Thikana News
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আমস্টারডাম ঘুরে বেলজিয়াম

আমস্টারডাম ঘুরে বেলজিয়াম


অনেক বছর পর ঘুরতে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করতে লাগলাম। আমার হাজব্যান্ড ছয় বছর ধরে অসুস্থ। এ ছাড়া কোভিড মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। সবাই কোভিডের যন্ত্রণা পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস এল। আমিও ভাবলাম আগের মতো না হলেও অল্প দিনের জন্য তো বাইরে যাওয়া যায়! আমি প্রথমে গ্লোবাল জার্নি ট্যুর কোম্পানির মাধ্যমে বেড়াতে যেতাম। এখন তিনবার থেকে গেট ওয়ান দিয়ে বাইরে যাই।
এবার আমস্টারডাম-বেলজিয়াম হয়ে প্যারিসে এসে ট্যুর শেষ হলো। আমি যদিও ১৯৯৯ সালে প্যারিসে গিয়েছিলাম। সবকিছু খুব ভালোমতো দেখেছি। তখন বয়স কম ছিল। ট্রেন, বাস ও হেঁটে অনেক ঘুরেছি। মিউজিয়ামে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে ভেতরে গেছি। সবকিছু কত সহজ ছিল, এখন অনলাইনে টিকিট কাটতে হয় আগে থেকে।
যা হোক, আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে ডেল্টা প্লেনে সাত ঘণ্টা জার্নি করে নামলাম। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস সেরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। গেট ওয়ান থেকে আমাকে পিকআপ করবে-তাদের সঙ্গে এ রকম কথা আছে। যদি ওদের থেকে টিকিট কিনতাম, তবে এয়ারপোর্ট থেকে আনা-নেওয়া ফ্রি ছিল। যেহেতু নিজেরা টিকিট কিনেছি, তাই আনা-নেওয়ার জন্য আমাকে পে করতে হবে। ওরা বার্গার কিংয়ের সামনে মিটিং এলাকায় অপেক্ষা করবে। তাই আমি মিটিং এলাকায় যেতেই দুজনকে গেট ওয়ানের নাম লেখা কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে গেলাম। আমার নাম মিলিয়ে নিয়ে একজন আমাকে নিয়ে বাইরে ওদের গাড়িতে তুলে দিল। ড্রাইভার আমাকে হোটেল হিলটনে নিয়ে এল। আমি কাউন্টারে ফর্মালিটিস সেরে রুমের চাবি নিয়ে রুমে চলে এলাম। আমাদের জন্য সন্ধ্যা ছয়টায় ওরিয়েন্টেশন ও ডিনার রয়েছে। আলু খাদকের দেশ আমস্টারডামে এসে আমার খুব ভালো লাগছে। অনেক দিনের শখ ছিল এখানে ঘুরতে আসার। হাত-মুখ ধুয়ে এয়ারপোর্ট থেকে কিনে আনা খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিলাম।
দলে আমরা ৪২ জন। খুব ভালো লাগল কারও মুখে মাস্ক নেই দেখে। অবশেষে আমরা কোভিড সংকট কাটিয়ে উঠেছি। সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম। এখানে সবাই আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন স্টেট থেকে বেড়াতে এসেছে। পরের দিন সকাল সাড়ে আটটায় বাস ছাড়বে। বাস প্রথমে আমাদের শহরের সেন্টারে নিয়ে যাবে। আমরা গাইডের সঙ্গে হেঁটে ঘুরব, তারপর বোটে করে ক্যানলে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ঘুরব। ব্রিজ আর খালের শহর আমস্টারডাম, আর আছে বিপুল আর্ট গ্যালারির সমাহার।
অনেকে এই আমস্টারডাম শহরকে Vanice of the North বলে। অর্থাৎ এ শহর কিনা উত্তর ইউরোপের ভেনিস। Amstel নদীর পারে অবস্থিত বলে এ শহরের নাম আমস্টারডাম। ‘ডাম’ কথাটি এসেছে অ্যামস্টেল নদীতে দেওয়া বাঁধ থেকে। Amstel আর ডাম-এ দুটি শব্দ এক হয়ে শহরের নাম হয়েছে ‘আমস্টারডাম’।
ঐতিহাসিক আমস্টারডামে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এই ক্যানেলের টানে আসে এবং বোটে ঘুরে উপভোগ করে। ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, প্রায় ১৫০০ ছোট-বড় ব্রিজ এর ওপর দিয়ে গেছে। ক্যানেলটি শহরের হৃৎপিণ্ড হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে। দুই পাশের সব বিউটিফুল বাড়িঘর এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়িগুলোর ডিজাইন উজ্জ্বল, বহুলাংশ পেইন্ট করা, নকশা করা জানালা। সব মিলিয়ে ক্যানেলে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের পরোক্ষভাবে মোহিত করে থাকে। বাড়িগুলোর দাম এত বেশি যে, এখানে মানুষ একেকটি তলা বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনে মাত্র। দু-তিনজন মিলে একটি বাড়ির মালিক হয়। সেই রকম বাসা ভাড়াও অনেক বেশি।
ক্যানেলের দুই পাশে বাড়িঘর, রেস্টুরেন্ট ছাড়াও চার্চ, স্কুল, ফ্যাশন হাউস ষষ্ঠদশ শতাব্দীর এসব বিল্ডিংকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। বাড়ি যদি ক্যানেলের পাশে হয়, তবে তাদের কিছু বাড়তি আইন মেনে চলতে হয়। যেমন বাড়িগুলো সব সময় রং করা, বাইরে থেকে ফিটফাট রাখতে হবে।
ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ঐতিহ্য বহন করে এসব World Heritage অন্তর্ভুক্ত বিল্ডিংগুলো বিশেষ আইন মেনে চলে বাড়ির চাকচিক্য বজায় রাখে, যাতে করে পর্যটকদের মন ও চোখ আপ্লুত হয়। বাড়ির সৌন্দর্য, ডিজাইন, কারুকার্যÑসবকিছু মিলিয়ে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেন পর্যটকেরা মনোমুগ্ধকর শহরের বুকে বোট রাইডের সময় মন্ত্রমুগ্ধ হন। ক্যানেলের পাশের বাড়িগুলো রিপিয়ার করা অনেক সমস্যা। সরকারি পর্যায়ে পারমিশনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তারপর সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী রিপিয়ার করা যায়। নয়তো জরিমানাও গুনতে হতে পারে। তাই ক্যানেলের দু’ধারের বাড়িগুলো আইনের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। অতি সাধারণ ছোট্ট একটি বাড়ি বাইরের ডেকোরেশনের জন্য দৃষ্টিনন্দন রূপ ধারণ করে।
বাড়িগুলো থেকে মাল নামানো-ওঠানোর জন্য জানানায় বা ছাদে একটি বাড়তি কাঠের সঙ্গে হুক লাগানো আছে। তার সাহায্যে হুকের ভেতর দিয়ে দড়ি ঢুকিয়ে নিচের মালামাল ওপরে তোলা হয়। তেমনি ওপরের মাল নিচে নামানো হয় অতি সহজেই। অনেক বাড়ি ওপরতলায় স্টোরেজ ভাড়া দেয়, তারাও সারাক্ষণ এভাবে মালামাল ওঠানো ও নামানো করে। এ কারণে অনেক বাড়ির জানালা বেশ বড়। আসলে যেমন অবস্থা তেমন ব্যবস্থা।
