Thikana News
০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে কি জুলাই বিপ্লব পরাজিত হবে?

ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে কি জুলাই বিপ্লব পরাজিত হবে?
শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বর্তমান সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ভয়ংকর সব তত্ত্ব বের হয়ে আসছে। নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিখ্যাত নিউজ পেপারগুলোতে গুম কমিশন রিপোর্টের ভয়াবহ চিত্র স্থান পেয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে টেলিগ্রাফসহ বেশ কয়েকটি মিডিয়ায় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রূপপুর পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে সাগরচুরিতে শেখ পরিবারের সম্পৃক্ততার কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে, শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের সময় শেখ হাসিনাসহ তার ছবি প্রকাশ পেয়েছে এবং চার বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগে লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এদিকে চিন্ময় দাসের গ্রেফতার ও ইসকন ইস্যু নিয়ে উত্তপ্ত বাংলাদেশ ও ভারত সরকার। শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিগত এক যুগের সকল দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য বিচারের সম্মুখীন করতে ভারত সরকারের কাছে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে। দুর্নীতি প্রমাণ করার জন্য গত ২৩ ডিসেম্বর সরকারের তরফ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে ফাইল তলব করা হয়েছে। তার দুই দিনের মধ্যে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের ছুটির সময় রাত ১টা ৫২ মিনিটে বাংলাদেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ৭ নম্বর বিল্ডিংয়ের ৬, ৭, ৮ ও ৯ তলার সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় (যেখানে পদ্মা সেতুসহ সড়ক বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির খতিয়ান ছিল), অর্থ মন্ত্রণালয়, ডাক তার ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ চারটি তলায় শুধু চিহ্নিত পাঁচটি মন্ত্রণালয়ে রহস্যজনকভাবে আগুনে নথিপত্র, কম্পিউটার, আসবাবপত্রসহ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। দেশের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের ২১১ জন দমকল কর্মী, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় ছয় ঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে সোহানুর জামান নয়ন নামের একজন ফায়ার ফাইটার কর্মী মারা যান এবং দুজন আহত হন। বিশেষজ্ঞরা আগুনের ধরন দেখে নাশকতা বলে সন্দেহ করছেন। কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লাগলে তা এক স্থানে হতে পারে, সেই সঙ্গে পাশাপাশি রুমে যেতে পারে। কিন্তু এই আগুন লাগার পর ভবনের দুই দিকের কর্নারের চিহ্নিত মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন ভিন্ন তলায় আগুন দেখা যায়। সার্বক্ষণিক প্রায় দেড়শ সিকিউরিটি গার্ড নিরাপত্তার কাছে নিয়োজিত আছেন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এই অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হলো, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
সচিবালয় এখনো অন্ধকার। সাংবাদিকসহ কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সচিবালয় পরিদর্শনে পুলিশের ফরেনসিক বিভাগ ৭ নম্বর ভবনের অষ্টম তলায় সন্দেহজনক আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি কুকুরের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রসচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, রিপোর্টে হয়তো-বা রহস্যের উদ্্ঘাটন হবে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে এত বড় অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত, সেই রহস্য উদ্্ঘাটনের অপেক্ষায় সমগ্র জাতি।
বাংলাদেশে বড় বড় আমলা ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির রহস্য উদ্্ঘাটন করতে গিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর সেখানে আগুন লেগেছিল। সে সময় সকল অনিয়মের তথ্য-প্রমাণ পুড়ে যায়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও বিচার কিছুই হয়নি। জুলাই বিপ্লবের পর বিটিভির জিএম মাহফুজা আক্তারের ২১ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলছিল, তখন বিটিভি ভবন আগুনে পুড়েছিল। সেই বিচার বা তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে যখনই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্ন আসে, তখনই জাতির ভাগ্যে রহস্যময় আগুন-সন্ত্রাস নেমে আসে। আর অপরাধ চক্র পার পেয়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এভাবেই চলছে, এদের শিকড় অনেক গভীরে। যে সরকারই আসুক, তারা বহাল তবিয়তে তাদের ঘুষ, দুর্নীতির বাণিজ্য চালিয়ে যান। স্বাধীনতার পর থেকে আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। যে কারণে আমলারা এখন বেপরোয়া। যে সরকারই আসে আমলারা সমানতালে দুর্নীতি করে দেশে-বিদেশে বাড়িঘর, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া সবকিছুই চালিয়ে যান।
হিসাব নিলে দেখা যাবে, অর্থ পাচারসহ সকল অপকর্মে আমলারা অনেক এগিয়ে আছেন। সরকারের পতন হলে রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির কারণে জেলে যান, তাদের বিচার হয়। বিচার হয় শুধু রাজনীতিবিদদের, কিন্তু কজন আমলা জেলে যান? সব দোষ রাজনীতিবিদদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ওনারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। কিন্তু আমলারা নিজেদের স্বার্থে চাকরির বিধিমালা লঙ্ঘন করে ‘জনতার মঞ্চ’ করেন। সরকারের পতন ঘটিয়ে পদোন্নতি, চাকরিতে পুনর্বাসন হন। এ দেশে সবই সম্ভব। তাহলে দেশের কপাল পুড়ে ছাই হবে না তো কী হবে? প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের পেশিবলে সরকারকে হুমকি দিয়ে কথা বলেন। কয়েক দিন ধরে প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, মানববন্ধন, সরকারকে অচল করাসহ হুমকি-ধমকি দিয়ে বক্তব্য রাখছেন। এই প্রশাসনিক আমলারা শেখ হাসিনার সময় নিয়োগকৃত ক্যাডার। তাদের বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক স্লোগান, বক্তব্য ছিল খুবই আপত্তিকর ও চাকরি বিধিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাদের হুমকির কাছে সরকার নতি স্বীকার করে তথাকথিত সুবিধাবঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে।
