Thikana News
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পরলোকে ভ্রমণপ্রিয় সাহিত্যিক- শিক্ষাবিদ আসমা আব্বাসী

পরলোকে ভ্রমণপ্রিয় সাহিত্যিক- শিক্ষাবিদ আসমা আব্বাসী


খ্যাতিমান সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ছিলেন অধ্যাপিকা আসমা আব্বাসী। পৈতৃক ও বিবাহসূত্রে ঐতিহ্যময় পারিবারিক জীবন। পূণ্যভূমি সিলেটে জন্ম ১৯৪২-এর ৪ জানুয়ারি। পিতা ছিলেন সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল হাবিবুর রহমান চৌধুরী। মামা কিংবদন্তী সাহিত্যিক, ভ্রামণিক সৈয়দ মুজতবা আলী। শ্বশুর কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ। স্বামী কণ্ঠগর্ব ও ভ্রামণিক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ঢাকার গুলশানে স্বামীগৃহে প্রয়াণ ২০২৪-এর ৪ জুলাই। বিদেহী আত্মাদের ‘মর্ত্যভ্রমণের বার’ বৃহস্পতিবারে। 
গায়ক আব্বাসীর সঙ্গে লেখিকা আসমা’র বিয়ে ১৯৬৩-তে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মধ্যস্থতায় ‘প্রেম থেকে পরিণয়’। ৬৮, পুরনো পল্টন, ঢাকার ‘হীরামন মনযিলে’ বসবাস। সঙ্গে শাশুড়ি লুৎফুন্নেসা আব্বাস, ভাসুর ব্যরিস্টার/বিচারপতি মোস্তাফা কামাল সপরিবার। গৃহকর্তা আব্বাসউদ্দীন প্রয়াত হয়েছেন ১৯৫৯-এর ২৭ ডিসেম্বর। শত শতাংশের ওপর সংস্কৃতিপ্রধান বাড়িটির সাজবহর। 
ষাট দশকের উপান্তে খ্যাতিমানের বাড়িতে এলেন আরেক খ্যাতিমান। কিংবদন্তী সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী এলেন ভাগ্নি-জামাই সকাশে। তিনি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী’তে পড়েছেন ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত। স্নাতক হলেও সাতটি ভাষায় বুৎপত্তি নিয়েছেন। জানতেন বাংলা, সিলেটি নাগরী, হিন্দি, সংস্কৃত, সাংখ্য-বেদান্ত। এছাড়া জার্মান, ইটালিয়ান, ফারসি, আরবিও। বিশ্বভারতীর পর আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স, ইউরোপে পিএইচডি। 
ভাষাদক্ষ বহুমাত্রিক মুজতবা আলী ছিলেন রম্যলেখক ও ভ্রামণিক। ছেলেবেলা থেকেই ভাগ্নি আসমা আব্বাসী ছিলেন মামার অনুরক্ত। বিশেষ করে রবীন্দ্রভক্তি ও ভ্রমণকলাকে গুরুত্ব দিতেন। ততোদিনে বেরিয়েছে ‘দেশে-বিদেশে’, ‘জলে-ডাঙায়’ ভ্রমণগ্রন্থ। ‘মুসাফির’ নামেও আরেকটি বই বাজার পেয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে একটি মৃদু সমস্যা দেখা দিলো। কবি জসীমউদ্দীন ‘চলো মুসাফির’ নামে আরেকটি বই করছিলেন। আমেরিকা সফরের ওপর ধারাবাহিক লেখা ছাপছিলেন পত্রিকায়।
মুজতবা আলীর অনুযোগ ছিলো সমোচ্চারিত নামটি নিয়ে। কবি জসীমউদ্দীনকে ঐ নামকরণ থেকে রহিত করা চাই। কিন্ত উল্টোকথা শুনিয়েছিলো ভাগ্নি আসমা, জামাই আব্বাসী। বলেছিলো, হিতে বিপরীতও হতে পারে। কবিচাচা বলতে পারেনÑ তোমাদের মামাকেই পাল্টাতে বলো। উনি অন্য নাম দিয়ে দিলেই সমস্যাটা চুকে যায়। 
উল্লেখ্য, জসীমউদ্দীন ও মুজতবা আলীর বয়েস ছিলো পিঠাপিঠি। পল্লীকবি জসীমের জন্ম ১৯০৩-এর পয়লা জানুয়ারি ফরিদপুরে। প্রয়াণ ঢাকায়, ১৯৭৬-এর ১৪ মার্চ। অন্যদিকে মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪-এর ১৩ সেপ্টেম্বর। পৈতৃকবাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, তবে জন্ম করিমগঞ্জে। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনকালে সিলেট মুসলিম ইনস্টিটিউটে প্রবন্ধ পড়েন। দেহত্যাগও ঘটে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ, ১৯৭৪-এ। 
দুই কীর্তিমান লেখকের কাছেই আব্বাসী-দম্পতি চিরঋণী ছিলো। আব্বাসউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় জসীমউদ্দীনকে ডাকতেন ‘চাচা’। আর পরিবারিক সূত্রে মুজতবা আলী ‘মামা’। আব্বাসউদ্দিনের অসংখ্য ভাটিয়ালি, পল্লীগীতির গীতিকার/সংগ্রাহক ‘জসীম কাকা’। আসমা আব্বাসী ওনার সহিত্যকর্ম নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন। ‘চাচী মমতাজ জসীমউদ্দীনে’র রন্ধন ও বাগান চর্চারও অনুরক্ত ছিলেন। 