আমরা যখন বোটে ঘুরছি, আমাদের অনেক ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রায় ১৬০০ ব্রিজ আছে এ ক্যানেলের ওপর। গাইডের কথা শুনতে শুনতে আমরা চলছি। বোট থেকে দু’পাশের বাড়িগুলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছি। ছবি তুলছি। ব্রিজ থেকে অনেকে আমাদের হাত দিয়ে নাড়ছে, আমরাও তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছি। প্রায় দুই ঘণ্টা আমাদের এ রকম আনন্দে কাটল।
আমরা যখন গাইডের সঙ্গে হাঁটি, তিনি তখন বাইসাইকেল থেকে আমাদের সাবধান থাকতে বলেন। শহরটি আসলে সাইকেলের শহর।
ছোট্ট শহর। ১০ লাখেরও বেশি সাইকেল। পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য যন্ত্রচালিত যান বাদ দিয়ে চলাচলের কাজে সাইকেল চালায় মানুষ। শহরের লোকসংখ্যা যত, সাইকেলের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। বাইসাইকেল সবখানে। যদিও বাইকের জন্য ভিন্ন পথ আছে। রাস্তা ক্রস করার সময় সতর্ক না হলে অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার শঙ্কা থাকে। তবে বাইক চালকেরাও খুব সাবধানে চালায়। হাঁটার সময় সাইকেলের ভয় কাজ করেছে। এত বেশি বাইক যে চিন্তাও করা যায় না। আমার একদম স্বাচ্ছন্দ্য লাগেনি হেঁটে।
নানা রকম বাইক আছে। বাচ্চা বহন করার জন্য ডাবল বাইক, মাল বহনের জন্য সাইকেলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে চাকাওয়ালা শপিং ট্রাক। এ ছাড়া বাস্কেট, দু’পাশে মোটা ক্যানভাস কাপড় বা চামড়ার ব্যাগ ঝুলিয়ে নেয় মানুষ। এটিই ওদের জীবন। আমরা এসবে অভ্যস্ত নই বলে আমাদের কাছে সমস্যা মনে হয়েছে।
এই সুন্দর একটি শহরে ম্যারিয়ানা খুব সহজেই যে কেউ কিনতে পারে। আইনগতভাবে এখানে ম্যারিয়ানা নিষিদ্ধ নয়। এখন অবশ্য নিউইয়র্কেও খোলামেলা দোকানে বিক্রি ও ধূমপান করা যায়। ১৮ বছরের বেশি বয়স হতে হবে এবং আইডিও দেখাতে হবে। পাঁচ গ্রামের বেশি একসঙ্গে কেনা যাবে না। সর্বনিম্ন এক গ্রাম কেনা যায়, যার দাম হবে ১১ ইউরো।
আমরা একটি রাস্তায় দেখতে পেলাম ভিন্ন দৃশ্য! জানালা খোলা, ভেতরে মানুষ দেখা যাচ্ছে। তবে ঘরগুলোতে লালবাতি জ্বালানো, মেয়েদের গায়ে স্বল্পভূষণ। গাইড বলল, এখানে প্রস্টিটিউশন বেশ খোলামেলা। বাড়ির চেহারা দেখলেই বোঝা যায় ভেতরে কী চলছে বা চলে। আমি তো বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলাম! শহরের মাঝখানে প্রস্টিটিউশন, ভাবাই যায় না! ম্যারিয়ানার খবর আমি জানতাম, তবে এই দেহব্যবসা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ঘরে উজ্জ্বল লাল আলো দিয়েই মানুষ বুঝতে পারে, এখানে কাদের যাতায়াত।
