Thikana News
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিদেশের মাটিতে কোরবানি ঈদ

বিদেশের মাটিতে কোরবানি ঈদ


প্রথম যেবার বলেছিলাম ‘ঈদ’ সম্পর্কে, আমার দুই ছেলে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল। ওদের বয়স তখন খুব কম, খুব ছোট ছিল ওরা। অবাক বিস্ময়ে সেদিন ওরা জেনেছিল, ক্লাসের অন্য বন্ধুদের মতো ক্রিস্টমাস নয়, আমরা ঈদ উদ্্যাপন করি। আবার একটা নয়, আমাদের দুইটা ঈদ-রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদ। প্রতিবছর দুটি ঈদ আসে, দুই মাস দশ দিনের ব্যবধানে। তবে ইংরেজি বছরের কোন মাসে ঈদ হবে, সেটা নির্ভর করে লুনার ক্যালেন্ডার বা চাঁদ পঞ্জিকার ওপর। এভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের ঈদ শিক্ষা।
আমরা যারা প্রথম জেনারেশন বাঙালি বিদেশের মাটিতে স্থায়ী নিবাস গেড়েছি এবং ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে বড় করছি, তারা সব সময়ই একধরনের শঙ্কায় ভুগি, অনিশ্চয়তায় ভুগি। আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি, রীতিনীতি, বাংলা ভাষা, ধর্মীয় উৎসব আর নিয়মকানুন কতটুকু দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চাদের মধ্যে দিতে পারব, শেখাতে পারব। আবার খালি শেখানো, বোঝানো হয়ে গেলেই যে শেষ, তা নয়। এগুলো রীতিমতো পালন করতে দেখাও ওদের জন্য জরুরি। নিয়মিত দেখার পরও ওরা সেগুলো বড় হয়ে ওদের নিজের জীবনে কতটুকু পালন করবে, তাও ভাবার বিষয়। যে দেশে ওরা জন্মায়নি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়নি, ধর্মীয় উৎসব উদ্্যাপনের আমেজঘন পরিবেশে দিন কাটায়নি, হাজার হাজার মাইল দূরের সেই দেশের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করা আমাদের বাচ্চাদের জন্য সত্যিই কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার।
তার পরও আমরা বিদেশে বসে প্রথম প্রজন্মের অভিভাবকেরা চেষ্টা করে যাই। ছেলেমেয়েদের শেখাই ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা সম্পর্কে। বাংলাদেশে আমরা এই দুটো ঈদকে ডাকি রোজার ঈদ ও কোরবানি ঈদ। রোজার ঈদ সংযম আর সাধনার ঈদ। কোরবানি ঈদ ত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ঈদ। কোরবানি ঈদের শুরু কোথা থেকে এবং কেন পালন করা হয়, সেই গল্পটা আমার ছেলেদের অনেকবার বলেছি।
আমাদের প্রিয় নবী ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাঁর সবচাইতে প্রিয় মানুষ, তাঁর আপন সন্তানকে আল্লাহর নামে কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিল ওনার ইমানের পরীক্ষা। কোরবানি দেওয়ার মুহূর্তে ওই জায়গায় সন্তানের পরিবর্তে আল্লাহর নির্দেশে একটি পশু পাঠানো হয়। সেই পশু কোরবানি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন এবং সেই থেকে সমগ্র মুসলমান জাতির জন্য নাজিল করা হয় কোরবানির আদেশ। আল্লাহর নামে কোনো হালাল পশু জবাই করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভই হলো কোরবানি ঈদের মূল তাৎপর্য। এই গল্পটি আমরা ছোটবেলা থেকেই পিতামাতা, দাদি-নানির মুখ থেকে শুনি, স্কুলের ইসলামিয়াত শিক্ষার পাঠ্যবইয়ে পড়ি। সর্বোপরি মুসলমান দেশে বেড়ে ওঠা আর প্রতিবছর দেশজুড়ে ঈদ উৎসব উদ্্যাপন করার মাধ্যমে ঈদ ঢুকে যায় আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ঈদ হয়ে যায় আমাদের আত্মার আত্মীয়।
বহুদিন আগে ফেলে আসা শৈশব, কৈশোরের ঈদস্মৃতি খুব মনে পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় গরু-ছাগল কেনার হিড়িক দেখে যেমন আনন্দ পেয়েছি, তেমনি কোরবানির দিন সকালবেলা পশু জবাই করার কষ্ট দেখে আহত হয়েছি। আবার দিনের শেষে মায়ের হাতের রান্না মাংসের রকমারি আইটেম উপভোগ করেছি। সেই সঙ্গে থাকত নতুন জামা, জুতো পরার নির্মল আনন্দ। ঈদের দিবসটি ছিল ত্যাগ আর ভালোবাসায় ভরা ঝলমলে একটি দিন। সারাটা দিন কারণে-অকারণে মনটা খুশিতে ভরে থাকত। ঈদের অনুভূতিটাকে মনে হতো সব পরিচিত অনুভূতি থেকে একদম আলাদা।
