Thikana News
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

একজন প্রবাসীর চোখে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’

একজন প্রবাসীর চোখে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’


একজন ক্ষমতালোভী, স্বৈরাচারী শাসক, যিনি ভেবেছিলেন তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে-Untouchable. একদল বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী তরুণ, যারা জানত তারা অপ্রতিরোধ্য-Unstoppable.
এর পরের ঘটনা আপনাদের সবার জানা। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের দ্বিতীয় জন্ম, দ্বিতীয় স্বাধীনতা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে থাকা একজন প্রবাসী বাঙালি হিসেবে আমি কীভাবে দেখেছি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে?
জুলাই ২০২৪ :
জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমরা গিয়েছিলাম সপরিবারে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। এবারের গন্তব্যস্থল ছিল ইউরোপ ও আফ্রিকা। ভেবেছিলাম ফিরে এসে আমার ভ্রমণকাহিনি নিয়ে লিখব। তা আজ লিখতে বসেছি। তবে ভ্রমণকাহিনি নয়, কোটা আন্দোলন নিয়ে। ভ্রমণকাহিনি পরে লেখা হবে।
আমাদের যাত্রার প্রথম স্টপ ছিল স্পেনের মাদ্রিদ। সেদিন ছিল ১৬ জুলাই। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের এয়ার বিএনবিতে পৌঁছে ভাবলাম, গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নিই। তারপর ঘুরতে বেরোব। ওমা, বাথরুম থেকে বেরোতেই আমার হাজব্যান্ড হন্তদন্ত হয়ে বললেন, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে মারা পড়ছে, তবু পিছু হটছে না। ফোন করে একটু খবর নিয়ো তো সবাই ভালো আছে কি না।
তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিলাম। ঢাকা, ছাত্র আন্দোলন গুগল সার্চ দিতেই অনেকগুলো খবর ফিডে চলে এল। একনিঃশ্বাসে পড়তে লাগলাম। আগে কিছুটা জানা থাকলেও আরও ভালো করে জানলাম কোটা আন্দোলনের কথা। কোটা আন্দোলনের পুরো নাম কোটা সংস্কার আন্দোলন, যেটা শুরু হয়েছিল এ বছরের ১ জুলাই থেকে। তবে এর মূল সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগে, যেটা বারে বারে পরিবর্তন, বাতিল, সংযোজন করা হয়েছিল। এ বছর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কারÑসরকারি চাকরির সব পদে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা, যাতে মেধার ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়া থেকে বাদ না যায়। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারীর পরিবারের কেউ যাতে আত্মীয়ের সুবাদে চাকরি না পায়।
আমার মনে হলো, এটা খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। সুপারিশ বা পরিবারের সুবাদে চাকরি পাওয়ার কথা তো পাশ্চাত্যের দুনিয়ায় চিন্তাই করা যায় না। বিশেষত, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। চাকরিতে ঢোকার আগে সবাইকে কমবেশি ইন্টারভিউ দিতে হয়। সেটা কারও রিকমেন্ডেশনে গেলেও একই কথা। এরপর অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যোগ্যতা বিচারের ভিত্তিতে ফাইনাল প্রার্থীকে নির্বাচন করা হয়।
