Thikana News
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিশ্ব মুসলিমের স্মৃতিতে অম্লান পবিত্র ঈদুল আজহা

বিশ্ব মুসলিমের স্মৃতিতে অম্লান পবিত্র ঈদুল আজহা


অনস্বীকার্য যে আরব-অনারব, মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান তথা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)। মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় জাতীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অন্যতম আদি পিতা হজরত ইবরাহিমের (আ.) অদ্বিতীয় ত্যাগ স্বীকারের পুণ্য স্মৃতি। তাই বর্ষপরিক্রমায় এবারও হজরত ইবরাহিমের (আ.) ত্যাগের আদর্শে উদ্দীপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিসহ সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান আগামী ১৬ জুন রোববার পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার অপরিসীম রহমত লাভের আশায় তারা হজরত ইবরাহিমের (আ.) অনুকরণে এবং অনুসরণে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে নিজেদের মরচে ধরা ইমান-আকিদাকে নতুনভাবে শাণিত করবেন ইনশা আল্লাহ। তদুপরি নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থে খরিদ করা পশুর গলায় ছোরা চালনাকালে বিশ^ মুসলিম কায়মনোবাক্যে উচ্চারণ করবেন : হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির খাতিরে আমরা যেভাবে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে তেমনিভাবে নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হব না। আর নবতিপর শ্মশ্রুমণ্ডিত হজরত ইবরাহিমের (আ.) অনন্য আত্মাহুতির দীক্ষায় অনুপ্রাণিত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মুসলমানরাও একমাত্র বিশ্বপ্রতিপালকের সন্তুষ্টি বিধানার্থেই পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপন এবং কোরবানি আদায় করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন বলে জানা যায়।
বিশ্ববাসীর শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পৌত্তলিকতার মূলোচ্ছেদ এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পৌত্তলিক আজরের গৃহে জন্ম নেওয়া ইবরাহিম (আ.) সারা জীবন নিরতিশয় নির্যাতন এবং চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধাচারী হওয়ায় নিতান্ত কৈশোরে ইবরাহিম (আ.) কৈশোরে স্বগৃহ ও স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। যৌবনে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করতে গিয়ে প্রবল প্রতাপান্বিত খোদাদ্রোহী বাদশাহ নমরুদ কর্তৃক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ হজরত ইবরাহিম (আ.) জীবনসায়াহ্নে আল্লাহর স্বপ্নাদেশ পালন করতে গিয়ে নিজের অন্ধের যষ্টি পুত্র ইসমাইলের গলায় শাণিত ছোরা চালিয়ে ইমানী অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অবশ্য জীবনের প্রতিটি স্তরে এবং পর্যায়ে পরম করুণাময়ের প্রতি অকৃত্রিম ও নিখুঁত বিশ^াস ও ভালোবাসার কারণে ইবরাহিম (আ.) সকল চরম অগ্নিপরীক্ষা সাফল্যের সঙ্গে উতরে পরিশেষে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। আর হজরত ইবরাহিমের (আ.) সেই অবিস্মরণীয় ত্যাগের প্রতি অবিচল আস্থা ও প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিবেদনার্থেই আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতরা বর্তমানে প্রতিবছর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঈদুল আজহার সালাত শেষে কোরবানি দিয়ে থাকেন। স্মর্তব্য, শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হিসেবে আর্থিকভাবে সচ্ছল মুসলমানদের ক্ষেত্রে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা পশু কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। আর অসচ্ছল ও হতদরিদ্র মুসলমানরা যেন ঈদুল আজহা ও কোরবানির পশুর মাংস থেকে বঞ্চিত না হন, সে জন্য কোরবানির পশুর মাংসের অংশবিশেষ গরিব-দুঃখী এবং আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বণ্টনের ধর্মীয় তাগিদ রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থিক সংগতির সঙ্গে ধর্মীয় আবেগের সংমিশ্রণে কষ্টার্জিত হালাল অর্থে কেনা মোটাতাজা পশুর গলায় ছুরি চালনাকালে কোরবানিদাতারা বরাবরের মতো এবারও হৃদয় নিংড়ানো ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করবেন : হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির খাতিরে যেভাবে আমরা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে তদ্রƒপ নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করতে ও আত্মাহুতি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হব না।
যাহোক, প্রায় ৩৮ সহস্রাধিক মুক্তিকামী-বাস্তুহারা ফিলিস্তিনির তাজা রক্তে রঞ্জিত গাজা উপত্যকা, দখলদার রাশিয়ার গোলার আঘাতে ও নির্মম হাহাকারে ভারাক্রান্ত ইউক্রেনের আকাশ-বাতাস, বিশ^জুড়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দৈত্য-দানবের প্রলয় কাণ্ড, সংসার ভাঙার প্রবণতা, সামাজিক বিভেদ-বৈষম্য-বিভক্তি ও প্রতিহিংসার দাবানলে প্রজ্জ্বলিত বিশ^চরাচর এবং মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কালযাপন করছেন বিশে^র প্রায় ৬০০ কোটি জনতা। এমনতর অবিচার ও বর্বরতার অগ্নিসিন্ধুকে বুকে চাপা দিয়েই বিশে^র অগণিত নিরীহ-নির্যাতিত-শোষিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মুসলমানরাও যথারীতি পবিত্র ঈদুল আজহা এবং কোরবানির ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিচ্ছেন। বিশ্বের সিংহভাগ মুসলমানই একমাত্র আল্লাহর অপরিসীম রহমত লাভ এবং যাবতীয় বর্বরতার মূলোচ্ছেদ কামনায় পবিত্র ঈদুল আজহা এবং কোরবানি শেষে বিশ্বপ্রতিপালকের দরবারে করজোড়ে মিনতি জানাবেন। আমরা আবেগ উদ্বেলিত ও অশ্রুসজল কণ্ঠে সানুনয় মিনতি জানাচ্ছি : হে রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাদের যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করো, আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করো, পরচর্চা-হিংসা-বিদ্বেষ-পশুত্ববোধের পাপরাশি থেকে আমাদের মুক্তি দাও এবং মনুষ্যত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ববোধের আলোকে আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়কে আলোকিত করো। মূলত ইসলামি মূল্যবোধ ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ এবং মানবকল্যাণে জীবন উৎসর্গ, ঐহিক ও পারত্রিক রহমত লাভের শাশ্বত আবেদন এবং হজরত ইবরাহিমের (আ.) অনুপম আত্মত্যাগে উদ্বেলিত হয়েই আমরা এবারও ১০ জিলহজ মুসলমানদের দ্বিতীয় জাতীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্্যাপনে আশা রাখছি, ইনশা আল্লাহ।
যাহোক, মনুষ্যরূপী হায়েনা এবং দানবের একচ্ছত্র আধিপত্যের বর্তমান বিশ্বে নির্যাতিত-নিগৃহীত ও অবহেলিত মুসলমানদের নিকট পবিত্র ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে অতীতকে ভুলে যাওয়া, পরস্পরকে ক্ষমা করে দেওয়া, হৃদয়ের পাশবিক প্রবৃত্তিরাজির কোরবানি, জীবনাচরণে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়াও দানবীয় শক্তির সমূল উৎপাটনের মিনতি জানাচ্ছি বিশ^বিধাতার দরবারে। তাই ঈদুল আজহার সালাত, খুতবা ও মোনাজাত শেষে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আমরা অতীতের যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ-মনোমালিন্য ভুলে গিয়ে পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরব। আর পবিত্র ঈদের সুমহান দীক্ষা সারা বছর ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলনে নতুনভাবে ওয়াদাবদ্ধ হব, ইনশা আল্লাহ।
