Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

দেশে আগুনে এত মৃত্যুর দায় কার?

দেশে আগুনে এত মৃত্যুর দায় কার?
পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর এবার রাজধানীর অগ্নি-ট্র্যাজেডির খাতায় যুক্ত হলো বেইলি রোড। গত ১৪ বছরে ঘটে যাওয়া এই চারটি ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৮ জনের। অন্যদিকে মগবাজারে ভবনে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ১২ জনের। এ ছাড়া বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বড় অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর প্রতিবার আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আশ্বাস দেওয়া হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু দৃশ্যপটে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না।
২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে ছড়ানো আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে আগুনে প্রাণ হারান ৭১ জন। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জন প্রাণ হারান। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে ৪৬ জন মারা যান। এসব অগ্নিকাণ্ডের পাশাপাশি ঢাকাসহ সারা দেশে আরও অনেক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বেইলি রোডের দগদগে ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ৪ মার্চ সোমবার বিকেল চার-টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা এলাকায় এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের সাতটি স্টেশনের ১৪টি ইউনিটের ১৫০ জন সদস্য আগুন নেভাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে না পারায় ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও (এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত) আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই আগুনে হতাহতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও দেড় লাখ টন চিনির কাঁচামাল পুড়ে গেছে, যা আসন্ন রোজার জন্য আমদানি করা হয়েছিল।
ভোজনরসিকদের কাছে অতিপরিচিত রাজধানীর বেইলি রোড। ভিন্ন ভিন্ন খাবারের স্বাদ নিতে সকাল থেকে ভিড় দেখা যেত এই রোডের হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ছিল লিপ ইয়ার। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেকেই হাজির হয়েছিলেন সেখানে। লিপ ইয়ার ছাড়াও সপ্তাহের শেষ দিন এবং পরের দুদিন ছুটি-এমন এক অবসরে অনেকে প্রিয়জনদের নিয়ে, কেউবা একা গিয়েছিলেন বেইলি রোডের সাত তলা গ্রিন কোজি কটেজের ছয় তলায় অবস্থিত কয়েকটি রেস্টুরেন্টে ভোজন করতে। কিন্তু কে জানত, তাদের এ ভোজনই জীবনের শেষ ভোজন। সেদিনের হঠাৎ আগুন একে একে নিভিয়ে দেয় ৪৬ প্রাণ। সবাই যখন খাবার টেবিলে আনন্দ-উৎসবে গল্পগুজব করছেন, ঠিক তখনই, রাত ১০টার দিকে, ভবনের দোতলায় একটি রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে। শুরু হয় ছোটাছুটি। একটি মাত্র সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পদদলিত হন অনেকে। দ্রুতই আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য তলায়। পুরো ভবনে অপরিকল্পিতভাবে থাকা সিলিন্ডারের কারণে আগুন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। আর তাতেই কেউ পুড়ে, কেউ তীব্র ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এবং কেউ প্রাণভয়ে দৌড়াতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। পরে অবশ্য ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে আটকে পড়া অন্তত ৭৫ জন প্রাণে রক্ষা পান। মৃতের তালিকায় আছেন সাংবাদিক, বুয়েট শিক্ষার্থীসহ নারী-শিশু ও এক আওয়ামী লীগ নেতা। এই আগুন নিমেষেই আশা-স্বপ্ন-সাধ শেষ করে দিয়েছে কোনো বাবা-মায়ের কিংবা কোনো সন্তানের।
উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটার পরও ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর টনক নড়ছে না। দেশে গত ১৪ বছরে অগ্নিকাণ্ডে ২৬৮ জনের মৃত্যু ছাড়াও আহত হয়েছেন ১২ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অগ্নিনির্বাপণে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা তথা আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের মতো মর্মান্তিক ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। প্রশ্ন হলো, আগুন থেকে বাঁচার জন্য মানুষের আকুতি আমাদের আর কত শুনতে হবে? আর কত তাজা প্রাণ পুড়ে ছাই হলে কর্তৃ পক্ষগুলোর টনক নড়বে?
রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নানা বাহারি খাবারের দোকান। কোথাও কোথাও তো ভবনজুড়েই স্থান করে নিয়েছে একাধিক রেস্তোরা। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, ভবন তো বটেই, অধিকাংশ রেস্তোরাঁতেই নেই যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। শুধু অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন, ভোক্তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে কমার্শিয়াল স্পেসের যেসব নিয়ম পালনের কথা, অধিকাংশ ভবন মালিক জেনেবুঝেই তা মানেন না। দিনের পর দিন রাজউকসহ কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এসব ভবনে অবৈধভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। রেস্তোরাঁগুলোয় যত্রতত্র রাখা থাকে যাচাই- বাছাইহীন গ্যাস সিলিন্ডার। আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে কেমিক্যাল মজুদ করে রাখাও বন্ধ হয়নি। নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতায় রাজধানী এখন রীতিমতো অগ্নিকুণ্ডের ওপর বসে আছে। অভিযোগ আছে, যাদের এসব দেখার কথা, তারাই জনবলের অভাবের নামে উৎকোচের বিনিময়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার আইনের কিছু দুর্বলতাও বিদ্যমান। বলা হচ্ছে, আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে অনিয়মে বেড়ে ওঠা ঢাকার ৯৫ শতাংশের বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। কোনো বাসযোগ্য শহরে এমনটা রয়েছে চলতে পারে না। পৃথিবীর বহুদেশে বহুতল ভবনে মাঝেমধ্যেই সাইরেন বাজিয়ে পরীক্ষা করা হয় ভবনটিতে আগুন লাগলে সেখানে যারা অবস্থান করেন, তারা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন কি না। এটা স্রেফ পরীক্ষামূলক একটি মহড়া। রাজধানী ঢাকা শহরে এন্তার বহুতল ভবন রয়েছে, কিন্তু এ ধরনের মহড়ার কথা শোনা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, এসব ভবনে আগুন লাগলেও সাইরেন বাজিয়ে কোনো লাভ হবে না, কারণ ভবন থেকে বেরোনোর জরুরি নির্গমন পথই নেই। বেইলি রোডের যে ভবনটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সে ভবনে দোকান ও রেস্টুরেন্টের কোনো অনুমোদন ছিল না বলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক কেন এ কথা বলছে? জানা থাকা সত্ত্বেও অগ্নিকাণ্ডের আগে রাজউক কেন ব্যবস্থা নেয়নি? একটি ভবনজুড়ে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে দিনের পর দিন এতগুলো রেস্টুরেন্ট অনুমোদন ছাড়াই চলবে, এটা কীভাবে সম্ভব? এটাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ছাড়া কী বলা যায়। একে নিছক দুর্ঘটনা বলার উপায় নেই। প্রশ্ন হলো, আগুনে এত মৃত্যুর দায় কার? আমরা মনে করি, এর দায়দায়িত্ব শুধু ভবন মালিক নয়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপরও বর্তায়। ঢাকা শহরে যানবাহন নিরাপদ নয়; ভবন, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন পার্ক-কিছুই নিরাপদ নয়। শৃঙ্খলাহীনতা, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার বেপরোয়া মনোভাবের কারণে নিয়মিত কত প্রাণ যায়, কত কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু দায়িত্বহীনতার অবসান হয় না। বেইলি রোডে আগুনে মৃত্যু দেশের সকল মানুষকে বিষাদগ্রস্ত করেছে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভবনের অব্যবস্থাপনা ও অগ্নিনিরাপত্তা না থাকায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক ও ক্ষুব্ধতা প্রকাশের সয়লাব বয়ে গেছে। বিষয়টি দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও গুরুত্ব পেয়েছে। নাড়া দিয়েছে প্রবাসীদেরও। সবার পক্ষ থেকেই শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা হচ্ছে। এর বেশি সাধারণ মানুষের কিছু করার থাকে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের করার থাকলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন, আর কত মৃত্যু দেখলে, আর কত স্বজন হারানো মানুষের হাহাকার শুনলে কর্তৃপক্ষ দায়িত্বসচেতন হয়ে উঠবে? প্রত্যেক মানুষেরই জীবন মূল্যবান। এই মূল্যবান জীবন পুড়ে যখন ছাই হয়ে যায়, তখন তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিচয় জানার পর মর্মবেদনা তীব্র করে তুলেছে। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক জ্ঞাপন করছি।
আমরা মনে করি, আরেকটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটার আগেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। গণপূর্ত, রাজউক, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল কত পক্ষকে সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে অগ্নিতি নরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত গ্রাহ্য করা যাবে না। জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। নতুন- পুরোনো প্রতিটি ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ভবন মালিকদের এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক করতে হবে। আমরা আর নিমতলী, চুড়িহাট্টা বা বেইলি রোড ট্র্যাজেডি দেখতে চাই না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর যেসব ব্যর্থতায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি নিশ্চিত করা দরকার। নইলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। আইনগত ত্রুটি সংশোধনের পাশাপাশি বিল্ডিং কোড, অগ্নিপ্রতিরোধ আইন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে-এটাই প্রত্যাশা।

কমেন্ট বক্স