বিকেলে রয়েছে আমাদের অপশনাল ট্যুর, সেই সঙ্গে আছে ডিনার। প্রথমে আমরা যাব মাছের গ্রাম দেখতে। এটি একটি পুরোনো জুইডারজি (Old ZUIDERZEE) এলাকায়। নদীর ধারে বলে এখানকার মানুষেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক মাছধরার শিপ তীরে ভিড়ে আছে। কোনো কোনো শিপ মাঝনদীতে মাছ ধরতে ব্যস্ত। এখানে প্রচুর রেস্টুরেন্ট। নদীর ধারে হেঁটে গেলে রেস্টুরেন্টগুলো থেকে মাছ রান্নার খোশবু আপনাকে পাগল করে তুলবে! আজ রাতে আমাদের নৈশভোজ এখানকার একটি স্থানীয় রেস্টুরেন্টে হবে। এখানে রাস্তার ধারে কয়েকটি ব্রাসের (Brass) তৈরি মূর্তি দেখলাম। একজন মহিলা দাঁড়ানো, কিছুদূরে আরেকটি মূর্তি-কোমরে ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। সেই ঝুড়িতে অনেক ছোট মাছ, মাছ বিক্রেতা আর কি! আমি একটি ছবি তুললাম। সামনে নেদারল্যান্ডসের উত্তর-পশ্চিমে নর্থ সি ছিল, যা নাকি লম্বায় ৬০ মাইল, চওড়ায় ৩০ মাইল। এ নদীকে ঘিরে এখানে যেমন রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে, তেমনি শপিং এরিয়াও গড়ে উঠেছে। স্যুভেনিরের দোকান দেখে না গিয়ে পারা যায় না। দামে একটু সস্তাই মনে হলো।
আমরা গাইড ও ড্রাইভারকে নিয়ে দলে মোট ৪৪ জন ছিলাম। সবারই অনেক সুস্বাদু নৈশভোজ হয়েছে এই মাছের গ্রামে, যা আমার অনেক দিন মনে থাকবে। আমি ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে পরে সেই রকম রান্না করার চেষ্টা করেছি, তবে ওরা একটা সস ব্যবহার করেছে, তার অভাবে আমার রান্না ওদের মতো সুস্বাদু হয়নি। যদিও আমি চায়নিজ মাছের দোকান থেকে একটি সস কিনে এনেছিলাম।
গাড়ি আমাদের নিয়ে ছুটল কাঠের জুতা তৈরির (Clog Maker) ফ্যাক্টরিতে। আমরা যখন কারখানায় ঢুকলাম, কাঠের একধরনের গন্ধ নাকে এসে লাগল। হাতে তৈরি বলে একত্রে অনেক মানুষের যৌথ কাজ করতে দেখার সুযোগ পেলাম। ক্লগ মেকাররা জুতা তৈরি করে পরিশেষে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। এদের অনেককে এই জুতা পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। আমার কাছে এ জুতা খুব একটা আরামদায়ক বলে মনে হলো না। ছোটবেলায় অনেককে খড়ম পরতে দেখেছি, অনেকটা সে রকম। তবে এটি জুতা। ওদের ঐতিহ্যবাহী কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে তারা সাধারণত পরে থাকে। এই কাঠের জুতা খনি ও ক্ষেতে যারা কাজ করে, তারা নাকি পরে থাকে। আমরা যখন উইন্ড মিলে গেছি, সেখানে যে ভদ্রলোক আমাদের সব বুঝিয়ে বলছিলেন, তিনি এ জুতা পরিহিত ছিলেন। সাদা লিনভেন নামে একধরনের কাঠ, যা নাকি নরম ও হালকা, তা দিয়ে তৈরি হয় এ জুতা।আমরা এরপর চিজ ফ্যাক্টরিতে গেলাম। কেমন করে দুধ থেকে ওরা চিজ তৈরি করে, তা দেখার জন্য। প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের চিজ চারদিকে, নাম-দাম লিখে সাজিয়ে রেখেছে। তার সামনে ছোট্ট বাটিতে টেস্ট করার জন্য রাখা আছে। আমাদের সবাই টেস্ট করে চিজ কেনাকাটা করল। আমি চিজ কিনলাম না, কারণ আমরা ঘরে লবণ কম খাই বলে চিজ, পিৎজা আমার কাছে লবণাক্ত লাগে এবং জিহ্বার টেস্ট নষ্ট হয়ে যায়। একমাত্র এ কারণে চিজ খুব পছন্দ করলেও খাওয়া এড়িয়ে যাই। লবণ হাই ব্লাড প্রেশার বাড়িয়ে দেয় আমার।