আজ থেকে এক মাস আগে দেশের রাজপথে যখন মানুষ তাজা রক্ত ঢেলে দিচ্ছে, আমরা তখন প্রবাসে চরম উৎকণ্ঠায় রাত কাটাচ্ছিলাম। ফেসবুক পেজে একটার পর একটা স্ক্রল করছিলাম দেশের সঠিক খবর জানার জন্য। আগের রাতে ঘুমাইনি একই নেশায়। তবু যেন চোখে ঘুম নেই। মনের মধ্যে অজানা ভীতি! দেশ কি শেষ পর্যন্ত সিরিয়া-লেবানন-লিবিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে? বিশেষ করে, আগের দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের একটি কথা ছিল খুবই ইঙ্গিতময়। লাঠি কাজ না করলে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার ঘোষণা শুনেছিলাম নাহিদের কাছ থেকে। আন্দোলনকারীরা হাতে অস্ত্র তুলে নিলে গৃহযুদ্ধই অনিবার্য ছিল।
দেশকে এ রকম একটি অরাজক অবস্থা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তারা দেশের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার দিকে বন্দুক তাক না করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেন। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও পক্ষ নিলেন দেশবাসীর। ছাত্র-জনতা দখল করে নিল গণভবন। আমেরিকায় বসে ভোর রাতে বিভিন্ন পেজে লাইভ এই দৃশ্য দেখার অনুভূতি ছিল পরম আনন্দের, চরম তৃপ্তির। জীবনে এমন বিরল আনন্দের ক্ষণ আর আসবে বলে মনে হয় না। বাসার বেসমেন্টে বসে মানুষের আনন্দ-উল্লাস দেখছি আর স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের দিকে অদ্ভুত আনন্দে তাকাচ্ছি। এই সময় এক ভিডিওতে দেখলাম, ঢাকার রাজপথে এক যুবক ফোনে তার মাকে বলছে, আম্মা, আমরা জিতে গেছি। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এই তরুণের আবেগ দেখে আমাদের চোখেও আনন্দের অশ্রু চলে আসে।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন পেজ দুজনেই স্ক্রল করে যাচ্ছিলাম। যা দেখছি একে অন্যকে শেয়ার করছি। আনন্দ শেয়ারের জন্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত নেই। সন্তানেরা ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেশে এবং এখানে একে ওকে ফোন দিয়েও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি। এরই মধ্যে মন খারাপ করার মতো কিছু নিউজ মিডিয়ায় আসতে শুরু করল। আনন্দ উদ্্যাপনের সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ লুটপাট ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করছে বলে শোনা যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিজের বিবেকের দায় থেকে এ রকম কাজ না করার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম। এসব খবরে বিজয়ের আনন্দ কিছুটা ম্লান হলেও সকালবেলা (বাংলাদেশে রাত) বিছানায় গেলাম মনখুলে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে। গত কয়েক দিন মনে হয়েছিল ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। দেশবাসীও জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণখুলে শ্বাস নিচ্ছিল। তারপর সরকারবিহীন তিন দিন। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্ররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিল। ট্রাফিকের দায়িত্ব থেকে শুরু করে সবকিছুতে কাজ করতে হয়েছে ছাত্রদের। সরকারবিহীন প্রতিটি দিন জনগণের কাছে মনে হয়েছিল বছরের মতো। বহু প্রতীক্ষার পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস এসে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন। অন্য উপদেষ্টারাও শপথ নিলেন। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্র প্রতিনিধিও রাখা হলো। আমার কাছে মনে হয়েছিল, ছাত্ররা উপদেষ্টা পরিষদে না গিয়ে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করলেই ভালো হতো। কিন্তু ছাত্ররা প্রেশার গ্রুপ হিসেবে যেমন রাস্তায় থাকল, তেমনি সরকারেও দুজন প্রতিনিধি রাখল। রাজপথে থেকে ছাত্ররা দুটো প্রতিবিপ্লবের অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিল। প্রথমটি ছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের পক্ষ থেকে। আর দ্বিতীয়টি ছিল আনসার সদস্যদের পক্ষ থেকে। এখন তারা চোখকান খোলা রেখে রাস্তায় আছে। আগস্ট বিপ্লবের এক মাস পূর্তিতে ৫ সেপ্টেম্বর তারা ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি পালন করেছে।
এ ধরনের কর্মসূচি চলবে। প্রয়োজনে আবারও ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসবে। তবে খুব তাড়াতাড়ি তাদের আসল জায়গা ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে না দিলে তাদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি সক্রিয় করে তুলতে হবে, যাতে ছাত্রদের পুলিশিং করতে না হয়। পুলিশকে সাহায্যের প্রয়োজন হলে আবারও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গ্রাম সরকার চালু করতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পুলিশ পুরোপুরি সক্রিয় এবং আদালতকে সক্ষম করা ছাড়া দেশকে স্থিতিশীল করা যাবে না। যাকে তাকে আসামি করে মামলা করার হিড়িক থামিয়ে দিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুষ্কৃতকারীদের পদত্যাগ ও পদচ্যুতির জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে। ছাত্ররা গিয়ে কাউকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার চালু হওয়া রীতি বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভের অন্যতম একটি কারণ ছিল নিরপরাধ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি এবং রাজনৈতিক কারণে সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করা। ফ্যাসিস্টরা যা করেছে, বিপ্লবীরা তা করবে নাÑএটাই হোক বিপ্লবীদের নীতি।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন কোন সেক্টরে কী কী সংস্কার করতে চায়, তা অতিসত্বর দেশবাসীকে জানাতে হবে। সংস্কারের বিষয়ে জনমত যাচাই করতে হবে। আর এসব সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ থাকতে হবে। কোনো কাজই অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। কাজ শুরুর সময় শেষ করার একটি পরিকল্পনা থাকতে হয়Ñএটাই রোডম্যাপ। রোডম্যাপ অনুযায়ী সংস্কারকাজ শেষ না হলে মানুষ আরও সময় দেবে। কিন্তু আপনারা কী সংস্কার করবেন, কত দিনে করবেনÑএটা জানার অধিকার দেশবাসীর আছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সফল পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। সারা দুনিয়ার মানুষকে তিনি ‘তিন শূন্য’ বাস্তবায়নের মন্ত্র শিখিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নেও তিনি সফল হবেন। তাকে সফল হতেই হবে। এত রক্ত, এত মায়ের আহাজারি বৃথা যেতে পারে না। শত শত জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ দেশবাসীকে দিতেই হবে।
স্থিতি ও সংস্কারের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুভ হোক। দেশের বিপ্লবী মানুষ দেখতে চায় ফ্যাসিবাদের চিরস্থায়ী কবরের ওপর গণতন্ত্রের লাল গোলাপ। অবিস্মরণীয় আগস্ট বিপ্লবের এক মাস পূর্তিতে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার