Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ রক্তাক্ত জুলাইয়ের গগনচুম্বী অর্জনকে নস্যাৎ করবে

অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ রক্তাক্ত জুলাইয়ের গগনচুম্বী অর্জনকে নস্যাৎ করবে
অনস্বীকার্য যে গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের অনেক অধিবাসী নিরক্ষর। তাদের এই নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির উন্নাসিক শিক্ষিত ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ গ্রামীণ জনগণকে অজ্ঞ ও নির্বোধজ্ঞানে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং উপহাস করেন। কিন্তু সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা অরণ্যকুন্তলা প্রকৃতির রূপসী কন্যা গ্রামবাংলার জনগণ যে আদৌ অজ্ঞ কিংবা নির্বোধ নন, স্মরণাতীতকাল থেকেই বুকের উষ্ণ রক্তের ঢল বইয়ে দিয়ে তারা তা বারবার প্রমাণ করেছেন। কামার-কুমার, চাষি-তাঁতি, কুলি-মজুর, শ্রমিক-কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদ তথা সর্বস্তর ও পেশার আপামর বাঙালির সর্বাত্মক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্দোলনের ফসল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা অর্জন। আবার সর্বস্তরের আপামর বাঙালির অকুণ্ঠ সমর্থনে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের নেতৃত্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ অন্য কয়েদিরা অবধারিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
এদিকে সর্বস্তর ও পেশার বাঙালির সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়েই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও পরাধীনতা শৃঙ্খলমুক্তির ঝিনুক দিয়ে সাগর সেচার দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। এশিয়ার টাইগার হিসেবে খ্যাত ৯৬ হাজার পাক বাহিনীকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে রক্তিম সূর্যখচিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছিল বীর বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধারা। সময়ের অগ্রযাত্রায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে ছাত্রদের নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে। সর্বশেষ সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা এবং তরঙ্গাভিঘাতে গত ৫ আগস্ট এশিয়ার লৌহমানবী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের তখতে-তাউস ভঙ্গুর কাচের মতো ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। ছোট বোন রেহানা সমভিব্যাহারে ভারতে পালিয়ে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্তাবক ও চেলাচামুণ্ডা এবং ১৪ দলের নেতাকর্মী ও উচ্ছিষ্টভোগীদের অবশ্যম্ভাবী করুণ পরিণতি জানতে হলে দেশবাসীকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
যাহোক, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনে ক্ষমতার হাতবদল-পরবর্তী দেশবাসীর সামগ্রিক কল্যাণ/অকল্যাণ এবং রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্টদের আলাদিনের চেরাগ হস্তগত হওয়ার খতিয়ান দেশবাসীর নখদর্পণে। জাতির দুর্ভাগ্য যে প্রতিটি সফল আন্দোলন-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন দলের মসনদচ্যুতির পর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুনভাবে মসনদে আরোহণকারী রাজনৈতিক দলের নেতা-খেতা, হোমরা-চোমরারা বরাবর যাবতীয় কৃতিত্ব এককভাবে দাবি করে। অনবদ্য কারণে অন্যান্য দলের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও গঠনমূলক অবদানের সঠিক মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে বহু আগেই নির্বাসনে গেছে। এমনকি আন্দোলন-সংগ্রাম পূর্ববর্তী বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা চুক্তিমালাও সফল অভ্যুত্থান-পরবর্তী বানের জোয়ারে ভেসে গেছে।