এবার আমাদের বাস চলল উইন্ড মিল দেখাতে। উইন্ড মিল ঘড়ির মতো তার চারটি ব্লেড নিয়ে ঘোরে। জমিতে পানি দেওয়া, ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন ও ক্ষেতের ফসল তোলার কাজেও ব্যবহার করা হয়। আমরা যেটি দেখতে গিয়েছিলাম, তা বহু পুরোনো দিনের, বাতাসের মাধ্যমে এটি ঘোরে। সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য মানুষ রয়েছে। প্রায় ৫০টি সিঁড়ি বেয়ে প্রয়োজনে তাদের ছাদে যেতে হয়। আমাদের দলের অনেকে ছাদে উঠেছে, তাদের কথায় বোঝা গেল, ওরা ছাদ থেকে শহরের সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করেছে।আমস্টারডামে হোটেলের চেয়ে হোস্টেল বেশি জনপ্রিয়। বিশেষ করে, ছেলেরা অল্প টাকা দিয়ে শুধু বেড ও একটি লকার পায়। নিজেদের তালা লকারে লাগাতে হয়। তিন-চারজন মানুষ একটি রুমে শেয়ার করে থাকে।এখানে অনেক মিউজিয়াম আছে। ভ্যান গঘ, অ্যানি ফ্রাঙ্ক মিউজিয়াম, রেমব্রান্ট মিউজিয়াম তার মধ্যে অন্যতম। আগে অনায়াসে টিকিট কেটে মিউজিয়ামে যাওয়া যেত, কিন্তু এখন আগে থেকে অনলাইনে টিকিট বুক করা লাগে। আমি ট্যুর কোম্পানির পাঠানো কাগজপত্রে বুঝতে পারলাম, ওরা সব মিউজিয়ামে নেবে না, শুধু ভ্যান গঘ ও রেমব্রান্ট মিউজিয়ামে নিয়ে যাবে।আমার খুব ইচ্ছে অ্যানি ফ্রাঙ্কের বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু সেটা দেখার সময় আর আমার হবে না। তাই আমি একদিন একটু সুযোগ পেয়ে ট্যাক্সিতে গেলাম। বাইরে থেকে দেখে ছবি তুলে আবার ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। আমি বুঝতে পারলাম, যাওয়ার সময় ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে বেশ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ফেয়ার বাড়িয়ে তবে গন্তব্যে নিয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি এবং ওকে তা বলি যে আমি ঠিকই বুঝেছি। আমি অনেকবার থামতে বলি, আমি নেমে যাব, কেননা এত দূর হওয়ার কথা নয়। তখন ও বুঝতে পারে আমাকে আর ঘোরানো যাবে না, তখন দুই মিনিট চালিয়ে বলল-এই যে এখানে! তার মানে সে মিউজিয়ামের কাছেই ঘোরাঘুরি করেছে!অ্যানি ফ্রাঙ্ক ১৯২৯ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কারণে তার পিতা-মাতা তাদের দুই বোনকে নিয়ে আমস্টারডামে চলে আসেন। যখন তারা বুঝতে পারলেন, এ বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ নয়, তখন তারা তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় খুব গোপনে থাকতে লাগলেন। নাৎসি বাহিনী কোনোভাবে খোঁজ পেলে ওদের ধরে নিয়ে যায় বেলসেন ক্যাম্পে। তার বাবা তাকে এক জন্মদিনে একটি ডায়েরি গিফট করেন, যাতে সে যুদ্ধের সবকিছু লিখে রাখে। সেই ডায়েরি তাদের পরিচিত ফ্যামিলি ঘরের ফ্লোরে পেয়ে রেখে দেয়। তারা আশা করে, ওরা একদিন ফিরে আসবে, তখন তাদের কাছে ডায়েরিটি ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যুদ্ধ থামার সপ্তাহখানেক আগে তার বোনসহ অ্যানি ফ্রাঙ্ক মারা যায়। ওর বাবা দীর্ঘজীবী হন। তিনি ১৯৮০ সালে মারা যান। বাবাকে তার পরিচিত ফ্যামিলিটি ডায়েরিটি ফেরত দেয়। তিনি সেটি বই আকারে প্রকাশ করেন।