আমাদের ঘোরাঘুরি মাথায় উঠল। যতগুলো দর্শনীয় জায়গা দেখতে যাই না কেন, মাথার ভেতরে সারাক্ষণ একই জিনিস ঘুরছিলÑকী চলছে দেশে? হাতের মুঠোফোনে সারাক্ষণ নিউজ আপডেট ফলো করছিলাম। প্রথম দিকে সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৬ জুলাই থেকে এই আন্দোলন ভয়াবহ আকার ধারণ করল। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীর মৃত্যু সারা দুনিয়ায় বাঙালি জাতিকে কাঁপিয়ে তুলল। এর কয়েক দিনের মধ্যে অগণিত ছাত্র-জনতার মৃত্যুর খবরে বিশ্ববাসী বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পথচারী, সেবাদাতা, ভলান্টিয়ার কর্মী, এমনকি আন্দোলনের বাইরে দোকানদার, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস কর্মী, শ্রমিক, নিরাপত্তা কর্মী কেউ বাদ গেল না। যখন খবরে এল, ছোট ছোট শিশুরা বাবার কোলে, ছাদে খেলতে গিয়ে, জানালায়, বারান্দায় কী হচ্ছে দেখতে গিয়ে, কোনো কিছু বোঝার আগেই শহীদ হয়েছে, বাঙালির হৃদয় কেঁপে উঠল এই সহিংস নাশকতায়। কারও মাথায় এল না সরকার কী করে পারে অবলীলায় এই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করতে।
আল্লাহ‌র দুনিয়াতে কোনো কিছুই নজর এড়ায় না। টেকনোলজি এখন এতই দুর্দান্ত ও নিখুঁত যে, কোনো ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণ রাখা বা ছবি, ভিডিওতে ধারণ করা কোনো ব্যাপারই নয় আজকের যুগে। অসংখ্য ছবি, ভিডিও, রিল, স্টোরি, মেসেজ, শর্ট ক্লিপ, মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ঘিরে। প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেখল আসলে কী ঘটছে, অন্যদিকে অবাক বিস্ময়ে হজম করল সরকার বলছে যে কোনো কিছুর জন্য তারা দায়ী নয়। আর কী করছে, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড চালিয়ে। যেকোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালির বুঝতে বাকি রইল না ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রহসন আর অপপ্রচার।
নিরপরাধ মানুষ কোনোভাবেই অকারণে প্রাণ হারাতে পারে নাÑএই একটা চিন্তাই সারা বিশ্বের দেশপ্রেমিক বাঙালিদের বিবেককে নাড়া দিল। লাগামহীন হত্যা, রাতের আঁধারে গ্রেফতার, নির্যাতন, হয়রানি, হুমকির খবর অনবরত নিউজ পোর্টালগুলোতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসতে থাকল। দেশের ভাইবোনদের জন্য, তরুণ সমাজের জন্য কিছু করার জন্য আকুলিবিকুলি করে উঠল প্রবাসী বাঙালির মন। দেশের বিভিন্ন স্তরের ব্লগার, ইউটিউবার, ইনফ্লএন্সার, অ্যাকটিভিস্টদের ডাকে সাড়া দিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাঙালি সমাজ।
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল দেশ, মহাদেশ, সাগর পেরিয়ে দূরদূরান্তের ভূখণ্ডে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ল উত্তেজিত বাঙালিরা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী স্লোগান, প্রটেস্ট, ব্যানার, বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ, জনসমাবেশÑযে যার জায়গা থেকে অংশ নিল এই আন্দোলনে। অকুতোভয় রেমিট্যান্সযোদ্ধারা সাড়া দিল তাদের জায়গা থেকে। জুলাই মাসে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো তারা কমিয়ে দিল বা বন্ধ করে দিল। অনেক রেমিট্যান্সযোদ্ধা আন্দোলনে স্বজন হারাল। তবু সেই কষ্ট বুকে চেপে সামাজিক মাধ্যমে তারা পোস্ট দিল, প্রিয় ভাইবোনেরা, আমাদের দেশটাকে আগে স্বাধীন করুন। এরপর দ্বিগুণ পরিশ্রম করে অধিক রেমিট্যান্স পাঠিয়ে পুষিয়ে দেব। আহা, কী অপূর্ব তাদের দেশপ্রেম, কী কঠিন তাদের দেশের প্রতি টান।
এদিকে কিছুদিন পরপর ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালানোর খেলায় মেতে উঠল রক্তপিপাসু সাবেক সরকার। কিন্তু তাতে একটুও দমল না জেন জি প্রজন্মের ছাত্রসমাজ। ভিপিএন ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন মহল্লায় এলাকাভিত্তিক ওয়াইফাই চালু ও শেয়ারের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ এবার সাহায্য চাইল আন্তর্জাতিক কমিউনিটি ও অভিবাসী বাঙালিদের কাছে। সাহায্য চাইল অবাঙালি ইন্টারন্যাশনাল কনটেন্ট মেকারদের কাছে। তাদের আকুল আবেদন ছড়িয়ে পড়ল সবার স্ক্রিনে স্ক্রিনেÑআমাদের সাহায্য করুন। আমাদের ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে আপনারা হবেন আমাদের ভয়েস। আহা, এমন ডাকে সাড়া না দিয়ে কি চুপচাপ বসে থাকা যায়।