মোদ্দাকথা, যে দল কিংবা যিনি মসনদ দখল তথা লঙ্কায় গিয়েছেন, সেই দল এবং দলীয় অনুসারীরাই বারবার রাবণ বনেছেন এবং প্রকারান্তরে জাতীয় জীবনে যা লাউ তা কদু হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে। আর নিয়তিলাঞ্ছিত- হতদরিদ্র ও চিরশোষিত জনগণের দুর্ভোগের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে কাঞ্চনজঙ্ঘা-হিমালয়ের মতো দুর্লঙ্ঘ্য পবর্তমালায় পরিণত হয়েছে। সেই দুর্লঙ্ঘ্য-দুর্ভেদ্য প্রাচীর বিদীর্ণ করে বর্তমানে বাস্তুহারা ও জোত-জমাহীন ছিন্নমূল বাংলাদেশিদের অন্তরে আশার কোনো আলোকবর্তিকা জ্বলে না। তাই রাজনৈতিক সুবিধা এবং উচ্ছিষ্টভোগী গুটি কতক ছাড়া সামগ্রিকভাবে দেশের মোট ৮৫ শতাংশ জনগণ হাল-আমলে রাজনৈতিক নেতা- নেত্রীদের গালভরা প্রতিশ্রুতি-অতিশয়োক্তি-আশ্বাসে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেন না। রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন এবং পালাক্রমে ক্ষমতার হাতবদলকে রাজনৈতিক উচ্ছিষ্ট ও সুবিধাভোগী ছাড়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই ললাটের লিখন হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন।
বাস্তবতার মানদণ্ডে ছাঁচাছোলা ভাষায় বলতে হয়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাতবদলে দেশের মোট জনসংখ্যার বড়জোর ০.৩ শতাংশ অকূল শোকসাগরে ভেসে গেছে এবং নতুনভাবে ক্ষমতারোহী দলের নেতা-নেত্রী, চেলা-চামুণ্ডা, আশীর্বাদপুষ্টসহ দেশের মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ০.৫ শতাংশ রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনেছে। আর ছলে-বলে-কলে-কৌশলে মসনদে আরোহণকারী প্রত্যেক সরকারই রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুণ্ঠন ছাড়াও একচ্ছত্র আধিপত্য চিরস্থায়ী করার মানসে পূর্ববর্তী সরকারের চুরির স্থলে ডাকাতি, রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে জোর-জবরদস্তিমূলক মন্ত্রী/এমপিদের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উপঢৌকন আদায়; প্রতিপক্ষের সমূল উৎপাটনের লক্ষ্যে লাঠির স্থলে আগ্নেয়াস্ত্র, পেশিশক্তি, ভোটকেন্দ্র দখল, মিডিয়া ক্যু, দিনের ভোট রাতে নেওয়া, ৮ শতাংশ ভোটকে ঘুম থেকে জেগে উঠে ৪২ শতাংশ ঘোষণা দেওয়া, ফলাফল ভণ্ডুলসহ সব ধরনের সংস্কার/অপসংস্কার, নিয়ম/অনিয়ম নতুনভাবে আমদানি করেছে। বিচারহীনতা, ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায়-জুলুম-নির্যাতনকে স্বার্থসিদ্ধির অব্যর্থ হাতিয়ার হিসেবে জাতীয়করণ করেছে এবং যাবতীয় পাপাচারকে দেশ ও জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে দিয়েছে। আর অমানুষিক নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ দেশবাসী অগত্যা আশায় বুক বেঁধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, প্রচলিত শাসন ও বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার, অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান ইত্যাদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দুরভিসন্ধি ও উসকানিমূলক বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তারপর ক্ষমতাসীন সরকারের গোলা-বারুদ, কামান-বন্দুকের ভীতি উপেক্ষা করে মরণসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং অনেকে আত্মাহুতিও দিয়েছেন। এ ছাড়া ক্যু-পাল্টা ক্যু, সারসহ কৃষিপণ্য ও জীবনধারণের প্রাত্যহিক নিত্য অপরিহার্য উপকরণ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে এবং আয়নাঘর, কাচ ভবন ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েও অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বোপরি প্রতিপক্ষীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুনের অসংখ্য অভিযোগে দেশবাসীর কান রীতিমতো ঝালাপালা হয়ে উঠেছে। তবে ক্ষমতাসীন সরকার সর্বদা কঠোর হাতে প্রতিপক্ষের আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করায় কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামই সাফল্যের মুখ দেখেনি বললে সত্যের অপলাপ হবে না। বরং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীকে ইচ্ছেমতো কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে এবং ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষীয় দলগুলোর বারোটা বাজিয়েছে।
সেই মানদণ্ডে রক্তাক্ত জুলাইয়ের সাম্প্রতিক কোটা বাতিল তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অকল্পনীয় ও অবিস্মরণীয় সাফল্য সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী ও অলৌকিক বললে অত্যুক্তি বা অতিশয়োক্তি হবে না। মূলত এই অলৌকিক ও অবিস্মরণীয় সাফল্যের পেছনে ছিল সরকারের যাবতীয় শোষণ-নির্যাতন ও অত্যাচারের স্টিম রোলারের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের মাথা নত না করার বজ্রকঠোর সংকল্প। তাদের সেই মরণপণ সংকল্পের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় সংস্থা ও কলম সৈনিকেরা। হত্যা-গুম-খুনের মাত্রা বাড়ার তালে তালে বিস্ফোরণোন্মুখ আন্দোলনও তুঙ্গে উঠেছে। এমনতর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি আমলা-কামলা এবং সর্বপেশা ও স্তরের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিণতিতে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। বহ্নিমুখ পতঙ্গ ও পঙ্গপালের মতো হাজার হাজার আন্দোলনকারী গণভবন অভিমুখে বিদ্যুৎ গতিতে ধেয়ে আসছে খবর পেয়ে অবশেষে ১৬ বছরের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে পদত্যাগপূর্বক পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ভাষায় এবারের রক্তঝরা জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও স্বমহিমায় ভাস্বর। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিংবা উপযাজক সেজে যারা ভাগ বসানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছেন, তারা মূলত বোকার স্বর্গেই বাস করছেন। মূলত সদ্য ক্ষমতাচ্যুত একনাগাড়ে ১৬ বছরের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আন্দোলন-সংগ্রামের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান দেশবাসীর অজানা নয়। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাড়াবাড়ি করলে শেষ পর্যন্ত থলে কেটে বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক ডাকসাইটে নেতা-নেত্রীর সাম্প্রতিক অযৌক্তিক ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ অগ্নিঝরা বক্তব্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জাতীয় সমস্যাবলির কাক্সিক্ষত সংস্কার, নতুন নির্বাচন ও পরিকল্পনার রোডম্যাপ ইত্যাদি দাবিদাওয়াকে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী নিছক বাকচাতুর্য ও অবাঞ্ছিত বাড়াবাড়ি জ্ঞান করছেন। কারণ বিগত ৫০ বছরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের মাধ্যমে জাতীয় সমস্যাবলির কতটুকু বাস্তবসম্মত সমাধান হয়েছে, নাকি সমস্যাবলি ডালপালা মেলে উত্তরোত্তর বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে, তা দেশবাসীর অজানা কিংবা অদেখা নয়। বস্তুত স্বাধীনতা-উত্তর প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের আমলেই পর্যায়ক্রমে বিচারহীনতার। 
সংস্কৃতি, সরকারি বরাদ্দে মন্ত্রী-এমপিদের হিস্যা, ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-চাঁদাবাজি, সরকারি সম্পদ লুণ্ঠন, হেরোইন আসক্তি-মাদক সেবন, ভোটকেন্দ্র দখল ও ডাকাতি, দিনের ভোট রাতে হওয়া, ফলাফল ভণ্ডুল, মিডিয়া ক্যু, পেশিশক্তির উত্থান ইত্যাদি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বর্তমানে গোটা দেশ ও জাতি সমস্যার অতলস্পর্শী সাগরে সারা দেহ নিমজ্জিত রেখে এবং নাকটাকে পানির ওপর তুলে ধরে কায়ক্লেশে নিঃশ্বাস টেনে যাচ্ছে। তাই কাক্সিক্ষত সংস্কার সাধনের পূর্বে চাপের মুখে চটজলদি নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত সরকারের ওপর জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলির সমাধানের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করলে আম-ছালা দুটোই খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে অনেকটা হলফ করে বলা যায়, কোনো নির্বাচিত সরকারই ১৬ বছরের পুঞ্জীভূত জাতীয় জঞ্জাল অপসারণ ও সমস্যার সমাধানে সক্ষম হবে না। কারণ ব্যক্তিস্বার্থ, দল এবং স্বজনপ্রীতি আমাদের অস্থিমজ্জায় স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে এবং অতীতের কোনো দল এবং সরকারই অভিশাপমুক্ত ও ধোয়া তুলসী পাতা ছিল না। ফলে জঞ্জাল অপসারণ এবং সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত বিচারহীনতা ও সমস্যার অতলস্পর্শী সাগরে নিশ্চিতভাবেই গোটা দেশ ও জাতির সলিলসমাধি রচিত হবে এবং জাতীয় অস্তিত্ব চিরতরে বিপন্ন হবে বলে দেশবাসীর বদ্ধমূল ধারণা।
স্মর্তব্য, ১৯৮০ এর দশকের দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যসূচিতে প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ওই প্রবন্ধে বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ ও বণ্টনের যে বস্তুনিষ্ঠ ভাষাচিত্র অঙ্কন করেছেন, তা বাস্তবিকই মর্মবিদারী। লেখকের বর্ণনা অনুসারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দুর্যোগকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী নিজেদের আখের গোছানো ও স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। এই তথাকথিত পরহিতৈষী রাজনৈতিক নেতাকর্মী বিপন্নদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এবং রিলিফ সামগ্রী আর্তদের মাঝে যথাযথ বিলি না করে নিজেদের দল ভারী করে। বিগত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন সরকারের আমলে রিলিফ সামগ্রী নিয়ে নয়ছয়ের ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে।
এবারও বাংলাদেশের জনগণ স্মরণকালের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক বন্যার শিকার। দেশের ১২টি জেলার কয়েক লাখ লোক পানিবন্দী এবং মানবেতর ও শ্বাসরুদ্ধকর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী, সেনাবাহিনী-কোস্টগার্ড ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, বৈষম্যবিহীন ছাত্রসমাজ, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় সংগঠন ও দাতব্য সংস্থা এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণ সংগ্রহ, বিতরণ ও বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে যথাসর্বস্ব উজাড় করে দিচ্ছেন। অবশ্য আমাদের দেশের লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সংস্থার স্থায়িত্বের বিবেচনায় বৈষম্যবিহীন ছাত্রসমাজ নেহাত শিশু। বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নেতাকর্মীর মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ ও বণ্টন-প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, পাশাপাশি ঢাকঢোল পিটিয়ে যথারীতি প্রচারও করছে অব্যাহতভাবে। পক্ষান্তরে মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেকের তাড়নায় উদ্বেলিত সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ জোয়ারের বানের মতো ত্রাণসামগ্রীর বোঝা নিয়ে হাজির হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে। আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের যথাসর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার যে দৃষ্টিনন্দন চিত্র টিএসসি চত্বরে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ও অতুলনীয়। আমার ধারণা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পেশাজীবী-শ্রমজীবী, হতদরিদ্র নির্বিশেষে দেশের আপামর জনগণ সম্ভবত সম্যক অবহিত যে ত্রাণসামগ্রী কার কাছে জমা দিলে তা বন্যাকবলিত প্রকৃত অভাবগ্রস্ত-অসহায় জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে। তাই টিএসসি চত্বরে আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের যথাসর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় সকলেই মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দৃষ্টিনন্দন প্রতিযোগিতা সকলের হৃদয়ের গভীরস্থিত মনুষ্যত্ববোধকে সজোরে নাড়া দিয়েছে এবং পরার্থপ্রিয়তা ও মানবপ্রেমের শাশ্বত আবেদন আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সকলকে অনুপ্রাণিত করেছে। অধিকন্তু সহস্র বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বাঙালি নিরক্ষর হলেও নির্বোধ নয়। তারা কাক ও কোকিলের মৌলিক পার্থক্য নির্ণয়ে সিদ্ধহস্ত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কগণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, নিছক স্বৈরশাসকের বিদায় এবং কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায়নের জন্য তারা সংগ্রাম করছেন না। জাতীয় মৌলিক সমস্যাদির কাক্সিক্ষত সমাধানই তাদের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আবার একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া অপরাপর আন্দোলন-সংগ্রাম, অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে আহত-নিহতের সংখ্যার তুলনায় রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আহত-নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই এবারের রক্তের দাগ মুছতে এবং ক্ষতচিহ্ন শুকোতে যথেষ্ট সময়ের দরকার। এ অবস্থায় সর্বমহলকে অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অন্যথা কোনো দল বা মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত-অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ রক্তাক্ত জুলাইয়ের গগনচুম্বী অর্জনকে নস্যাৎ করবে। অসংলগ্ন মনে হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়, পত্র-পত্রিকায় নতুন চাঁদাবাজ ও দখলদারদের দলীয় পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর বর্তমানে দেশবাসী বিস্ময়বিমূঢ় ও হতবাক।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
 

কমেন্ট বক্স