মাত্র ১৫ বছর বয়সী মেয়ের লেখা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে। তারা যে একটি ঘরে লুকিয়ে ছিল, কোনো শব্দ করা, জোরে কথা বলা, হাঁচি-কাশি দেওয়া যাবে না, রেডিও শোনা যাবে না, অল্প আলোতে রাতে তাদের ওখানে লুকাতে হয়েছিল! এত মানুষ কীভাবে কষ্ট করেছিল। মাঝেমধ্যে অল্প সাউন্ড দিয়ে রেডিও শুনত। ওর বাবা সব সময় অ্যানিকে বোঝাতেন। বয়স কম, তাই সবকিছু মেনে নিতে কষ্ট হতো। একটি ঘরে একদম বন্দী জীবনযাপন করা, কত দিন-তাও কেউ জানে না।আমি অ্যানি মিউজিয়ামের ভেতরে যাওয়ার টিকিট আগে থেকে অনলাইনে বুক করিনি। কেননা আমরা বেশি দিন থাকিনি। বাইরে লোকারণ্য, আমি বাড়িটির চারপাশে ঘুরেফিরে কিছু ছবি তুলি। ওদের বাড়িতে এখন মিউজিয়াম করা হয়েছে। অ্যানির ব্যবহৃত জিনিসপত্র, হাতের লেখা, ওর অনেক ছবি দেয়ালে লাগানো হয়েছে। ডায়েরির পাতাগুলো ফটোকপি করে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। তার একটি আর্টিস্টিক মন ছিল। সে যেখানে যায় তার ফটো, শখের কিছু, সুন্দর কিছু জিনিস দেয়ালে লাগিয়ে থাকে। এই যে বন্দিজীবন কাটাল, সেখানেও প্রথম দিনই সে তিন-চারটি ছবি পিন দিয়ে দেয়ালে আটকাতে ভোলেনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালের মার্চের কোনো একদিনে বেলসেন ক্যাম্পে (Belsen Camp) মৃত্যুবরণ করে। ছোট্ট একটি মেয়ে, তার সামনে সারাটি জীবন পড়ে ছিল, কোনো দোষ সে করেনি। সে ইহুদি, তাই তাকে মরতে হলো!
তার বাবা ১৯৮০ সালে মারা গেলেও পরিবারের সবাইকে হারিয়ে সে এক দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ৩৫টি বছর বেঁচে ছিলেন। আসল মৃত্যু তো তার তখনই হয়েছিল, যখন তার প্রাণপ্রিয় দুই কন্যা ও স্ত্রী মারা যায়।
পরিশেষে বলতে হয়, অ্যানি ফ্রাঙ্কের বইটি ছিল ‘A powerful reminder of the holocaust’s horror.’
পরদিন আমরা গেলাম ভ্যান গঘ মিউজিয়াম দেখতে। গাইড আমাদের সবার টিকিট আগেই বুক করে রেখেছিল। আর বিকেলে যাব রেমব্রান্ট মিউজিয়ামে।
ভ্যান গঘ মিউজিয়ামের মূল বিল্ডিংয়ের বাইরের দেয়ালের বিরাট অংশজুড়ে শোভা পাচ্ছে ভ্যান গঘের শ্রেষ্ঠ দুটি শিল্পকর্ম। একটি তার নিজের পোর্ট্রেট, আর অন্যটি সানফ্লাওয়ার। তবে কোনোটিই অরিজিনাল নয়। দুটিই রেপ্লিকা, অর্থাৎ এ শিল্পীর কাজের সঙ্গে বাইরে থেকেই পর্যটকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ দেয়ালজুড়ে এঁকে রেখেছে দুটি বিশাল পেইন্টিং। বুদ্ধি খারাপ নয়! ভ্যান গঘ ছিলেন সেল্ফ পোর্ট্রেট আঁকার মাস্টার। এটি একদিক দিয়ে ভালো এ জন্য যে, তিনি দেখতে কেমন ছিলেন-আমাদের কোনো ধারণাই থাকত না।
ভ্যান গঘের শিল্পীজীবন মাত্র ১০ বছরের। এরই মধ্যে তার যা শিল্পকর্ম। প্রতিবছর ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) পর্যটক আসে মিউজিয়ামে তার শিল্পকর্ম দেখতে। যে পরিমাণ ছবি তিনি এঁকেছেন, তার চেয়ে বেশি তিনি নষ্ট করে দিয়েছেন। আজ ভ্যান গঘ সারা বিশ্বে কিংবদন্তি।
গাইডের কাছে ভ্যান গঘের অরিজিনাল ও মাস্টার পিস ছবিগুলো কোন রুমে আছে, এ খোঁজটা জানতে চাইলে দোতলায় যেতে বলল। এখানে দেখলাম সানফ্লাওয়ার, পটেটো ইটার, গমের ক্ষেত, তার নিজের ছবি, The Starry Nigh। মিউজিয়ামে আমি বেশ কয়েকটি সানফ্লাওয়ার দেখলাম। তার ছবিতে হলুদ ও নীলের ছড়াছড়ি। তার বাড়ির ছবি হলুদ রং দিয়ে, একে নাম দিয়েছেন হলুদ বাড়ি। আমি শেষে যে গ্যালারিতে ঢুকেছি, এটিতে ঢুকেই বোঝা গেল, ভ্যান গঘ যে হলুদ রঙের প্রেমে আটকে গেছেন। The Starry Night-এও ভ্যান গঘ আকাশে হলুদ রঙের বিন্যাস দেখিয়েছেন। শিল্পী নিজেই বলতেন, হলুদ মানেই সূর্য। আর হলুদ রং ছিল আশা ও ঈশ^রের ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। গম ক্ষেত শিল্পীর প্রিয় ছিল।
তার আরেকটি ছবি ‘গম ক্ষেতে কাক উড়ছে’ ছবিতে খারাপ সংকেত দিয়েছেন। কাকের উপস্থিতিকে অমঙ্গলের প্রতীক বুঝিয়েছেন।
হলুদ রং তার ওপর প্রভাব ফেললেও তার জীবনের ওপর কতটা ফেলেছে, কে জানে! ভ্যান গঘের পোর্ট্রেটগুলো নানা পোজে, নানা অভিব্যক্তিতে আঁকা। এমনকি তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজয়, প্রেমে ব্যর্থতা, আর্থিক অসচ্ছলতা, রাগে-দুঃখে একদিন নিজের কান নিজেই কেটে ফেলেন! তার কানকাটা একটি পোর্ট্রেটও আছে। নানা রঙের টুপি পরিহিত অবস্থায় ভ্যান গঘের বেশ কয়েকটি পোর্ট্রেট আছে। তবে অনেকেই নিজের ছবি এঁকেছেন তার আগে। এ ক্ষেত্রে ডাচ শিল্পী রেমব্রান্টের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
ভ্যান গঘের বিষণ্নতা, নিস্তেজ, আসাদ, অন্তর্বেদনার ছবি দেখতে দেখতে নিজের মনও দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। ভ্যান গঘ জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া একজন শিল্পী। একটি ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে যান রিভলবার হাতে। রিভলবারের গুলিতে নিজের বুক নিজেই বিদীর্ণ করে দেন শিল্পী। ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস, জীবিত অবস্থায় ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ শিল্পী হিসেবে কোনো গুরুত্ব পাননি। আজ তার আঁকা প্রতিটি ছবির দাম মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। সেই মানুষটি জীবিত অবস্থায় একটি রুটি কেনার জন্য ছবি নিয়ে আর্ট শপে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু কেউ তার ছবি কিনত না। জীবিত অবস্থায় ভ্যান গঘ তার আঁকা মাত্র একটি ছবি বিক্রি করতে পেরেছিলেন। শিল্পী বেঁচে থাকেন তার শিল্পের মাধ্যমে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম মিউজিয়াম থেকে। মিউজিয়ামের ভেতরে গিফট শপ থেকে হাতে পরার দুটি বালা কিনেছি। একটিতে সানফ্লাওয়ার প্রিন্ট, অন্যটি তার Almond Blossom ছবির প্রিন্ট।
আমরা সময়ের অভাবে এক দিনে দুটি মিউজিয়াম দেখার টিকিট বুক করেছি। তাই সকালে ভ্যান গঘ মিউজিয়াম দেখার পর এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো লাঞ্চের জন্য।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হলো রেমব্রান্ট মিউজিয়াম। আমার ভ্রমণ সম্পূর্ণ হতো না, যদি আমি মিউজিয়ামগুলোতে না যেতাম।
