ছাত্র আন্দোলনের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। ছাত্রসমাজ উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাজনের পর তৎকালীন পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান বাংলাদেশেও প্রয়োজনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করে আসছে। তৎকালীন পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে লাগলে আমরা ছাত্রসমাজ সোচ্চার হই এবং আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নির্যাতিত হয়ে শহীদের রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করি। ছাত্রসমাজের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন ও সর্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। পরম পরিতাপের বিষয়, ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনের ফল ও ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেও স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রতিপত্তিশালী, প্রভাবশালী, দুর্নীতিবাজ নব্য বাঙালি শাসক গোষ্ঠীর হাতে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে সরকারি চাকরিতে একপেশে কোটা প্রথা প্রবর্তন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যার কারণে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৭২ সালে এক নির্বাহী আদেশে সরকারি, বেসরকারি প্রতিরক্ষা, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রবর্তন করা হয়।
উল্লেখ্য, কোটা প্রথা নিয়ে শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলন দ্বিতীয় দফা। মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে আন্দোলন তখন থেমে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আদালতের এক রায়ের পরে দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। পুরো জুলাই মাস শিক্ষার্থীদের টানা কোটা আন্দোলনে দেশ বিপর্যস্ত হয়। ক্ষমতাসীন দল আন্দোলন দমনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনী এবং তাদের দলের ছাত্রসংগঠনকে লেলিয়ে দেয়। সরকারের দমননীতির ফলে অহিংস আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। সরকারের পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শত শত শিক্ষার্থী নিহত হন এবং আহত হন অনেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো ছাত্র আন্দোলনে এটাই সবচেয়ে বড় মৃত্যুর দুঃখজনক ঘটনা।
সরকারের বক্তব্য ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পুঁজি করে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গি দুর্বৃত্তরা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অফিস ও ভবনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং লুটতরাজ চালিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস জনসাধারণ কারও কাম্য নয়। তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। তবে নির্বিচারে নৃশংসভাবে ছাত্রহত্যা হবে কেন? এভাবে শিক্ষার্থীদের হত্যা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্মম পাশবিকতা নয় কি?
ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের উত্তরসূরি আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছেন বলে শোনা গেছে। শেখ হাসিনার এই মন্তব্য জঘন্য মিথ্যা, অনভিপ্রেত, অনাকাক্সিক্ষত ও কাল্পনিক। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান সময়ে দেশপ্রেমিক ছাত্রসমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে গঠনমূলক আন্দোলন করে আসছে। ভাষা আন্দোলন করে নির্যাতিত হয়ে, শহীদ হয়ে মাতৃভাষার সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করাÑসর্বক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকা পালন ও অনন্য অবদান। সেই আদর্শবাদী, আত্মত্যাগী, দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীদের রাজাকার মন্তব্যকারীদের মস্তিষ্ক বিকৃতি বলা যায়।
সরকার দোর্দণ্ড প্রতাপে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে দেশব্যাপী কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে কারফিউ চলা অবস্থায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত কোটা-সংক্রান্ত বিষয়ে আদেশ দেন ২১ জুলাই। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়। আপিল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, অবশিষ্ট ৭ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য। বাকি ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য বরাদ্দ থাকবে। তবে সরকার চাইলে এই কোটার হার কমবেশি করতে পারবে। নতুন আদেশে দেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা করে কোটা থাকছে না।
কোটার ব্যাপারে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগের সংশোধিত রায়ের পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আট দফা দাবি জানিয়েছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা ও ছাত্রসংসদ চালু, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে জারি করা সব মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক, আইনি বা প্রশাসনিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা। সরকার অহমিকা ও একগুঁয়েমির কারণে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে অব্যাহত গতিতে দমননীতির আশ্রয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধরপাকড় ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে।
এদিকে সরকারের দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন, দুঃশাসন, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা এবং বাক্্স্বাধীনতা হরণে পুঞ্জীভূত ব্যথা ও ক্ষোভাক্রান্ত জনগণ একাত্মতা ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আন্দোলন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় আন্তরিকভাবে না হলেও নিরুপায় হয়ে সরকার আলোচনার জন্য গণভবন উন্মুক্ত বললেও তখন আন্দোলনের ভয়াবহতা এবং ছাত্র-জনতা-সেনার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান অত্যাসন্ন হওয়ায় অন্তিম অবস্থায় আর আলোচনার পরিস্থিতি ও সুযোগ থাকেনি এবং জনসমুদ্রের অভাবনীয় তোপের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দ্রুত বঙ্গভবনে গিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করে তাৎক্ষণিকভাবে দেশত্যাগ করে পালাতে হয় এবং আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীন অপরাজনীতি, দুঃশাসন ও কর্তৃত্ববাদী স্বৈর শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনা দম্ভ করে বলেছিলেন, তিনি পালাবার মানুষ নন। কিন্তু তিনি পালিয়ে গেলেন। স্বৈর শাসক শেখ হাসিনা আত্মদম্ভ, অহমিকা, একগুঁয়েমি পরিহার করে যথাসময়ে যদি শিক্ষার্থীদের ৮ দফা ন্যায্য দাবি মেনে সমঝোতায় আসতেন, তবে তার এ পরিণতি ও যবনিকাপাত হতো না। শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়া ও মিসরে জনরোষে সরকারপ্রধানদের উড়ে যাওয়া দেখে শেখ হাসিনার শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে আচার-আচরণে মনে হতো দেশটা মন্ত্রী-এমপিদের। জনগণ রাষ্ট্রের মালিক নয়, ক্ষমতার উৎস নয়, সরকারের দাস। সরকারের দুঃশাসন-কবলিত বঞ্চনা ও শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সন্দেহাতীতভাবে সত্য প্রতিষ্ঠিত করে দিল, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক এবং ক্ষমতার উৎস। পৃথিবীর ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থানের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে বাংলাদেশ যেন এ ক্ষেত্রে অনন্য। এ অঞ্চলে মোট পাঁচটি অভ্যুত্থান হয়েছে। প্রথম অভ্যুত্থান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ১৯৬৯ সালে। তৃতীয়টি ছিল ১৯৭২ সালে। চতুর্থ গণঅভ্যুত্থান ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে।
পরিশেষে একজন রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে সবার প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান, গণআন্দোলনে রাজনৈতিক বিজয়ের পর এখন অর্থনৈতিক বিজয় অর্জনের জন্য সচেষ্ট হওয়ার। যার যার অবস্থান থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করে দেশকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে তুলে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা সচল করে দেশে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ খুবই জরুরি। ইতিমধ্যে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। দেশ পরিচালনার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনে সাংবিধানিক নিয়ম মেনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন জাতীয় সংসদ গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার গঠনে সহায়তা করবে। সুশাসনের মাধ্যমে সুষ্ঠু দেশ পরিচালনায় দেশপ্রেমী নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকার এবং ক্ষমতা নির্লোভ নিরপেক্ষ গঠনমূলক সমালোচনার বিরোধী দল অপরিহার্য। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লোভ। যে যায় লঙ্কা সে হয় রাবণ। বারবার জীবন দিয়ে স্বৈর শাসক পরিবর্তন করার চেয় পুরো শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যাতে স্বৈর শাসক তৈরিই হতে না পারে।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও কলাম লেখক।