আমার পরের প্রজন্মের কাছে যখন গল্প বলি, যখন সেই আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করি, তখন মনে হয়, ওরা কি কোনো দিন বুঝবে, কোনো দিন উপলব্ধি করবে সেই আনন্দ। বিদেশের মাটিতে কাটানো ঈদে তেমন সুযোগ আমার ছেলেদের হয় না। পশু কোরবানি আর হজের গুরুত্বের কথা আমাদের মুখ থেকে শুনলেও কোরবানি দেখার সরাসরি অভিজ্ঞতা কখনো তাদের হয় না। তাই গত বছর আমরা ঠিক করেছিলাম সরাসরি ছেলেদের নিয়ে ফার্মে যাব আর আদ্যোপান্ত পশু কোরবানির প্রক্রিয়ায় শামিল হব।
গত বছর পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে আমরা সাতটি বাঙালি পরিবার একসঙ্গে কোরবানিতে অংশ নিয়েছিলাম। অস্টিন শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ দূরে একটি ফার্মে আমরা জমায়েত হয়েছিলাম, যেখানে বিভিন্ন রং ও সাইজের গরু, ছাগল, ভেড়া সব ধরনের প্রাণী ছিল। আগের থেকে বাছাই করে পছন্দ করে রাখা একটি মাঝারি আকৃতির কালো রঙের গরু আমাদের সাতটি পরিবারের সম্মতিক্রমে আল্লাহর নামে জবাই করা হয়। আমেরিকার ফার্মগুলোতে একটু ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পশুর প্রাণ হরণ করা হয়, যাতে তাদের কষ্ট কম হয়। প্রথমে পশুটির মাথা লক্ষ্য করে একটি ট্রানকুইলাইজার গুলি করা হয়। এতে পশুটি হেলে গিয়ে যেই পড়ে যেতে থাকে, ঠিক সেই সময়ই তাকে জবাই করা হয়। আমাদের গরুটিকেও একইভাবে জবাই করা হয়েছিল।
তারপর একটি বুলডোজারের মাধ্যমে মৃত গরুটিকে ঝুলিয়ে তার চামড়া ছেলা হয়। এরপর গরুটিকে বড় বড় কয়েকটি ভাগে টুকরা করা হয়। এরপর আমরা সাত পরিবারের সবাই মিলে বসে যাই যার যার বাড়ি থেকে আনা ছুরি, বঁটি, কাঁচি নিয়ে এবং সেই বড় বড় টুকরাগুলোকে কেটে আমরা ছোট ছোট পিস করি। তারপর টুকরা করা সব মাংস একত্র করে ওজন করে সাত ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও এই মাংস কাটার অভিযানে শামিল হয় এবং সমস্ত ব্যাপারটা নিজের হাতে করার অনাবিল আনন্দ লাভ করে। যেহেতু ঈদের দিন আমাদের সারা দিন ফার্মে থাকতে হয়, তাই আমরা সাত পরিবার বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার রান্না করে নিয়ে যাই। খিচুড়ি, মুরগির মাংস, ডিম ভুনা, সেমাই, হালুয়া দিয়ে আমরা সবাই মিলে দারুণ ঈদ বনভোজন করি। আর ঈদের একাত্মতায় শামিল হই।
বলাই বাহুল্য, আমার ছেলেরা ওই দিন মহা উৎসাহে আমাদের মাংস কাটতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে তারা উপলব্ধি করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কেন প্রত্যেক মুসলমান ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় এবং আল্লাহর নামে একটি জান কোরবানি দেয়। তারা আরও দেখে আমাদের কোরবানির মাংস সমান তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ আমরা গরিব-দুঃখীদের জন্য মসজিদে দান করি। সেবারের কোরবানি ঈদ ছিল ছেলেদের জন্য দারুণ শিক্ষণীয় এবং আমাদের পরিবারের জন্য পরিপূর্ণতায় ভরা। আমরা নিজের হাতে কোরবানি দিয়েছি, মাংস কেটেছি। ছেলেরা সশরীরে অংশ নিয়ে এই ত্যাগের উৎসবে যোগদান করেছে। ভবিষ্যতে তারা নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদ্্যাপন করবে। কোরবানির এই গল্প শোনাবে তাদের সন্তানদের। বাবা-মা হিসেবে আমাদের জন্য এটি একটি পরম পাওয়া। সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা।
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস।

কমেন্ট বক্স