বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফল বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর বাংলাদেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাফল্যের প্রথম ধাপে ইতিমধ্যে নতুন সরকারের প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। ভারতসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, দীর্ঘদিন (প্রায় ১৭ বছর) যাবৎ রাষ্ট্রক্ষমতায় চেপে থাকা ভয়ংকর এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসকগোষ্ঠীকে পরাস্ত করে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সরকারের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার এমন গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা সত্যিই বিরল।
দীর্ঘদিন যাবৎ অবহেলিত ছাত্রসমাজ প্রথমে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনটি শুরু করলেও সেটি আর কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তী সময়ে সেটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। এই আন্দোলনকে ঘিরে তৎকালীন সরকারের নির্বাহী রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভরা অবহেলার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনটি চরম আকার ধারণ করে এবং দ্রুত দেশময় ছড়িয়ে পড়ে, যা ছিল সবার কল্পনার বাইরে।
সরকারি পুলিশ বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, নিপীড়নমূলক গুলিবর্ষণে বহু ছাত্রের হতাহতের মধ্য দিয়ে মাত্র ৩৬ দিনে সেই আন্দোলনটি উত্তপ্ত-অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। যার পরিণতি সরকারের পতন ঘটে। দীর্ঘদিন যাবৎ জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা এক শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কের পতন সত্যিই বর্তমান বিশ্বের এক বিস্ময়কর ঘটনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওই আন্দোলনকে দমন করার জন্য অত্যাধুনিক গোলাবারুদ ও মারণাস্ত্রের সাহায্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতম দমননীতির সর্বশক্তি প্রয়োগ, নির্যাতন ও পাশবিকতার কোনোটিই বাদ দেওয়া হয়নি। গুম-খুন-হত্যা ও নির্যাতনের মাত্রা যতই বাড়তে থাকে, ততই ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে। একপর্যায়ে সেটি সরকার পতনের এক দফার দাবিতে চূড়ান্ত গণআন্দোলনে পরিগণিত হয়।
১ জুলাই শুরু হওয়া আন্দোলনের মাঝপথে অর্থাৎ ১৬ জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের সরাসরি গুলিতে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মেধাবী ছাত্র শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদসহ ছয়জন ছাত্রের মৃত্যুর পর সমগ্র বাংলাদেশ উত্তপ্ত অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল, কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। একপর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে অভিভাবকেরাও যোগদান করেন।
পরিশেষে ছাত্র-জনতার চব্বিশের বিজয়ের সঙ্গে দেশের অসংখ্য নিষ্পাপ ছাত্রছাত্রীসহ অগণিত নিরীহ মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্ত ঝরানোর ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। সরকারি পুলিশ বাহিনী, বিজিবি এবং ছাত্রলীগের কথিত হেলমেট বাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতায় অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু-কিশোর এবং বিভিন্ন বয়সের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও জনসাধারণ হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে এক ব্যক্তির কুৎসিত নির্দেশনায় অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে নারী-শিশু, ছাত্রছাত্রী, পথচারী, পেশাজীবী, সবজি বিক্রেতাসহ নানান শ্রেণির মানুষকে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ কতটা ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর পৈশাচিক হামলা চালাতে পারে! রাষ্ট্র কতটা পাশবিক হলে সেই ভয়ংকর ক্র্যাকডাউন ঘটানোর আগে সারা দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে পুরো দেশ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পুলিশ বাহিনী এবং তৎকালীন সরকারের তথাকথিত হেলমেট বাহিনী অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশব্যাপী নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও ছাত্র-জনতার জাগরণকে দমাতে না পেরে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী বিজিবি এবং সরকারদলীয় ক্যাডারদের আক্রমণ-নিপীড়ন ভয়াবহ থেকে আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে। গ্রাউন্ড ফোর্স এবং হেলিকপ্টার থেকে একযোগে আক্রমণ করা হয়। নিষিদ্ধ মারণাস্ত্র প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্র ও নিরীহ জনসাধারণকে রাষ্ট্রযন্ত্রের গুলিবর্ষণ ও মারণাস্ত্র প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুরতম কায়দায় নির্মম গণহত্যা চালানো হয়।
