৈরাচারের দেড় দশক

স্বৈরাচারের দেড় দশক
ভারত-তোষণের নমুনা
মানুষ যে কতভাবে নিজেকে সময়ের হাত ধরে অমরত্বের আসনে বসাতে চায়, তার নজির তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। বড় স্বাদ হয়েছিল সিনেমা হলের বড় পর্দায় তার এবং পরিবারের সদস্যদের মানুষ দেখবে দূর থেকে আর সেই দেখাটা হবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার মতো। আকাশের তারাদের প্রতি মানুষ যে দৃষ্টিতে তাকায়, ওই রকম করে তাদের সবার প্রতি সাধারণ দর্শকের দৃষ্টি থাকবে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা হয়ে বিরাজমান থাকবেন তারা যুগ থেকে যুগান্তরে দৃশ্যপটে আর সেই উদ্দেশ্য নিয়েই অনুমতি দিয়েছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক বিশেষ আগ্রহ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়েও এসেছিলেন এবং এই বাবদ ৫৭৪ কোটি টাকার একটি বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০টি সিনেমা বানানোর জন্য বাজেট ধরা হয়েছিল ৩৭৮ কোটি টাকা। বাকি ১৯৬ কোটি টাকা ওই সব চলচ্চিত্র নির্মাণের তদারকির জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষের দিকে এ ধরনের ২৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় তাদের সাহায্য করেনি।
শেখ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে ১০টি সিনেমা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, তাতে গড়ে পাঁচ কোটি টাকা করে খরচ করলে মোট খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটিতে। তদন্ত কর্মকর্তার মতে, সেই পরিমাণটা যদি দ্বিগুণ হয়, তাহলে ১০০ কোটি টাকা হয়। বাকি ৪৭৪ কোটি টাকা কোন খাতে খরচ হতো? ওই বেঁচে যাওয়া অর্থ নিশ্চয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সব নেতা, পাতি নেতা থেকে শুরু করে নিম্নপদস্থ সব কর্মীর হাতে ভাগ-বাটোয়ারা মোতাবেক পৌঁছে যেত। আগের দেড় দশক ধরে দেশটা এভাবেই লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়ে পড়েছিল।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেড় দশকের উন্নয়নের বিশ্লেষণধর্মী ৩৯৬ পৃষ্ঠার যে খসড়া শ্বেতপত্রটি দাখিল করেছেন, সেখানে সাবেক সরকারের আমলে গৃহীত সাতটি মেগা প্রকল্পের ব্যয় প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী ট্যানেল প্রকল্প, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, পায়রা বন্দর প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্প। শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ পৌনে সাত লাখ কোটি টাকা। শ্বেতপত্র কমিটি ওই খেলাপি ঋণকে ‘ডিসট্রেসড অ্যাসেট’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছে, ওই ডিসট্রেসড অ্যাসেট দিয়ে দেশের ১৩টি মেট্রোরেল কিংবা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। কী ভয়াবহ তারল্য সংকটের জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক বেহায়া, যাদের লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি ব্যাংক এবং বাকি আটটি ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিক ইতিহাসের তথ্যমতে, ওই সব ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় শুধু ‘জয়’ নয়, শেখ রেহানাও একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করে শেখ হাসিনা এক টাকা ইজারা মূল্যের বিনিময়ে গণভবনকে নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিলেন। ওই সময়ে ‘জাতির পিতার উত্তরাধিকার আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ছোট বোন শেখ রেহানার নামে ঢাকায় একটি বিলাসবহুল বাড়ি এবং আনুষঙ্গিক খরচেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারপর নানা মেগা প্রকল্প থেকে বেশ বড় মাত্রার টাকার অঙ্ক নীরবে শেখ পরিবারের দুই উত্তরাধিকারীর নামে জমাও হতো। এত কিছুর পরও তাদের লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। ২০২২ সালের ৩ আগস্ট শেখ পরিবারের ছয়জন সদস্য, যেমন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল, টিউলিপ সিদ্দিক ও রেদওয়ান সিদ্দিক ববি মোট ছয়জনের নামে পূর্বাচল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংরক্ষিত প্লট থেকে ১০ কাঠা হিসাবে মোট ৬০ কাঠা জমি বরাদ্দ দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি করা হয়েছে খুব গোপনে। মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই সংক্রান্ত নথি গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতিবাদের মুখে পড়ে বিষয়টা আবারও সামনে এসেছে এবং নথিগুলো আবার রেকর্ডরুমে রাখা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য আরও একটা বিষয় হলো শুধু ২০১৮ থেকে ২০২১Ñএই সময়ের ভেতরে সরকারের মদদপুষ্ট ২৮৫ জনকে ওই পূর্বাচল প্রকল্পে জমি বরাদ্দ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যাদের মধ্যে ১৪৯টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদেরকে এবং অন্যগুলো দেওয়া হয়েছে কিছু আমলা ছাত্রলীগের নেতা ছাড়াও মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্যদের। লুটপাটের এটা এক খণ্ডিত চিত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় সব মন্ত্রী-এমপি লুটপাটের নামে সরাসরি জড়িত ছিলেন। বিষয়টা জানতেন শেখ হাসিনা, শুধু জানতেন না, লুটতরাজে ওই দুর্নীতিবাজদের পরোক্ষভাবে সহযোগিতাও করে গেছেন। তার অন্যতম কারণ হলো অধীনরা অদৃশ্য শক্তির সহায়তায় শুধু নিজেদেরকেই লাভের খাতায় শনাক্ত করতে পারত না, পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনার সব অন্যায়কেও তারা জায়েজ করে দিতে পারত। তাই আগস্ট বিপ্লবের পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ঘরেই হানা দিয়েছে, তাদের বক্তব্য অনুযায়ী প্রতিটি ঘর যেন ব্যাংকের বল্টের মতো; শুধু টাকা আর টাকার বস্তা! তত দিনে দেশের ব্যাংকগুলো ওইসব অবৈধ লেনদেনের জন্য নির্ভরযোগ্যতা হারিয়ে বসেছে। তা ছাড়া তাদের মনেও একধরনের অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়ে উঠছিল। তাই টাকা রাখার জন্য নিজের ঘরের জাজিম তোশকের নিচটা বরং নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচনায় নিয়েই এমনটা করেছিলেন অনেক দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদ। এই তালিকায় আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, আনিসুল ইসলাম, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ থেকে শুরু করে দীপু মনি! আর উপরের লেভেলের সালমান এফ রহমানের মতো বড় মাপের চোর-ডাকাতের সংখ্যা তো একেবারে এলাহি ধরনের, তবে দীপু মনির বিষয়টা তো একটু অন্য মাত্রার ছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের চার মেয়াদের সংসদ সদস্য এবং তিনবারের মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালনের সুবাদে দলে দীপু মনির অবস্থান খুব পাকাপোক্ত ছিল। বিগত সরকারের প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রী এবং চতুর্থ মেয়াদে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দলের কল্যাণে বিশেষ একটা স্থানে পৌঁছানোর সুযোগে তার আপন ভাই জে আর ওয়াদুদ টিপু ছিলেন তার সব অপকর্মের দোসর। টিপুর নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটা সিন্ডিকেট গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সাড়ে চার বছরে ১৮৭টি দেশ সফর করেছিলেন। এ জন্য ৬০০ দিনের মতো বিদেশে কাটিয়েছিলেন তিনি এবং এসব সফরে তার পুরো ব্যয় মিটিয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। দেশের ইতিহাসে তার এই সফর ছিল সর্বোচ্চ মাত্রার। দীপু মনির মতো দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে তার ভাইকে এতটাই ক্ষমতাবান করেছিলেন যে তার অঙ্গুলিহেলনে স্থানীয় জেলা প্রশাসককে পর্যন্ত বদলি করে দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছিলেন টিপু।
আর নিয়োগ বাণিজ্য থেকে নানামুখী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন দীপু মনি। নদী থেকে অবৈধভাবে ছয় হাজার কোটি টাকার বালু উত্তোলন থেকে শুরু করে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে নানামুখী দুর্নীতি, যেমন নোট বইয়ের প্রকাশ ও নির্মাণ ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন আদায় ছাড়াও দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড পরিবর্তনের নামে দীপু মনির অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল একটি চক্র। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন তিনি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগÑসবকিছু ছিল তার দখলে। কথিত আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের জন্য তিনি দুই কোটি টাকা এবং কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য নিতেন প্রকাশ্যে লাখ লাখ টাকা। চূড়ান্ত মাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত ওই দীপু মনির ভাই টিপু, নীল কমল ইউনিয়নের বাহের চরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি দখল করে গড়ে তুলেছিল টিপুনগর। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনো কিছু করার শক্তি ছিল না। এতটাই বেপরোয়া ছিল দীপু মনির সাম্রাজ্য। আর মাথার ওপর ছায়া হয়ে ছিলেন শেখ হাসিনার শাসনামলের পুরোটা সময়।