পবিত্র ঈদুল আজহা : আকাশ-আড়াল করা হর্মে বসবাসকারী থেকে জীর্ণ কুটিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ঈদুল আজহার আগমন ঘটে বিশ^প্রতিপালকের অফুরন্ত রহমত লাভ এবং বর্ষীয়ান নবী ইবরাহিম খলিলুল্লাহর সুমহান আত্মত্যাগের মর্মবাণী ও পার্থিব আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বার্তা নিয়ে। তবে বিরহ-ব্যথা, হাসি-আনন্দে ভরপুর এই বিশ^চরাচরে প্রতিটি ঈদেই স্বজনহারাদের শোক নতুনভাবে উথলে ওঠে। অবশ্য আমাদের মনে রাখা উচিত, অবিমিশ্র আনন্দ এই মাটির পৃথিবীতে পাওয়া যায় না। তিক্ততার স্বাদ আছে বলেই তো আনন্দ এত মধুর। তাই বিরহ-বেদনার অন্তর্জ্বালাকে বুকে চেপে ধরে এবং মহান আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেই প্রতিবছরের মতো এবারও ইবরাহিমি ত্যাগ-তিতিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে পবিত্র ঈদুল আজহাকে হাসিমুখে বরণ করা আমাদের ইমানি দায়িত্ব। বিশ^ মুসলিমের শাশ^ত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, কুল্লু নাফসীন জায়িকাতুল মাউত (প্রত্যেক মানুষকে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে) এবং আলহামদুলিল্লাহে আলা’ কুল্লে হালীন (প্রত্যেক অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করো)। তাই মুসলমান হিসেবে আমরা যাবতীয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আলহামদু লিল্লাহ উচ্চারণ করে শুকরিয়া আদায় করব এবং সামগ্রিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন উচ্চারণ করে আল্লাহর অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করব ইনশা আল্লাহ।
প্রেক্ষাপট : আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত ঈদের শাব্দিক অর্থ আনন্দ বা উৎসব। আরব-অনারব, শে^তাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, বর্ণ-গোত্র-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে ঈদের দিবসটি বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় খুশি বা আনন্দের দিন। এ বিশেষ দিবসে ধনী মুসলমানদের সুরম্য হর্ম থেকে হতদরিদ্র মুসলমানদের চালাঘরেও আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। অনবদ্য কারণে ঈদের দিবসকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাতীয় আনন্দ দিবস অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উৎসবের দিন রয়েছে। আর আমাদের উৎসব হচ্ছে ঈদ (বুখারি ও মুসলিম)। জিলহজ মাসের দশম তারিখে গোটা বিশে^র মুসলিম জনতা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে এবং নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী নানা আয়োজনে ঈদুল আজহা উদ্যাপন করে থাকেন। পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে পলিতকেশ শ্মশ্রুমণ্ডিত হজরত ইবরাহিমের (আ.) অন্ধের যষ্টি পুত্র ইসমাইলের (আ.) গলায় ছুরি চালিয়ে বিশ্ববিধাতার স্বপ্নাদেশ পালনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। একমাত্র মহান আল্লাহর নির্দেশেই নবতিপর বৃদ্ধ হজরত ইবরাহিম (আ.) সদ্যোজাত পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) এবং স্ত্রী বিবি হাজেরাকে জনমানবশূন্য ঊষর মক্কায় নির্বাসিত করেছিলেন। আবার স্বপ্নযোগে কোরবানির আদেশ লাভের পর উপর্যুপরি ৩ দিনে ৩০০ দুম্বা বা উট কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ হলেন। অবশেষে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কোরবানির প্রশ্নে আল্লাহপ্রেমে মশগুল নবতিপর ইবরাহিম (আ.) নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি দেওয়ার চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। জাগতিক যাবতীয় স্নেহ-বাৎসল্য, আশা-আকাক্সক্ষা, কামনা-বাসনাকে আল্লাহ সন্তুষ্টির খাতিরে সর্ব কোরবানি দিয়ে বিশ^ মুসলিমের অন্যতম পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আত্মত্যাগের যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, মানবসভ্যতার ইতিহাসে তার প্রমাণ দ্বিতীয়টি মিলবে না। আবার বিশ^বিধাতার স্বপ্নাদেশ কার্যকরের পূর্বে পুত্রবৎসল পিতা ইবরাহিম (আ.) কিশোর পুত্র ইসমাইলের (আ.) সম্মতিও যথারীতি নিয়েছিলেন। অতঃপর চক্ষু মুদ্রিত ন্যুব্জদেহ কুব্জপৃষ্ঠ ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নামে হাত-পা বাঁধা পুত্র ইসমাইলের (আ.) গলদেশে শাণিত ছুরি চালালেন। কিন্তু মহান আল্লাহর অদৃশ্য ইঙ্গিতে কিশোর ইসমাইল (আ.) এর জায়গায় একটি স্বর্গীয় দুম্বা