৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। ৫ আগস্ট থেকেই ভারত-বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানান দেশের মানুষের কৌতূহল, কী হবে শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ। তিনি কি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেবেন? তিনি কি অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাবেন? বাংলাদেশ সরকার কি তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করবে বা করতে পারবে? এমনই হাজারো প্রশ্ন জনমনে। অনেকে অনেক রকম প্রেডিকশন করছেন। তাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, ট্রল হচ্ছে, টকশো হচ্ছে। ভারতের ঝানু রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও পিছিয়ে নেই। ভারতের জনগণেরও সীমাহীন কৌতূহল। সংবাদমাধ্যমগুলোর আগ্রহের কারণেই তাদেরকে নানা রকম সম্ভাবনার কথা বলতে হচ্ছে। ভারতের সরকারি, বিরোধী সকল দলের নেতাই শেখ হাসিনাকে ভারতের একজন পরম বন্ধু হিসেবে দেখছেন এবং তারা তার জন্য একটি নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করারই পক্ষে। কিন্তু কথা হচ্ছে ভারতে তাকে আশ্রয় দেওয়ার কিছু আইনানুগ সমস্যা আছে। শুনেছি ভারতের তেমন উপযুক্ত অভিবাসী আইন নেই, উদ্বাস্তু বা শরণার্থী হিসেবে রাখারও নাকি নিয়ম নেই। তাহলে তিনি থাকবেন কী করে? লাল পাসপোর্টে, মানে কূটনৈতিক পাসপোর্টে ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন থাকার বিধান আছে। তারপর? এদিকে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ইস্যুকৃত সকল লাল পাসপোর্ট বাতিল করেছে। ভারতের কংগ্রেস নেতা শশী থারুর বলেছেন, নিয়ম না থাকলেও তাকে রাখার একটা না একটা উপায় তো বের করাই যাবে। তিনি আমাদের একজন বন্ধু।
অনেকের মতো আমারও একটি প্রশ্ন, তাকে রাখার মতো অভিবাসী আইন যদি না থাকে, তাহলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কোন স্ট্যাটাসে শেখ হাসিনা ভারতে ছিলেন? ভ্রমণ ভিসা নবায়ন করে করে যদি অতীতে থেকে থাকেন, তাহলে এবারও তা করা যাবে। আমার তো সন্দেহ হয়, সেই ছয় বছর অবস্থানকালে তিনি ভারতের নাগরিকত্বই পেয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভারতে উড়ে গেলেন এবং ওখান থেকে ফোনে যে স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে দলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তার সেই কণ্ঠে তো স্বদেশে অবস্থানের আত্মবিশ্বাসই ধ্বনিত হচ্ছিল। হাসিনা ভারতের একজন পরম বন্ধু, পরম সুহৃদ, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই কিন্তু ভারত শেখ হাসিনার কতখানি খাঁটি বন্ধু, সে বিষয়ে অনায়াসেই সন্দেহ করা যায়। ভারতের সরকার এবং জনগণ দুই পক্ষই অন্ধ দেশপ্রেমিক, তারা দেশের জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। একটা শোনা গল্প বলি। প্রাচীন দার্শনিকেরা বলেছেন, খারাপ কথা শুনবে না, খারাপ কথা বলবে না এবং খারাপ দৃশ্য দেখবে না। তিনটি বানরের প্রতিকৃতি দিয়ে এই দর্শন প্রকাশ করতে আমরা প্রায়ই দেখি। একটি বানর দুই হাতে কান চেপে ধরে বধির হয়ে আছে, আরেকটি চোখ চেপে ধরে অন্ধ হয়ে আছে, অন্যটি নিজের মুখ চেপে ধরে বোবা হয়ে আছে। কাঠে খোদাই করা এই দার্শনিক প্রতিকৃতিটির প্রচলন শুরু হয় জাপানে, মধ্যযুগে, সেই সতেরো শতকে। এখন পৃথিবীর সর্বত্রই এটি দেখা যায়। শোনা গল্প হচ্ছে এর পরের অংশটুকু। মহাত্মা গান্ধী নাকি এই দর্শনের সঙ্গে আরও একটি বাক্য যোগ করেছেন, ‘যদি এর মধ্যে দেশের জন্য কোনো কল্যাণ থাকে, তাহলে করতে পারো।’ অর্থাৎ শুধু দেশের কল্যাণের জন্য খারাপ কথা শোনা যাবে, খারাপ জিনিস দেখা যাবে এবং খারাপ কথা বলা যাবে। এককথায় দেশের স্বার্থে যেকোনো মন্দ কাজ করা যাবে। আমার যারা ভারতীয় বন্ধু আছেন, যাদের সঙ্গে আমার আলাপ, পরিচয় আছে, তাদেরকে গান্ধীর এই দর্শন অনুসরণ করতে দেখেছি।