সরকার কি ভেবেছে, আমরা স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার বিচার করছি। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের চারবারের ভোটারবিহীন নির্বাচনে, দিনের ভোট রাতে সম্পাদন করতে সম্পূর্ণ সহায়তা করেছে সারা দেশের ইউএনও, জেলা প্রশাসক, পুলিশসহ এই আমলাতন্ত্র। বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে তারা অঢেল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মেট্রোরেল, টানেল নির্মাণসহ দেশের ছোট-বড় হাজার হাজার প্রকল্পের সিংহভাগ পার্সেন্টের টাকা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সকল আমলা পেয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের সমস্ত অপকর্মের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ১৬ বছর কাজ করেছেন আমলারা। শেখ হাসিনার সরকার আমলা আর পুলিশ বাহিনী-নির্ভর হয়ে বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন করে ক্ষমতায় টিকে ছিল।
হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলনের জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়। মানুষের প্রত্যাশা দেশে বড় ধরনের সংস্কার হবে; যাতে ভবিষ্যতে দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার নিশ্চিত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো নাগরিক বৈষম্যের শিকার হবে না। অর্থনৈতিক লোপাট, প্রশাসনের ঘুষ-দুর্নীতির মূলোৎপাটন হবে। বিগত সরকারের আমলের দুর্নীতির বিচার এবং পাচারকৃত অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনা হবে। স্বৈরাচারের দীর্ঘদিনের সহযোগীদের ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে রেখে তা কি সম্ভব? রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যে সরকার গঠিত হলো, তারা কেন আমলাদের প্রতি এত নমনীয়? সরকারের প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল, আপসকামিতার কারণে এখনো প্রশাসনে গতিশীলতা আসেনি। বরং একটার পর একটা বিশৃঙ্খলা, গতিহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। স্বৈরাচারের দোসররা ক্ষমতায় থেকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে সুকৌশলে সরকারের কাজ বাধাগ্রস্ত করছে। তারা বিদেশি অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে মগ্ন। প্রতিদিন আন্দোলন ও দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে সরকার ও দেশকে অস্থিতিশীল করছে। শক্তি সঞ্চয় করছে কীভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করা যায়।
এদিকে দীর্ঘ বছর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী দলগুলোর মধ্যেও এখন পারস্পরিক সন্দেহ ও বিতর্কের কারণে জনমনে বহু প্রশ্ন ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে নিহত ও আহতদের পরিবারের সবাই সরকারঘোষিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়নি। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। জুলাই বিপ্লবসহ বিগত সরকারের আমলে গুম, খুন ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এত রক্ত, এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া সরকারের কাছ থেকে জনগণ তা প্রত্যাশা করেনি। উপরন্তু বিএনপিসহ ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিয়ত দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সরকারকে বিব্রত করছে। তাদের মনে রাখা দরকার, স্বৈরাচারের ১৬ বছরের রেখে যাওয়া জঞ্জাল পরিষ্কার ও দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা সহজ নয়। সরকার যদি এই জঞ্জাল নিরপেক্ষভাবে পরিষ্কার করে দিয়ে যেতে পারে, তবে আগামীতে যে দলই ক্ষমতায় আসবে, রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের জন্য সহায়ক হবে।
বাঙালি বীরের জাতি। স্বাধীনতার পর থেকে বারবার বিভিন্ন স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পতন করে বিজয় এনেছে। কিন্তু বিজয়ের সুফল ভোগ করতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর হানাহানি, সুবিধাভোগিতার কারণে বিফল হয়েছে। এবারও কি ষড়যন্ত্রকারী ও চক্রান্তকারীদের কাছে জুলাই বিপ্লব পরাজিত হবে? তাই এবারের এই পরিবর্তনের পর সবাইকে ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। 
আমাদের সবার উপরে দেশের স্বার্থ। আমরা গভীর এক সংকটের মধ্য দিয়ে চলছি। এর থেকে উত্তরণের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য আমাদের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা একান্ত জরুরি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত বিপ্লবোত্তর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষা নেওয়া। কীভাবে প্রতিবিপ্লবীদের দমন করা হয়েছে। চোখের সামনে যে ঘটনা ঘটছে, তা দেশের স্বার্থে কঠোর হস্তে দমন করা দরকার। নতুবা দেশ আরেকটা গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে। সবশেষে রাজনীতিবিদরাই দেশ চালাবেন। মানুষের কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র নিশ্চিত করে যথাশীঘ্র সম্ভব একটা সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির দ্বারা দেশ পরিচালনা করার ব্যবস্থা করুন। সকল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ-সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক

কমেন্ট বক্স