Thikana News
২৭ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সুশিক্ষা, সুশিক্ষক ও প্রাসঙ্গিকতা

সুশিক্ষা, সুশিক্ষক ও প্রাসঙ্গিকতা
মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের নানা পর্যায়ে নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা অর্জন করে থাকে। তাই শিক্ষা হচ্ছে জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, যার বিরাম নেই, অন্ত নেই। শিক্ষা অর্জন জীবনকে শাণিত, মার্জিত, সুরুচিশীল রূপে গড়ে ওঠাতে বহুলাংশে সাহায্য করে থাকে। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই শিক্ষার্জনে প্রবলভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তি উন্নয়ন ও বৈজ্ঞানিক চরম উৎকর্ষের যুগে শিক্ষাঙ্গনের হিসেবে মূল উদ্দেশ্য সাধারণত দুটো ধারায় বিভক্ত হয়েছে বলা যেতে পারে। একটি ধারা হচ্ছে জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশে বেঁচে থাকার জন্য সঠিক সময়ে যথাযথভাবে শিক্ষার্জন করে উপযোগী হয়ে সুকর্ম সম্পাদনের পথকে বেছে নেওয়ার মতো তাগিদ অনুভব করা; অপর ধারাটি হচ্ছে প্রকৃতপক্ষেই শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দক্ষতা অর্জন করা এবং সে দক্ষতার আলোকে নিজে ও জাতিকে সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের পথ তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেয়ে জাতির কল্যাণ কামনা ও চিন্তা করার অভিলাষ অধিক পরিমাণে নিহিত থাকে।
প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাহদের সন্তানের আয়-রোজগার ও খাওয়া-পরার চিন্তাভাবনা ছিল না বললেই চলে। তার পরও রাজা বাদশাহগণ তাদের সন্তানকে যথাযথ শিক্ষাদানের জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থা করেছেন, এমনকি তার সন্তানকে রাজ্য রক্ষার জন্য যুদ্ধবিদ্যা, পুঁথিগত জ্ঞান ও সমসাময়িক সকল বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দূরে শিক্ষাগুরুর জীর্ণ কুটিরে পাঠাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। মহামতি আলেকজান্ডারের পিতা তার প্রিয় সন্তানকে বহুদূরে গুরু বা শিক্ষকের পাঠশালায় ও গৃহে প্রেরণ করেন এবং উপযুক্ত গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পরবর্তী জীবনে বিশ্ব বিজয়ী সম্রাট ও জ্ঞানের ক্ষেত্রেও চরম দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহামতি নামের সার্থকতা রক্ষা করেছেন। সুশিক্ষা অর্জনের জন্য অনেক বেশি ত্যাগ, ধৈর্য, সাধনা ও পরিশ্রম করতে হয়। শিক্ষা ও শিক্ষক শব্দ দুটো একে অন্যের পরিপূরক বলা যেতে পারে। তবে শিক্ষক মাত্রই সুশিক্ষক হতে পারেন না, সুশিক্ষক হওয়ার জন্যও শিক্ষার্থীর ন্যায় কঠোর সাধনা নির্মোহ ও পর্যাপ্ত ত্যাগ স্বীকার করতে অভ্যস্ত হতে হবে। শিক্ষাদান নামক কর্মটির প্রতি নির্মল অনুরাগ, ভালোবাসা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও বিষয়বস্তুগত জ্ঞান স্বচ্ছ ও নির্ভুল থাকা একান্ত অপরিহার্য উপায়। প্রাচীনকালের গুরুর পাঠশালায় অথবা গুরুগৃহে জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবমুখী, প্রয়োগগত ও প্রমাণযোগ্য সার্বক্ষণিক শিক্ষাদান পদ্ধতি, গুরু-শিষ্যের সান্নিধ্য আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাপূর্ণ জ্ঞানার্জন অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে অর্জিত শিক্ষা-দীক্ষা কখনোই ব্যর্থ হতে দেখা যায় না, বরং বহু ক্ষেত্রেই গুরুর চেয়ে শিষ্যের অর্জিত শিক্ষার আলোকরশ্মি জগতের আনাচ-কানাচে বহুদূরে বিস্তৃত হয়েছে, অর্থাৎ শিষ্যই পরবর্তী সময়ে গুরুর নামের সার্থকতা বজায় রেখেছেন নিজের কর্মদক্ষতা, প্রজ্ঞা ও দীক্ষা কৌশল শিক্ষাদানের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। প্রকৃতপক্ষে এই দুই গুরু-শিষ্য ও শিক্ষা নামক যৌথ প্রক্রিয়ায় সুশিক্ষা ও সুশিক্ষক হিসেবে অবশ্যই সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে বলা যায়।