হাসিনাকে রাখলে যদি ভারতের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তারা কিছুতেই তাকে রাখবে না এ বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত। সরকার নমনীয় হলেও জনতার চাপে বাধ্য হবে তাকে দেশ থেকে বের করে দিতে, হয়তো সরকার এ জন্য বড়জোর কিছুটা কালক্ষেপণ করতে পারবে কিন্তু তাকে রাখতে পারবে না।
হাসিনার বিষয়ে তাহলে ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। একটি হচ্ছে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো, অন্যটি হচ্ছে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনা করে তার জন্য একটি নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। ভারতের জনগণ শেষ পর্যন্ত সরকারকে চাপ দেবে হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরের জন্য। এতে করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ও জনগণের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ভারতের ভয়ের একটা কারণ আছে। শেখ হাসিনাকে বিডিআর মিউটিনি, শাপলা চত্বরে হেফাজত নেতাকর্মীদের হত্যা, গণতন্ত্র হত্যা করে বিনা ভোটের, নৈশ ভোটের, ডামি ভোটের নির্বাচন করা, ২০২৪ এর জুলাইয়ে গণহত্যা করা ইত্যাদি বিষয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশে একটি পারসেপশন খুব প্রবলভাবে প্রতীয়মান যে এই ঘটনাগুলোর পেছনে ভারতের প্রত্যক্ষ ইন্ধন ছিল। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মানুষ যেমন চেনে, ভারতও চেনে। কথায় কথায় মিথ্যা বলা, অন্যকে ফাঁসিয়ে দেওয়া এসব তার জন্য ডালভাত। জেরার মুখে তিনি যে ভারতের ওপর সকল দায় চাপাতে চেষ্টা করবেন না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? যদি এ রকম ঘটনা ঘটে, তাহলে শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে না, সারা বিশ্বেই ভারতের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যাবে।
সুতরাং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা খুবই কম। ৭৫ বছর বয়সী শেখ হাসিনা এখন পৃথিবীর যেকোনো দেশের জন্যই এক বিরাট বোঝা। কোনো দেশই এই বোঝা নিজেদের কাঁধে নিতে চাইবে না। ভারতের পক্ষে তাকে অন্য কোনো দেশে পাঠানোও বেশ কঠিন হবে। তবে রাশিয়ান ব্লকের কোনো দেশ নিলে নিতেও পারে। এই দেশগুলোর নীতি-নৈতিকতা নিয়ে সারা পৃথিবীরই প্রশ্ন আছে। টাকা পেলে ওরা অনেক অনৈতিক, অমানবিক কাজও সানন্দে করে ফেলে। সাগরতলে বিকল হয়ে যাওয়া রাশিয়ান সাবমেরিনের বেঁচে থাকা ক্রুদের ওরা উদ্ধার করেনি এ-কারণে যে ওদের জীবনের যা মূল্য, তার চেয়ে উদ্ধারকাজে ব্যয় বেশি হবে বলে। শুধু রাশিয়ানরাই এভাবে চিন্তা করতে পারে। কাজেই প্রচুর টাকার বিনিময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো দেশে হাসিনার জন্য একটু জায়গা হলে হতেও পারে।
যদি তা শেষ পর্যন্ত জোগাড় করা না যায়, তাহলে ভারত কী করবে? এই বোঝা থেকে মুক্তির জন্য তারা কি নির্মম কোনো পথ বেছে নেবে? পৃথিবীতে এমন ঘটনা যে ঘটেনি তা তো নয়। রাজনৈতিক কারণে কত মৃত্যুকেই তো আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার এমন পরিণতি চায় না। বাংলাদেশের মানুষ চায় তিনি দেশে ফিরে আসুন এবং সকল অপকর্মের জন্য দেশের প্রচলিত আইনে অথবা আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থিত হয়ে আইনানুগ পন্থায় বিচারের মুখোমুখি হোন, যাতে বাংলাদেশে আর কখনো তার মতো এমন স্বৈরাচার সরকারের আবির্ভাব না ঘটে।