শিল্পী রেমব্রান্ট আমস্টারডাম শহরে এক এবং অদ্বিতীয়। ডাচদের কাছে রেমব্রান্ট নমস্য এবং দেবতাতুল্য। The Night Watch-এর রেপ্লিকা মিউজিয়ামের কাছে চত্বরে রাখা আছে। এই The Night Watch রেমব্রান্টকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পেইটিংগুলোর মধ্যে এটি একটি। রেমব্রান্ট ইতিহাসের একজন কৃতী পুরুষ এবং ডাচ শিল্পীদের শিরোমণি। অনেকের মতে, রেমব্রান্ট পৃথিবীর প্রথম আধুনিক পেইন্টার। তার হাত ধরে পৃথিবীতে চিত্রশিল্পে প্রথম আধুনিক ধ্যান-ধারণার সূচনা হয়েছে। ডাচ স্বর্ণযুগের সেরা শিল্পী রেমব্রান্ট। এককথায় বলা যায়, নেদারল্যান্ডসে রেমব্রান্টকে দেবতাতুল্য জ্ঞানে সম্মান করে।
মিউজিয়ামটি ছিল রেমব্রান্টের বসবাসের বাড়ি। এই সাধারণ বাড়িটিতে তিনি প্রায় ১৭ বছর বসবাস করেছেন। তার জীবনের সব মাস্টারপিসের সূতিকাগার এ বাড়ি। তাই নেদারল্যান্ডসবাসীর কাছে এ বাড়িটি মন্দিরতুল্য।
রেমব্রান্ট একজন পেইটিং ব্যবসায়ী ছিলেন। নিজের পেইন্টিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্যদের আঁকা ছবিও এ স্টুডিও থেকে বিক্রি করতেন। যেমন শিক্ষক পিটার লাস্টম্যান, তার ছাত্র ফার্দিন্যাল্ট বোল প্রমুখ স্বনামধন্য শিল্পীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
ভিন্ন এক পদ্ধতিতে ছবি আঁকতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তা হলো এচিং। রেমব্রান্টের শিল্পীজীবনে যতগুলো এচিং তৈরি করেছেন, তার বেশির ভাগই সংগৃহীত আছে এ বাড়িতে। ২৫০টি এচিং শিল্পকর্মের এক অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে রেমব্রান্টের এ বাড়িতে।
আমরা এ বাড়িতে তার আঁকা বেশ কয়েকটি সেল্ফ পোর্ট্রেট দেখলাম বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে। মানুষের মাথা আঁকতে রেমব্রান্ট ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শুধু মাথা আঁকাকে বলে Tronies। বেশ কয়েকটি ট্রনিস আছে তার বাড়িতে। তিনি মানুষের মাথা নিয়ে গবেষণা করেই মানুষের মুখাবয়বে নানা অভিব্যক্তিতে মুখের আদল, চাহনি কেমন হয়-তা খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। গাল, চাহনি, ঠোঁটের অভিব্যক্তি, মুখের ওপর হাসি বা রাগ ধরে রেখে ছবির অর্থ ভিন্নতর হবে-তার ওপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবে মুখাবয়বের ছবি আঁকেন তিনি।
মিউজিয়ামটি খুব বড় পরিসরে ছিল না। তবে যা ছিল, তা যথেষ্ট মূল্য রাখে শিল্পপ্রিয় মানুষদের কাছে। মহাশিল্পীর তুলির স্পর্শে অপরূপ সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে একেকটি শিল্পকর্ম। রঙের এত সমারোহ, এত বৈচিত্র্য প্রাণবন্ত করে রেখেছে মিউজিয়ামটিকে।
এত অল্প সময়েও যে মিউজিয়ামে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাই আমরা খুবই আনন্দিত।

 

কমেন্ট বক্স