জবাই হয়ে গেল এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) চরম আত্মত্যাগের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খলিলুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত হলেন। যুগপৎ আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে বিনা বাক্যব্যয়ে একাত্মতা প্রকাশকারী শিশু ইসমাইলও (আ.) শাণিত কৃপাণের তলদেশ থেকে অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেলেন এবং জবি উল্লাহ খেতাবে সম্মানিত হলেন। সেই অদ্বিতীয় আত্মোৎসর্গে উদ্বেলিত মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর পশু কোরবানির মাধ্যমে নতুনভাবে ওয়াদাবদ্ধ হন : হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির খাতিরে যেভাবে আমরা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে তেমনিভাবে আমরা নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হব না। স্মর্তব্য, ইবরাহিমি কোরবানি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পূর্বে হজরত আদমের (আ.) পুত্র কাবিল নিজের পরমা সুন্দরী ভগ্নি আকলিমাকে এবং অপর পুত্র হাবিলও আকলিমাকে বিয়ে করার প্রশ্নে কোরবানি দিয়েছিলেন। কিন্তু হাবিলের কোরবানি গৃহীত হওয়ায় ক্রোধান্বিত কাবিল গোবেচারা হাবিলকে খুন করে সৃষ্টির ইতিহাসে সর্বপ্রথম মানুষ খুনের অধ্যায় সংযোজিত করেছিল। যাহোক, বর্তমানে বিশ^ মুসলিম হজরত ইবরাহিমের (আ.) অনুসরণেই প্রতিবছর ১০ জিলহজ পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল প্রত্যেক মুসলমানের ওপর কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। কষ্টার্জিত হালাল অর্থে যথাসাধ্য মোটাতাজা পশু একাগ্রচিত্তে কোরবানির মাধ্যমে বিশ^ মুসলিম ধর্মীয় নির্দেশ পালন করে থাকেন এবং ইমান ও তাকওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন।
কোরবানি প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট সেগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (২২ হজ : ৩৭)। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায় (তিরমিজি)। হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরও বলেছেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশম বা লোমের জন্য একটি করে সওয়াব পাওয়া যায় (ইবনে মাজাহ)। তাই বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে ক্ষমতার প্রভাব, টাকার চাকচিক্য কিংবা অনর্থক বিত্তশালী জাহির করার জন্য নয়, বরং নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী কষ্টার্জিত হালাল অর্থে কেনা উত্তম পশু কোরবানি করাই উত্তম। কোরবানির পশু কেনার অছিলায় টাকার বাহাদুরি জাহির ধর্মীয় দৃষ্টিতে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কারণ পবিত্র কোরআনের ভাষায় : অপচয়কারী শয়তানের ভাই।
প্রসঙ্গ ঈদুল আজহার সালাত : ঈদুল আজহার ওয়াজিব দুটি। মসজিদ বা ঈদগাহে সমবেত হয়ে ঈদের দুই রাকাত সালাত আদায় করা এবং কোরবানি করা। সুন্নতের মধ্যে রয়েছে : গোসল করা, খোশবু লাগানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরিধান করা, কোরবানির পর পশুর গোশত দিয়ে কিছু খাওয়া, ঈদগাহ বা ময়দানে গিয়ে সালাত আদায় করা, ঈদগাহে যাওয়ার সময় জোরে জোরে তাকবির উচ্চারণ করা এবং সম্ভব হলে এক পথে ঈদগাহে গমন করা এবং ভিন্ন পথে নিজ নিজ বাসস্থানে প্রত্যাবর্তন করা। আমির-ফকির নির্বিশেষে একই কাতারে দাঁড়িয়ে সকল মুসলমান অতিরিক্ত ৬ আবার মাজহাব ভেদে ৯ তাকবিরের সঙ্গে ঈদের দুই রাকাত সালাত আদায় করে থাকেন। সালাতের নিয়ত জানা না থাকলে মনে মনে কেবলামুখী হয়ে ইমামের পেছনে অতিরিক্ত ৬/৯ তাকবিরের সঙ্গে আমি ঈদুল আজহার সালাত আদায় করছি উচ্চারণ করলেই চলবে। সালাত শেষে ইমাম মহোদয় অতীব সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দিয়ে থাকেন। একাগ্রচিত্তে ও অভিন্ন মনোযোগসহকারে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। পরিশেষে সমগ্র বিশ^বাসী, বিশেষত বহুধাবিভক্ত মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হয় এবং