১৬ জুলাই ২০২৪ থেকে আন্দোলনরত শত শত ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও জনতা মারাত্মক আহত হন। আক্রমণের মাত্রা কতটা ভয়ংকর হলে সরকারি বাহিনী তথা পুলিশের নির্দয় বীভৎসতা থেকে দুই বছরের শিশু রিয়া গোপ, চার বছরের শিশু আবদুল আহাদসহ অনেক শিশু-কিশোর পর্যন্ত রেহাই পায়নি।
জাতির কী দুর্ভাগ্য! বাংলাদেশের পুলিশ কেন এতটা নির্মম ও নৃশংস হলো? যেসব গুলি ও মারণাস্ত্র সমরযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, সাধারণ্যে নিষিদ্ধ ভয়ংকর সেসব মারণাস্ত্র কেন ছাত্রদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা কারও বোধগম্য নয়। সাধারণ জনগণের ওপর এ ধরনের মারণাস্ত্রের প্রয়োগ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
পুলিশের সেসব গোলা-বারুদ এতটাই ভয়ংকর ছিল, কোনো কোনো ছাত্রের বুকে একাধিক গুলি চালানো হয়। অধিকাংশের গুলি মাথায়, বুকে ও চোখে লাগে। বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে বেরিয়ে যায় এবং অন্যজনের বুকে গিয়ে লাগে। কাঁধে ঝোলানো স্কুলব্যাগের ভেতরে ঢুকে পিঠ ছেদিয়ে বুক দিয়ে বেরিয়ে দূরে ছিটকে পড়ে! রাষ্ট্রপুঞ্জের এমন নিষ্ঠুরতম নির্যাতন কতটা নিকৃষ্ট ও ভয়ংকর হতে পারে (?) ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন শাসক কর্তৃক রাষ্ট্রপুঞ্জ ও সমাজের ভাগ্যবঞ্চিত জনগোষ্ঠী শোষিত হয়েছে। ছাত্রসমাজ প্রতিবারই বৈষম্যের শিকার হয়েছে। মনন ও মেধার যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও অনেকে সরকারদলীয় ছাত্রক্যাডার দ্বারা অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে সরকারদলীয় ছাত্রনেতাদের সৃষ্ট কথিত গণরুমে মেধাবী ছাত্রদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো এবং আটকে রেখে তাদের প্রতি নিগৃহীত ও নির্যাতন করা হয়। বিগত বছরসমূহে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় ক্যাডারদের অত্যাচার ও নিপীড়নে অনেক ছাত্রের প্রাণহানিও ঘটেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যাসহ অনেক ছাত্রছাত্রী ছাত্রলীগের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। প্রশাসনিক দিক থেকেও বৈষম্য প্রদর্শন করার মধ্য দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের প্রতি অবহেলা ও অধিকার হরণ করা হয়। এভাবেই দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অসন্তোষ ও তিক্ততায় দেশময় আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং ছাত্রজনতা ফুঁসে ওঠে।
জুলাই-২৪ এর ১ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার মধ্যে সরকার দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। মামলা, হামলা ও ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। ১৬ জুলাই রংপুরের সমন্বয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদসহ কয়েকজনের নিহত হওয়ার পর সারা দেশে আন্দোলনের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সেটি সর্বাত্মক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। দেশের ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক, পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী, কলাকুশলীসহ সর্বস্তরের মানুষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
সারা দেশে ১৭ জুলাই রাতে ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়। তারপর মার্চ ফর জাস্টিস এবং ১৯ জুলাই থেকে সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। তখন থেকে ঢাকা শহর এবং জেলা শহরগুলোতে গভীর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছাত্রছাত্রীদের বাসায় বাসায় পুলিশ বাহিনীর অতর্কিত হানা ও ধরপাকড় শুরু হয়। অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজনকে গুম ও নির্যাতন করা হয় এবং ছয় সমন্বয়ককে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি অফিসে আটকে রেখে জোরপূর্বক তাদের দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়।