বস্তুতাত্ত্বিক বিলাসী জীবনযাপনে ভোগের চাহিদা যেখানে সর্বাধিক, সে যুগেও অতি নগণ্য সংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ, নিষ্ঠাবান শিক্ষক আছেন; যারা নিজেদের অনেকটাই আড়ালে রাখতে ভালোবাসেন, খুব বেশি আলোচনায় মুখরিত হতে চান না। তারা এখনো নিজের সাধ্যের চেয়েও বেশি শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে, অনেক বেশি প্রতিদান প্রাপ্তির আশা না করেও কোমলমতি শিক্ষার্থীকে পাঠদানের মতো কঠিন কাজটি করে আসছেন। বিনিময়ে সংসার নামক চাকাটি সচল রাখার জন্য জ্বালানিসম ন্যূনতম অর্থকড়ির দরকার, তা কোনোমতে জোগাড় হলেই চলে যাবে; এমনতর যাদের চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি তারা অবশ্যই সুশিক্ষক হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত। জাতি তাদের জন্য কী প্রতিদান দেবে এ প্রত্যাশার কথা ভেবে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয় না অথবা তারা এ ধরনের কোনো আকাশকুসুম  স্বপ্নই দেখতে আগ্রহী নন। এ শিক্ষকটি মনের অজান্তেই কোমলমতি শিক্ষার্থীকে কীভাবে নিজের ভেতরে লুক্কায়িত ও অর্জিত জ্ঞান দান করার জন্য সদা ব্যস্ত থাকেন আর কল্পনা করেন এ ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীরা একদিন সুযোগ্য সুনাগরিক হয়ে দেশ পরিচালনার মতো মহান দায়িত্ব নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে বিশ্বের অন্য সকল উন্নত দেশের কাতারে প্রতিযোগিতার সম্মুখে উপস্থিত করতে সাহসী ভূমিকা রাখবে এবং এ দরিদ্র জনবহুল দেশটিকে বহুমাত্রিক সাফল্যের পরিচয়ে পরিচিত করতে সক্ষম হবে।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আমরা দরিদ্র, বন্যা, খরা অথবা মহামারির দেশ বলে পরিচিত হলেও গর্ব করার মতো অনেক কিছুই ইতিমধ্যে অর্জন করতে পেরেছি। এর মধ্যে প্রধানতম আজ আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দেশ। এ পুরস্কার অর্জন আমাদের দেশকে বিশ্বের কাছে দ্বিতীয়বার পরিচিত করে তুলছে; যেমনিভাবে প্রথমবার ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’ নামক ভূখণ্ড বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিল। তখন বিশ্ববাসী অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল একটি শক্তিধর, পরিকল্পিত, সুপ্রশিক্ষিত বিপুলসংখ্যক সেনাবাহিনীকে কীভাবে নয় মাসে গ্রামের সাধারণ মানুষসহ অল্প কিছুসংখ্যক প্রশিক্ষিত সেনাসদস্য ও আপামর জনতার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের মতো এত বড় বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছে। নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমী জনতার বড় অংশ আজও দেশকে নিয়ে গর্ব করেন এবং দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। সে মহান শিক্ষকটি যিনি নিজের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মফলও তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীকে সুযোগ্য সুনাগরিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক বড় আসনের অধিকারী বরপুত্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী এবং তার কাছ থেকে দেশের সার্বিক কল্যাণ ও সুফল আশা করেন; সে শিক্ষকটি যত ছোটই হোক না কেন, মনেপ্রাণে, ধ্যানেজ্ঞানে-গরিমায়, আশা-আকাক্সক্ষায় অনেক বৃহৎ ছায়াশোভিত বটবৃক্ষের ন্যায় চারদিক আলোকিত ও প্রাণজুড়ানো স্থায়ী শীতল নির্মল বায়ুদানকারীর ন্যায় মহৎ ও মহান। যুগে যুগে সেই কোমলমতি ছাত্রের হৃদয়ের অন্তস্তলে চিরজাগ্রত থাকবে আলোকবর্তিকার মতো, ছাত্রটি তার বাংলাদেশের ক্ষুদ্র গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের পরিমণ্ডলে যতই উচ্চস্তরে সমাসীন হোক না কেন; কোনো না কোনো মুহূর্তেই মনে জাগবে মহান সেই শিক্ষাগুরুর অমীয় বাণী সুরধারা তুমি আরও বড় হও জীবনে সাফল্যের চরম শিখরে উঠে যাও অনায়াসে; মহান প্রভু তোমার জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক।
সুশিক্ষা ও সুশিক্ষক এভাবেই যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে জগতে তথা এ দেশের কোমল মাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সহাবস্থান করে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমরা জাতি হিসেবে সর্বদাই কৃতজ্ঞতা, বিনয়, নম্রতা পরস্পরায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছি। যা আমার পূর্বপুরুষেরাও বহন করে নিয়ে এসে গচ্ছিত ও সঞ্চিত করেছেন আমাদের মাঝে। তাতে আমরা হয়েছি গৌরবময়, গর্বিত ও ধন্য। শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার যৌথ কর্মপ্রক্রিয়া, যা কোনো সময় ও কালে পুরোনো বা জীর্ণ বা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার নয়। তাই যুগে যুগে এ যৌথ প্রক্রিয়া সমাজ, দেশ, জাতি ও বিশ্বজগতে চির আবেদন নতুনভাবে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, ভালুম আতাউর রহমান খান কলেজ, ধামরাই, ঢাকা। বর্তমানে নিউইয়র্ক প্রবাসী।
 

কমেন্ট বক্স