২০০৯ সালে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলগুলোর পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হতো ভারতের প্রেসে। দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে এসে সেই পুস্তক ছাপানোর জন্য মোটা দাগের কমিশন লাভ করতেন। এটা ওপেন সিক্রেট বিষয় হিসেবে স্কুলের জানা থাকলেও টুঁ শব্দ করার সাহস ছিল না কারও। এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন তার ব্যক্তিগত সহকারী দুজন পদত্যাগ করে অন্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
ভারতের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুগত্য অবশ্য অন্য আরেক কথা। শেখ হাসিনা সব সময় একটা কথা বলতেন, তার বক্তব্য অনুযায়ী ‘আমি যা দিয়েছি সেটা সারা জীবন মনে রাখবে ভারত’। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বরাবরই অন্য মাত্রার ছিল। ’৭১-এর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সমর্থন এবং সহযোগিতার কথা বাংলাদেশ চিরকালই মনে রাখবে কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব এই কথা চিন্তা করতে মন্তব্য করে যে ভারত স্বাধীনতাকামী একটা জাতির ভাবনা এবং কর্মকে বিবেচনায় রেখেছিল নিজ দেশের কথা মাথায় রেখে। দেশের স্বার্থের কথাটা তারা খুব বেশি চিন্তায় রেখেছিল। অনেকের মতে, অখণ্ড পাকিস্তানকে ভাঙতে পারলে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বিরাট মাপের পরিবর্তন আসবে, অন্যদিকে পোড় খাওয়া পাকিস্তানের মজবুত ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়বে। হয়েছেও সেটা। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে যখন কোনো শক্তিশালী সরকার-ব্যবস্থা ছিল না, সেই অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিধানের দোহাই দিয়ে ভারতীয় সেনাসদস্যরা অনেক দিন পর্যন্ত এ দেশে ছিল। আর সেই সুযোগে পাকিস্তানি আর্মিও ফেলে যাওয়া সমরাস্ত্র থেকে শুরু করে যানবাহন, কলকারখানার শিল্পবস্তু ছাড়াও কারখানার যন্ত্রপাতি সবকিছু তারা লুট করে ভারতে পাচার করেছে। এ বিষয়ে মেজর আব্দুল জলিল প্রথম প্রতিবাদ করে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এ ছাড়া এই লুটপাটের বিষয়ে লেখালেখি করেছেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ দু-একজন। ’৭১-পরবর্তী ৫১ বছরের ইতিহাসে ভারত সব সময়ই বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দমিয়ে রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর ভরসার জাল বিস্তার করে রেখেছিল। তারই প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা এসেছিলেন। সংক্ষিপ্ত সফরের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১৮ তারিখে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি-সংবলিত এক স্মারকে সই করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধী।
১২ দফা সংবলিত ওই চুক্তির শর্ত ছিল দুই দেশ একে অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিষয়ে সম্মান প্রদর্শন করবে এবং কেউই এসে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক আরও কয়েকটি ধারা ছিল চুক্তিতে এবং ওই সফরে স্থির হয়েছিল ভারত বাংলাদেশ থেকে তাদের সৈন্য ৭২ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে প্রত্যাহার করবে। যদিও চুক্তিটি ছিল দুই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের একটি নিদর্শন। কিন্তু মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে সব বিরোধী দল ওই চুক্তিকে গোলামির দাসখত হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস দেখিয়ে ওই সময়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ চুক্তির মেয়াদ যখন শেষ হলো, তখনো ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পরে ভারত-বাংলাদেশ কেউই আর ওই চুক্তি নবায়ন করেনি। শেখ সাহেবের জাতীয়তাবোধটা ঈর্ষণীয় মাত্রায় প্রখর ছিল। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে দিয়ে ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু তার কন্যার দেড় যুগেরও বেশি সময়ের শাসনামলে ভারতের কাছে নিজের দেশের সম্মান বিকিয়ে দিতে তিল পরিমাণ বাধেনি। একটার পর একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ভারতের সঙ্গে অসম এবং অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আর একবার যে কথা উচ্চারণ করেছিলেন তার পরিবারের সদস্যদের যারা হত্যা করেছিল তাদের বিচার করার জন্য এক দিনের জন্য হলেও ক্ষমতায় যাবেন তিনি। ক্ষমতায় গিয়ে প্রতিহিংসার আগুনে পুড়তে পুড়তে সেই কাজগুলোই সম্পন্ন করে গেছেন শেখ হাসিনা। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ভারতের সঙ্গে যতগুলো চুক্তি হয়েছে, সবগুলোই ছিল গোলামির চুক্তি। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির চূড়ান্ত উদাহরণ।
’৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছরের মতো সময়ে তিনি ভারতের মাটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েই সবগুলো চুক্তিতে সই করেছিলেন তিনি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। তার মধ্যে ভারত ৫৩টি নদীর ওপর বাঁধ দিয়েছে। পানিবণ্টনের আন্তর্জাতিক চুক্তির কোনো একটির প্রতিও ভারতের কোনো সমর্থন নেই। এই ৫৪টি নদীর মধ্যে কেবল গঙ্গা নদী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল, চুক্তি-পরবর্তী কোনো শর্তই মানে না ভারত। অধিকন্তু ফারাক্কা বাঁধের কারণে রাজশাহী অঞ্চল মরুময়তার কবলে পতিত হয়েছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের টালবাহানা নজিরবিহীন। ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে পানির আধাআধি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে একটা খসড়া চুক্তি সম্পাদনের বিষয় সামনে এলেও মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে সেই বিষয়টারও কোনো মীমাংসা হয়নি। এই চুক্তি নিয়ে পশ্চিম বাংলার দাবি হলোÑশুষ্ক মৌসুমে ভারতের হিস্যা বাড়িয়ে দেওয়া হলে তারা সই করবে। অথচ ২০২৪ সালের ২১ জুন শেষবারের মতো নির্বাচনে জিতে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসে তিনি যখন ভারত সফরে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ১০টি চুক্তিতে সই করেছিলেন। সেই ১০টির ভেতরে একটি ছিল ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারত পাইপের সঙ্গে উত্তোলন করে ত্রিপুরার সাবরুশ শহরে পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য নিয়ে যাবে। আর ওই সময়কালের বাদবাকি শর্তের ভেতরে ছিল ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল পার্টনারশিপ এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গ্রিন পার্টনারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় রেল ট্রানজিট-ব্যবস্থা, যা বাংলাদেশে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে চিলহাটি হলদিবাড়ী সীমান্ত দিয়ে আবার ভারতে ফিরে যাওয়ার রেল করিডোর। এ ছাড়া ছিল মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য মালবাহী ট্রেন চলাচলের সুবিধা আদায়ের চুক্তি। আরও কয়েকটি শর্তের মধ্যে ছিল বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে চুক্তি স্বাক্ষর। এর আগে ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছিল এবং সড়কপথে ২০১৫ সালে আখাউড়া-আগরতলা সীমান্ত দিয়ে প্রথম একটি পরীক্ষামূলক চালানও এসেছিল। এই এত সব দেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ দেখায়নি ভারত, বরং সীমান্তে মানুষ হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার যে কথায় সম্মতি দিয়েছিল ভারত, তার হিসাব হলো গত ১০ বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন ২৯৪ জনের মতো।
এসব বিষয় ছাড়াও গত দেড় দশকে শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী অনেক ধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, তার মধ্যে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুতের চুক্তি, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি ছাড়াও দেশের চিনিশিল্পকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ১১টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি কল উৎপাদনের ঘাটতি দেখিয়ে সরকারি এক নোটিশে গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ রেখে বাংলাদেশে ভারতীয় নিম্নমানের চিনি আমদানি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। স্কুলের সবগুলো পাঠ্যপুস্তক ভারতের প্রেসে ছাপার সুযোগ করে দিয়ে দেশের প্রকাশনাশিল্পকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া মোংলা বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার জন্য ভারতকে দেওয়া হয়েছিল এবং অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকের তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে ভারতীয় এক চুক্তিÑসবকিছুই ছিল নতজানু পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ। ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার আনুগত্য প্রকাশের এই নমুনা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
 

কমেন্ট বক্স