৩ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে কয়েক লাখ ছাত্র-জনতার সামনে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন এবং আন্দোলনের ডাক দেন। সরকার পতনের এক দফা ঘোষণার সময় শহীদ মিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য সমন্বয়কের মধ্যে সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, আবদুল কাদেরসহ লাখ লাখ ছাত্র-জনতা। পরিস্থিতি খারাপ ও ক্রমাগত অবনতি এবং পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অবশেষে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে, যা পৃথিবীতে বিরল। অবশেষে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। দেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের হাল ধরে। এভাবেই ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয় সাধিত হয়। যার মূলে রয়েছে চব্বিশের প্রজন্ম, বীর সেনানী মেধাবী তরুণ ছাত্রসমাজ। দেশের সূর্যসন্তান শিশুসহ কোমলমতি ছাত্রসমাজের চরম আত্মত্যাগ ও অকৃত্রিম ভালোবাসার এ ধরনের অনুপম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।
এবার আসা যাক ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ প্রসঙ্গে। বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ৭২ ঘণ্টা পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এরই মধ্যে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ড. ইউনূসের দেশে বিলম্বে প্রত্যাবর্তন এবং তার অবস্থান পরিষ্কারকরণে গড়িমসিতে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। অনেকের ধারণা, বিপ্লবের পর সেনাবাহিনী আরও সতর্ক থাকলে হয়তো দেশব্যাপী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো যেত।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পেশাগত জীবনে তিনি বহু বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায়ও যুক্ত ছিলেন। ড. ইউনূস ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্রঋণ ও একেবারে ক্ষুদ্রবিত্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ধারণার প্রেরণার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল ‘মেডেল অব ফ্রিডম’ এবং ২০১০ সালে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেলসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি সেই সাতজনের একজন, যারা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববিখ্যাত এবং প্রশংসিত। অর্থনীতির উন্নয়নে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক মানবিক কর্মে মহোত্তম ও উৎকৃষ্ট অবদানের স্বীকৃতিতে পৃথিবীতে অভূতপূর্ব সম্মান ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম গ্রামীণ ব্যাংক চালু করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে খ্যাতিমান হয়েছেন। অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন উন্নত বিশ্বসহ পৃথিবীর অনেক দেশ গ্রহণ করে সুফলপ্রাপ্ত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের পতিত সরকার তাঁর ওপর মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করিয়ে নানাভাবে তাঁকে নিগৃহীত, অপমান ও অসম্মানিত করেছে। অপমানের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে অনেকগুলো হয়রানিমূলক মামলায় তাঁকে অভিযুক্ত এবং আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও নোবেলজয়ীর পক্ষ থেকে ড. ইউনূসের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন এবং তাঁর ওপর থেকে মিথ্যা মামলাগুলো তুলে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানান।
অনাকাক্সিক্ষত নেরেটিভস দ্বারা সরকার এবং বাংলাদেশের দলবাজ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় প্রেসক্লাব এবং সরকারি পদলেহনকারী মুখচেনা সাংবাদিকেরা শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন ও সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। যদিও সেটি আর স্থায়ী হয়নি। জাতির জন্য আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, দেশের সুবিধাভোগী একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকসমাজ এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ তাদের বিবেকবোধকে বিসর্জন দিয়ে ড. ইউনূসের মতো অনেককেই মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেন।