তাই এবার মাঠে নামল অনলাইন-যোদ্ধারা। প্রবাসীরা হয়ে উঠল বিপ্লবী। দেশের বাইরে থাকা বাঙালিরা সামাজিক মাধ্যমে তুলল প্রতিবাদী ঝড়। বিভিন্ন ধরনের তথ্য, ছবি, ভিডিও, নিউজ, আর্তি, আবেদন, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, হুঁশিয়ারি বার্তা, আল্লাহ‌র দরবারে দোয়াÑএমন বহুমুখী প্রচারণায় ভরিয়ে তুলল তাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস, ওয়াল, ব্লগ, ইনবক্স, ইউটিউব চ্যানেল ও অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যম। পোস্ট, রিপোস্ট, শেয়ার করল প্রয়োজনীয় সব গ্রুপে। ভাইবোনদের ডাকে সাড়া দিয়ে বদলে ফেলল প্রোফাইল ছবির রং। আমেরিকার অনেক শহরে বাঙালিদের সম্মিলিত আবেদন পাঠানো হলো তাদের লোকাল কংগ্রেস প্রতিনিধির কাছে। কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নয়; স্থান, কাল, বয়স নির্বিশেষে বাঙালিরা অনুভব করল একাত্মতা, ইন্টারনেট কালচারে একাত্মতা। অনুভব করল বাঙালিরা কতটা একত্রিত জাতি দেশের ভেতরে, দেশের বাইরে।
সবাই অবশ্য ফেসবুকে সমান সোচ্চার হলো না। বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল যে কিছু পোস্ট করা বা শেয়ার করা ঠিক হবে কি না। অনেকে ছিল ভয়ে শঙ্কিত যে সবকিছু যখন আবার আগের মতো হয়ে যাবে, তখন তো এসব পোস্টকে ট্র্যাক করা হবে। কে পোস্ট দিয়েছে, বের করা হবে। হয়তো এসব ভেবেই একদল ফেসবুকার একদম চুপ মেরে গেল। কেউ কেউ আবার ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে সরকারের পক্ষে সাফাই গাইতে লাগল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ তাদের বিন্দুমাত্র নড়াতে পারল না। নিরপরাধ ছেলেমেয়ে, শিশু-কিশোরের মৃত্যুতে তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো না। ঘটনা কোথায় গিয়ে ঠেকে এই অপেক্ষায় তারা বসে রইল। এই বাঙালিদের খামোশি, নীরবতা ও নির্লিপ্ততা দেখে খুব অবাক হলাম।
ইতিমধ্যে আমরা ছুটি শেষে বাড়িতে ফেরত এসেছি। জুলাই শেষ হতে আর কটা দিন বাকি। আমি প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত বাংলাদেশের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার বিবরণ পাচ্ছি, ছবি-ভিডিও দেখছি। আমি সব সময় এত অন্যমনস্ক ও মন খারাপ করে থাকতাম যে ছেলেরা একদিন জানতে চাইল, আম্মু তোমার কী হয়েছে। আমার দুই ছেলে জেন জি প্রজন্মের। ওদের চিন্তাধারা অনেক ভিন্ন, জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা ভিন্ন। ওরা পরিবর্তনে বিশ্বাসী, আর তা আনতে চায় সম্মিলিত বা দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে। ওরা রেভল্যুশনারি জেনারেশন, একজনের ডাকে হাজারো জন ছুটে আসে। ওরা বুক পেতে নিজের অধিকার আদায় করে। আবার বুক পেতে অন্যের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয়।
আমি আমার ছেলেদের বললাম, বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কথা। চেনালাম নাহিদ, আসিফ, সারজিস, হাসনাতের মতো সাহসী যোদ্ধাদের। বন্দুক, গুলি আর গ্রেনেড যাদের থামাতে অক্ষম। ওদেরকে জানালাম, আবু সাইদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, ইয়ামিন, রিয়ার কথা। বলতে বলতে আমার চোখ ভিজে উঠল। আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেরা বলল, আজকে যদি আমাদের বাংলাদেশে জন্ম হতো, আমরা যদি বাংলাদেশে থাকতাম, তাহলে তুমি নিশ্চয় আমাদের এই আন্দোলনে যেতে দিতে। আমি বললাম, আলবত দিতাম। তোমাদের পেছনে শক্তি হয়ে আমরাও যে শামিল হতাম। (চলবে)
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস।
 

কমেন্ট বক্স