পারস্পরিক উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে উপস্থিত সবাই ঈদগাহ বা মসজিদ ত্যাগ করেন। এরপর কোরবানিদাতারা কোরবানির আয়োজনে এবং শিশু-কিশোরেরা ঈদ আনন্দে ব্যস্ত-বিভোর হয়ে ওঠে। লক্ষণীয়, জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর (উত্তর আমেরিকা ও আশপাশের স্টেটগুলোর ক্ষেত্রে মঙ্গল/বুধবার) থেকে ১৩ তারিখ (শনি/রোববার) আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ সালাতের পর তাকবিরে তাশরিফ পড়া ওয়াজিব। জামাতে নামাজ আদায় করলে তাকবির আদায়ে ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। অবশ্য কোনো কারণে তাকবির পড়তে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়ামাত্রই তা পড়তে হবে।
তাকবিরে তাশরিফ : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবারু আল্লাহু আকবারু ওয়া লিল্লাহিল হামদু। আবার জিলহজ মাসের ১ থেকে ৯ তারিখের দিন-রাতের গুরুত্বও অপরিসীম। যথাসাধ্য রোজা রাখা এবং ইবাদত-বন্দেগিতে এই মহামূল্যবান সময় কাটানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সর্বোপরি কোরবানিদাতাদের উচিত জিলহজ মাসের ১ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে হাতের নখ, চুল-দাড়ি ইত্যাদি না কাটা। শ্রুতিকটু শোনালেও বস্তুত সজ্ঞান উপেক্ষা কিংবা ব্যক্তিগত ইগোর কারণে ঈদুল আজহার অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগও আমাদের অন্তরে কিংবা ব্যক্তিগত আচরণে কাক্সিক্ষত আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বছরের পর বছর পশু কোরবানি দেওয়ার পরও আমরা হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশস্থিত পাশবিক প্রবৃত্তিকে কোরবানি দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে আমাদের মনুষ্যত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ও পাশবিক প্রবৃত্তির সমূল উৎপাটন ঘটছে না বিধায় জগৎজুড়ে হানাহানি-রক্তারক্তি অব্যাহত রয়েছে। তাই মুসলিম বিশ^সহ সমগ্র পৃথিবী থেকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ-হানাহানি, অবৈধ দখলদারিত্ব, অন্যায়-অবিচার ও মাৎস্যন্যায় দশার ইতি ঘটাতে হলে এবার আমাদেরকে নতুনভাবে পবিত্র ঈদুল আজহার আত্মত্যাগকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অনুশীলন করতে হবে। হে রাব্বুল আলামিন, পবিত্র কোরআনের ২৪তম অধ্যায়ের মক্কায় অবতীর্ণ সুরা যুমার ৫৩ নং আয়াতে তুমি বলেছ : লা তাকনাতুম্ মির-রাহমাতিল্লাহে, ইন্নাল্লাহা ইয়াগফেরুজ যুনুবা, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিম (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপরাধীদের অপরাধ মার্জনাকারী; বাস্তবিকই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু)। পবিত্র কোরআনের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ প্যারার সুরা ইউসুফের ৮৭ নং আয়াতে তুমি আরও বলেছ : লা তাইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে, ইন্নাহু লা ইয়াইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে ইন্নাল কাওমুল কা’ফেরুন [আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় মহান আল্লাহর রহমত থেকে শুধু সে সকল লোকই নিরাশ হয়, যারা কাফের।] তাই পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিশ^ মুসলিমকে হে মহান স্রষ্টা, তুমি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর অছিলায় ক্ষমা করে দাও; যাবতীয় আসমানি-জমিনি বালা-মছিবতের সর্বগ্রাসী থাবা থেকে তুমি পরিত্রাণ দাও।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঠিকানার পক্ষ থেকে প্রয়াতদের আত্মার মাগফিরাত এবং স্বজনহারাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। সর্বোপরি পাঠক, শ্রদ্ধাভাজন কবি-সাহিত্যিক-লেখক এবং সদাশয় বিজ্ঞাপনদাতা ও অকৃত্রিম শুভানুধ্যায়ীদের জানাচ্ছি পবিত্র ঈদুল আজহার উষ্ণ শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
১১ জুন ২০২৪

কমেন্ট বক্স