মানুষ মাত্রই ভুল আছে। কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। মানুষের ভুল যেমন আছে, তেমনি সংশোধন করার সুযোগও রয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করি, তেমনি তাঁর কোনো ত্রুটি থাকলে সমালোচনা করার অধিকারও আমাদের রয়েছে। কিন্তু তাঁর যেসব অবদান দৃশ্যমান, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের আমাদের সূর্যসন্তান মেধাবী ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী মহান আন্দোলন ও প্রাণ উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। সম্মানিত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, চব্বিশের মহান বিজয়ের পর দেশের পুলিশ বিভাগ ভেঙে পড়েছিল। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই মেধাবী ছাত্রসমাজ সড়ক-মহাসড়কের ট্রাফিকের কাজসহ সেবামূলক কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছেন। বর্তমানে বিপর্যস্ত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও উপাসনালয় এবং পাড়া-মহল্লা পাহারা দিয়েছেন। তারা জাতীয় সংসদ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থানসমূহ পরিষ্কার করেছেন। বিভাগীয় শহরসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, নগরীর মোড়ে মোড়ে এবং সড়কসমূহে শিশু-কিশোর এবং তরুণ ছাত্রসমাজ ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করে এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
অথচ কী নিষ্ঠুরতম পরিণতি! সেই ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার দেওয়ার পরিবর্তে মেধাবী ছাত্রদের শুধু অবমূল্যায়নই করা হয়নি; তাদের প্রতি তৎকালীন দানবীয় সরকারের পেশিশক্তি লেলিয়ে দিয়ে অত্যন্ত নির্দয়-নিষ্ঠুরতম পৈশাচিক হামলার মধ্য দিয়ে অসংখ্য ছাত্রজনতাকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার মানুষকে আহত করা হয়। স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে পৃথিবীতে এমন কলঙ্কজনক পৈশাচিক হামলার বীভৎস দৃষ্টান্ত খুব কমই রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া সেই সব নিষ্পাপ শিশু-কিশোর ও ছাত্রসমাজের করুণ মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দুষ্টাচারী অধিকর্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থপর শিক্ষক, সুবিধাভোগী অসৎ বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও পদকলোভী অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং ভীরু সুশীল সমাজ টুঁ শব্দ করেনি। প্রতিবাদ করেনি। এমনকি সমবেদনাও জানায়নি। আরও দুঃখজনক, সেই সব নিরপরাধ নির্মোহ, নিষ্পাপ ছাত্রদের প্রতি সেম্পোটাইজ ও সহমর্মিতা না দেখিয়ে উল্টো তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়। এসব সুবিধাবাদী এতই নির্বোধ, জাতীয় দুর্যোগের গণবিপদের সময়ও কথা বলতে পারেন না।
দেশের মেধাবী ছাত্র বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদ, ফারহান ফাইয়াজ, মীর মুগ্ধসহ অসংখ্য মননশীল ছাত্রসমাজ, নিষ্পাপ শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই আন্দোলনে কী পরিমাণ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, এর সঠিক পরিসংখ্যান এখনো করা হয়নি। দ্রুত নিহতদের তালিকা প্রণয়ন হওয়া দরকার। এ ছাড়া হাজার হাজার ছাত্র ও সাধারণ মানুষ পুলিশের ভয়ংকর মারণাস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছেন। গুলির আঘাতে চক্ষু হরণ এবং মারাত্মক অঙ্গহানির ফলে অনেকে চিরকালের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশি বর্বরতায় ঢাকা শহর ছাড়াও সারা দেশের হাসপাতালসমূহে ২০ হাজারের বেশি আহত ছাত্র-জনতা এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত শিক্ষার্থীদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করছেন। আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহতদের দ্রুত সুচিকিৎসা প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মনে রাখতে হবে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বীরদের শাহাদাতবরণ, গুম হয়ে যাওয়া এবং অসংখ্য আহতদের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
বিপুল ত্যাগ ও রক্তের আখরে লেখা হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত জাতির গর্বিত সন্তান মননশীল বীর ছাত্রসমাজ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
পরিশেষে আমাদের দাবি, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন শক্ত হাতে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। সকল অরাজকতা বন্ধ এবং শক্ত হাতে দেশের আইনশৃঙ্খলার উন্নতি নিশ্চিত করবে। দেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনে সচেষ্ট থাকবে এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করবে। আগেরকার সরকারের সকল অপরাধের কঠোর বিচার নিশ্চিত করবে। দেশের লুণ্ঠিত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটিয়ে পাচার হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে। দেশ-বিদেশের মুক্ত বাণিজ্যনীতি প্রতিষ্ঠা করে অর্থনীতির উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক