সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরেকটি বছর। ২০২৪। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে আর টাইমস স্কয়ারের বল পড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যাবে আরেকটি নতুন বছর। ২০২৫। কিন্তু ২০২৪ অম্লান হয়ে রয়ে যাবে আমাদের মনের মাঝে। এমন একটি বছর, যা বাংলাদেশের ছাত্র-সমাজ পুনরায় রচিত করে গেল।
ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০২৪ হচ্ছে ঘটনাবহুল একটি বছর। বছরটা যখন শুরু হয়েছিল কেউই ভাবেনি এ বছরটা ইতিহাসের পাতায় আরেকবার নতুন করে নাম লেখাবে। কালের সাক্ষী হয়ে থাকব আরেকটি নতুন দেশ জেগে ওঠার। ফ্যাসিবাদের করালগ্রাস থেকে একটি দেশ মুক্ত হয়ে মুক্তির ডানা মেলে উড়ে বেড়াবেÑএ যেন ছিল এক অবিশ্বাস্য কল্পনা। আর সেই কল্পনাই বাস্তবে রূপ নিল বছরের মাঝামাঝি জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে লড়াই করে প্রবল তোপের মুখে একটি দেশের সরকারপ্রধানের পালিয়ে যাওয়া, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা, যা দেখতে পেলাম এই ২০২৪ সালে। শুভ সূচনা হলো নতুন এক বাংলাদেশের, যেখানে সকলের প্রত্যাশা বৈষম্যহীন, ফ্যাসিজম-বিহীন এক রাষ্ট্র আবার গড়ে ওঠার।
একটি দেশ যখন অনাচার, অনিয়ম আর নিপীড়নের তীব্র জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, স্বৈরাচার যখন দেশটিকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছিল, তখনই রাষ্ট্রের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে সরকার ও তার দোসর বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আর এ আন্দোলনে শহীদ হয় শত শত মানুষ। হাজার বিশ বা তারও বেশি মানুষ শরীরে বুলেটের আঘাতে পঙ্গুত্ব বরণ করে। কারও হাত-পা বিচ্ছিন্ন, কেউবা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে চিরতরে অন্ধত্ব বরণ করেছে। গায়েবি শক্তির মতো গুমের শিকার হয়েছে শত শত মানুষ।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব তার দেশের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা। সেখানে রাষ্ট্রপ্রধান তার পা-চাটা হায়েনা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে নিরীহ শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নিরপরাধ মানুষদের গণহত্যায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। গুলি করেই শুধু ক্ষ্যান্ত হয়নি, লাশ পুড়িয়ে দিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগকেও তারা হার মানিয়েছে। এ গণহত্যায় যারা শহীদ হয়েছে, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। যারা এ গণহত্যা ঘটিয়েছে, তাদেরকেও যেন সৃষ্টিকর্তা তাদের কৃতকর্মের পাওনা বুঝিয়ে দেন, সেই ফরিয়াদ করি।
২০২৪ অনেক দিক দিয়েই হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে। পেশাগত দিক দিয়ে চাকরির ২৪তম বছর পার করলাম এ বছর। এ জন্য পরম করুণাময়ের নিকট শুকরিয়া আদায় করি। চাকরিতে পেশাগত দক্ষতার জন্য এ বছর লাভ করি নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব কারেকশনের সার্টিফিকেট অব এপ্রিসিয়েশন পুরস্কার। পেশাগত সংগঠন বেঙ্গলি আমেরিকান বোল্ডেস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বাবা) উপদেষ্টা পরিষদে যোগদান করাও ছিল এ বছরের বড় প্রাপ্তি। ধন্যবাদ জানাই বাবা’র সকল সদস্যকে, যারা আমাকে এ পদে নির্বাচিত করেছেন। নিউইয়র্ক সিটি বাংলাদেশি সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একজন সদস্য হয়ে প্রথমবারের মতো নিউইয়র্ক ব্লাড সেন্টারে রক্তদান করা শুরু করলাম এ বছর থেকেই।
এ বছর আব্বা এসে আমাদের সঙ্গে মাসখানেক থেকে গিয়েছেন। এটা আমাদের জন্য বড় পাওনা। আমাদের সন্তান মারসাদ এবার নতুন স্কুলে গেল। মারসাদের আম্মুর নতুন দুটি বই এবার প্রকাশও ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। বাংলাদেশ থেকে ভাতিজা আসিফ সপরিবারে আমাদের ভিজিট করল এ বছর, বাংলাদেশ থেকে বন্ধু রানা ও লাসভেগাস থেকে বন্ধু হিপু, ইন্ডিয়ানা থেকে ভাগিনা মুহাইমেন এসেও আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে গেল। ভালো লাগার কিছু সময় কাটালাম একসঙ্গে কৈশোরের বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে। এ বছর আমরা আমাদের বই নিয়ে অংশ নিয়েছিলাম দু-দুটো বাংলা বইমেলায়। নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বাংলা বইমেলা ও রকল্যান্ড কাউন্টি বইমেলা, আপস্টেট নিউইয়র্কে।
বিদায় হচ্ছে ২০২৪। রেখে যাবে আমাদের মনে অনেক স্মৃতি, বেদনা, ভালো লাগা আর ভালোবাসার পরশ। কালের নিয়মে সময় এগিয়ে যাবে। জীবনের আয়ুষ্কাল থেকে কমে যাবে আরেকটি বছর। রয়ে যাবে জীবনের অনেক পাওয়া না-পাওয়ার বেদনা। অনেক হতাশা, বিষাদ জীবনকে ভাবিয়ে তুলবে। কী হওয়ার কথা ছিল, কী হলাম? আমার সঙ্গে বেক বেঞ্চে যারা বসত, তারা আজ বাড়ি-গাড়ি বানিয়ে বিশাল জীবন যাপন করছে। অনেক কিছুই ভাবিয়ে তুলবে মনকে। কিছুই করতে পারলাম না। কী লাভ হলো লেখাপড়া শিখে? নানা রকম কাহিনি মনের মাঝে আমাদের দোলা দিয়ে যাবে। তার পরও সবকিছু মানিয়ে নিয়ে পরম করুণাময়ের শুকরিয়া আদায় করে বলতে হবে, আলহামদুলিল্লাহ। যেভাবে আছি ভালো আছি। তাকাতে হবে নিচের দিকে, আমার চেয়েও অনেকে খারাপভাবে দিন যাপন করছে।
পুরোনো বছরের সুখ কিংবা দুঃখভরা স্মৃতিকে বিদায় জানিয়ে নতুন উদ্যমে পথচলার প্রত্যয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে গোটা বিশ্ব। সেই সঙ্গে আমাদের দেশও। ইংরেজি নতুন বর্ষকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষায় মানুষ। দেশ-বিদেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই ট্রাভেলে ব্যস্ত। নতুন বছর নতুন কোনো স্থানে উদ্্যাপন করবে। পরিশেষে নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সবাই নিজ নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সুন্দর হোক সবার জীবনÑএ প্রত্যাশা। বিদায় ২০২৪, সুস্বাগত ২০২৫।