সব মানুষই চায় স্বাধীনভাবে কথা বলতে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে। বর্তমান দুনিয়ায় এর চেয়ে বড় চাওয়া মানুষের বুঝি আর কিছু নেই। গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত এটাই, মানুষের মুক্তমত, মুক্তচিন্তা, মুক্তভাবে লেখার পরিবেশ থাকবে। মুক্তচিন্তা বিকাশের সুযোগ যে সমাজে, যে রাষ্ট্রে নেই, সেই সমাজ-রাষ্ট্রে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বিকশিত হয় না। হতে পারে না। বদ্ধ জলাশয়ের মতো বদ্ধ নদী শুকিয়ে যায়। নদীর বৈশিষ্ট্য বহমান। সভ্যতার বিকাশ ঘটে না বন্ধ সমাজে। মুক্তচিন্তা, মুক্তমত প্রকাশের পরিবেশ না থাকলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে অনেক সরকারই আর গণতান্ত্রিক থাকতে পারে না। এমনকি গণবিপ্লব করেও অনেক সরকার সেই আদর্শ ধরে রাখতে পারে না। ইতিহাসে এমন নজির ভুরি ভুরি। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতের বর্তমান অবস্থাকে আর গণতান্ত্রিক বলে স্বীকার করা যায় না। এমনকি জার্মানির পরিস্থিতি তেমনটাই। হিটলার গণমানুষের মুক্তির কথা বলে জনগণকে শ্বাসরুদ্ধকর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উপহার দিয়ে লাখ লাখ জার্মানকে গ্যাস চেম্বারে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে।
গণতন্ত্রের চিরশত্রু স্বৈরতন্ত্র। রাজতন্ত্র, সমরতন্ত্র গণতন্ত্রের বিপরীত শব্দ। রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র কখনো মানুষের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার অনুমোদন করে না। স্বৈরতন্ত্র মানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে নেয়। কিছু শাসনব্যবস্থা আছে, কিছু শাসক আছে, নিজেদের মর্জি ছাড়া অন্য আর কারও সামান্য স্বাধীনতাও সহনীয় নয় তাদের কাছে। অন্যের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে নিজেরাই কেবল কথা বলছে। নিজেরা ছাড়া অন্য কেউ কোনো কিছু সম্পর্কে নিজেদের মত দিতে পারবে না। স্বৈরশাসক যারা হয়, তারা নিজেদের সব মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে। তারা যা বলবে, তা-ই স্বতঃসিদ্ধ। তার ওপর আর কারও কোনো কথা চলবে না।
একনায়ক পরিচালিত দেশের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ভীতি। সমগ্র দেশের মানুষের ভয়ের মধ্যে বসবাস। সে ভয় তাদের সব রিপুকে গ্রাস করে নেবে। শুকনো পাতা পড়ার শব্দেও সে দেশের মানুষ চমকে ওঠে। সামান্য বাতাসের শব্দেও ভয় পায়। মিনিটে মিনিটে তটস্থ হয়ে ওঠে। ঘরের মধ্যে থেকেও ভয় পায়-এই বুঝি অকারণে স্বৈরশাসকের পাইক-পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে যাবে, তারা আর ফিরে আসার সুযোগ পাবে না। তাই তারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে, দেয়ালেরও কান আছে। কোনো স্বৈরশাসক বা একনায়কের রাজত্বে জবাবদিহিতা থাকবে না শাসককুলের। থাকবে না কোনো বিরোধী মত, বিরোধী দল। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রে জবাবদিহি থাকে না শাসককুলের কোনো সদস্যের। তারা বিচারের ঊর্ধ্বে।
পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল অনেক দেশের আত্মপ্রকাশ বা জন্ম নানাভাবে হয়েছে। জন্ম হয় নানা অঙ্গীকারে। স্বাধীনতার জন্য জীবন দিলেও, স্বাধীনতার ইশতেহারে ঘোষিত একেকটা অঙ্গীকারে আকৃষ্ট হয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নেয়। যেমন উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে আনা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন নেতৃ তৃদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাগুলো ছিল-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দেন, তাদের প্রত্যেকের আকর্ষণ এক ছিল না। কেউ ভেবেছিল দেশ স্বাধীন হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটবে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সে রকম কারও ভাবনায় হয়তো ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কারও স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, কারও হয়নি। অনেকেই আবার মনে করেন, শত কিছুর মধ্যেও দেশের উন্নয়ন হয়েছে আকাশচুম্বী। অনেকেই আবার ভাবেন, আরও অনেক কিছু হতে পারত, শাসক দলের মধ্যে যদি দুর্নীতি না থাকত। আর এই দুর্নীতির কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। সে কারণে গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তি পাচ্ছে না। তাই মুক্তচিন্তা এবং বাকস্বাধীনতাও নাগরিক প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।