অন্যদিকে ‘মামা’ মুজতবা আলীও প্রভাবিত করেন আব্বাসী দম্পতিকে। প্রথমত রবীন্দ্রচর্চায় উভয়ে মামা’র আকাঙ্খা পূরণ করেন। ‘রবীন্দ্রনাথ : প্রকৃতির দান’ শিরোনামে বই লেখেন আসমা আব্বাসী। তবে মুজতবা আলী ছিলেন ‘ভ্রমণানন্দে ওনাদের হিরো’। ‘দেশে-বিদেশে, জলে-ডাঙায়’, একাধিকবার পড়েন আব্বাসী দম্পতি। দেশ-বিদেশ ভ্রমণের বিশেষ ছবক নেন ‘মামা’র থেকে। ‘মামা’ বলতেন, ‘জীবনের ব্রত হোক উঠোনসমুদ্র পেরুনো।’ 
এরপর আর রাজধানী ঢাকায় শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকেননি আব্বাসী দম্পতি। রবীন্দ্রনাথের পংক্তিকে আরাধ্য করে নিবেদিত হন ভ্রমণকলায় > 
বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে 
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা 
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া 
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে 
একটি শিশির বিন্দু।
(শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৭ই পৌষ ১৩৩৬, শান্তিনিকেতন)
সারা পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশ দেখেছেন আব্বাসী দম্পতি। সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবেই অধিকাংশ ভ্রমণ ঘটিয়েছেন। পেশাগতভাবে মুস্তাফা জামান আব্বাসী বেছে নেন স্বাধীন পেশাÑ ব্যবসা। মাঝে একবছর ছিলেন সরকারি ‘শিল্পকলা একাডেমি’র মহাপরিচালক। অন্যদিকে সাহিত্যিক আসমা আব্বাসী বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স। ইচ্ছে করলে সরকারি বা উচ্চমার্গীয় প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারতেন। কিন্তু ভ্রমণচিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে একটি কলেজেই কাটালেন একজীবন। সেটি একই পাড়ার ‘পুরানা পল্টন গার্লস কলেজ’। 
‘হীরামন মনযিল’ থেকে কলেজ- একেবারেই হাঁটাপথ। ১৯৬৩-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জড়িয়ে থাকলেন অধ্যাপনায়। ১৯৯৫-এ শিক্ষকতায় পেলেন রাষ্ট্রপতি পদক। ছিলো অপরাপর সামাজিক, সাহিত্যকর্মে ভূমিকা রাখার সুযোগ। স্বামী, সন্তান, পরিবারের তদারকির সুবিধা। লেখাপড়ায় সন্তান সামিরা, শারমিনীর উচ্চতর রেকর্ড। কচি-কাচাঁর আসর, ইনার হুইল ক্লাব ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকা। বছর বছর নতুন বই উপহার দেওয়া। স্বামীর সঙ্গীত, গবেষণা ও প্রকাশনাকর্মে সহযোগী হওয়া। সর্বোপরি বছরে দু’বার তিনবার গ্রাম বা বিদেশযাত্রা। 
ব্যক্তিগতভাবে মুস্তাফা জামান আব্বাসী আমার ফুপাতো ভাই। আমার ভাবী-সিরিজে আসমা আব্বাসী হলেন ‘ভাবীশ্রেষ্ঠ।’ ১৯৬৬-এর অক্টোবরে শিল্পী-সহোদরা ফেরদৌসী রহমানের বিয়ে হলো। পৈতৃকবাস বৃহত্তর রংপুরের ডোমার থেকে ঢাকা এলাম। পরিবারের সঙ্গে কিশোর আমি সেই ভাবীকে পেলাম। বিনিসূতোর মালায় গাঁথা দেবর-ভাবীর আন্তরিক সম্পর্ক। আমারও সুযোগ হয়েছিলো ওনাদের ‘ভ্রমণ-সারথী’ হওয়ার। কখনও দেশের উত্তরে, কখনও দক্ষিণে। কথনও বা আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বিশাল আমেরিকায় একাধিকবার। তিনটি স্মৃতিময় ভ্রমণবৃত্তান্ত আপাতত পাঠকসমীপে মেলে ধরছি। 
ক. আসমা ভাবীর নানাবাড়ি- সিলেট, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া। 
২০০৪ সালের গ্রাম-অভিমুখী নানামাত্রিক ঘটনা সেটি। নিউইয়র্কের ঠিকানা’র বাংলাদেশের প্রকাশনা ‘মানবঠিকানা’র আয়োজন। রয়েছে পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার, সাংস্কৃতিক মেলা। প্রধান অতিথি লোকগায়ক-গবেষক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। প্রধান আলোচক অধ্যাপক-লেখক আসমা আব্বাসী। কবিতাসমেত উদ্বোধক আমি সালেম সুলেরী। সভাপতিত্বে ঠিকানা কর্ণধার এমএম শাহীন, এমপি। রংপুর-ডোমারের ‘আব্বাসউদ্দিন একাডেমি’ বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। 
ঢাকা থেকে কুলাউড়া অভিমুখে ট্রেনে স্বর্গীয় অভিযাত্রা। জীবনপাতার স্মৃতিময় আকর খুঁজতে আসমা ভাবীর সে কি উদ্দীপনা। বললেন, নানাবাড়িতে আমার শৈশব-কৈশর হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বললেন, তাইতো এটি আমার ‘স্বর্গীয় আভিযাত্রা’। আবার বললেন, সুলেরী তোমার সেই ছড়াটা শোনাও না>
কই কই কই সব
স্মৃতিময় ঐ সব
হাফ প্যান্ট পরা আর 
ধুলো মাখা শৈশব...।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
লেখক : কবি-সাংবাদিক-কথক।

কমেন্ট বক্স