Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

লাইফটাইম ক্ষমতার ট্রেনে শেখ হাসিনা

লাইফটাইম ক্ষমতার ট্রেনে শেখ হাসিনা
চোখ বুজে, নির্ভারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানিক রাজনীতিতে কোনো ঝুটঝামেলাই দেখছেন না আর। আন্তর্জাতিকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ কিছু আপত্তি-বাধাও কেটে যাবে বলে আশা তার। নতুন করে ক্ষমতা সাজানোর পর সেগুলোর সঙ্গে দফারফা করে ফেলার অব্যর্থ দাওয়াই তৈরি করাই আছে। ডামি আর আমিÑযত নামেই সমালোচনা করা হোক, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, হতে পারে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দিয়ে তা বলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাজানো বা বোঝাপড়ার বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দিয়েও সেই স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে। দেশীয় রাজনীতিতে সরকারের এখন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষই নেই। সরকার নিশ্চিত, বিএনপির মহল্লার পাতি মাস্তানের মতো মিউ মিউ করার বীরত্ব আর ফেসবুকে সাহসী বুলি আওড়ানো ছাড়া করণীয় কিছুই নেই। জাতীয় পার্টির জি এম কাদের আর জাসদের হাসানুল হক ইনুর মতো পোষ্যদের-সরকার কথা রাখেনি, সাজানো-পরিকল্পিত নির্বাচন হয়েছে মর্মে করা অভিযোগ শোনার সময় সরকারের নেই। মানুষের কাছেও এগুলো বিনোদনের মতো। সরকারের বহির্বিশ্ব কানেকশন আগের চেয়ে আরও জোরদার। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পরদিন সকাল হতে না হতেই গণভবনে ছুটে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এ দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে তিনি কেবল অভিনন্দনই জানাননি; বন্ধুত্বকে এগিয়ে নেওয়া, পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো এবং সহযোগিতাকে আরও গভীর করতে চীনা নেতৃত্ব শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করবে বলেও জানান রাষ্ট্রদূত। এও বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ রুখে দিতে পাশে থাকবে চীন। চীনের রাষ্ট্রদূতের পর ঢল নামে অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদেরও। রীতিমতো এলাহি কাণ্ড, মহোৎসব। ভারত, রাশিয়া, ভুটান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতেরা ছুটে যান গণভবনে। মরক্কোর রাষ্ট্রদূত ও ডিন অব দ্য ডিপ্লম্যাটিক কোরও বাদ যাননি। গণভবনে যাওয়ার দৌড়ে শামিল হয়েছেন আগা খান ডিপ্লম্যাটিক রিপ্রেজেন্টেটিভের প্রতিনিধিরাও। তারা নিজ নিজ দেশের সহযোগিতা উজাড় করে দেওয়ার কথা জানান।
এ ধারার বাইরে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাজে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। আহ্বান জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধের। জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের সব মানুষের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মুখে। ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র যেন লোকদেখানো হয়ে না পড়ে। নির্বাচনকে সামনে রেখে গত কয়েক মাসে হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে নির্বিচারে আটক বা ভয়ভীতি দেখানো প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয়। বাংলাদেশে একটি সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য আবশ্যিক শর্তগুলো জোরদারে পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনে জনগণের অধিকারকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, অন্য পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে একমত নয় যুক্তরাষ্ট্র। এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচনের সময় সংঘটিত সকল সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন মিলার। আর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি। সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সে কারণে বাংলাদেশের মানুষের ভোট দেওয়ার যথেষ্ট বিকল্প ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এবার পর্যবেক্ষক এসেছেনÑসরকারের এমন দাবি স্বীকার করেনি দেশটি। নির্বাচনের দিন বিকেলে ঢাকার একটি হোটেলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন আমন্ত্রিত পর্যবেক্ষকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত পর্যবেক্ষকও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। তবে তাদের ওই বক্তব্য নিজস্ব, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নয়। ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেনি। নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকজন বেসরকারি নাগরিক বাংলাদেশে ছিলেন। তাদের বক্তব্য নিজেদের বা তাদের প্রতিষ্ঠানের, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নয়। এ নির্বাচনে কানাডা সরকার কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রেরণ করেনি। পর্যবেক্ষক হিসেবে চিহ্নিত কানাডিয়ান নাগরিকদ্বয় স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। নির্বাচন বিষয়ে তাদের প্রদত্ত মতামতের সঙ্গে কানাডা সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই।
এসবে একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই প্রধানমন্ত্রীর। পর্যবেক্ষকেরা অরিজিনাল না ফেক, যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়ার দিন বিকেলেই তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনের পরদিন গণভবনে কথিত ‘বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক সম্মেলনে’ তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, বিরোধী দল না থাকলেও গণতন্ত্র থাকতে পারে, বাংলাদেশেও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের মান কি বাংলাদেশের চেয়ে ভালোÑযুক্তরাষ্ট্রেরই এক পর্যবেক্ষককে এ প্রশ্ন ছুড়ে মাত করে দেন প্রধানমন্ত্রী। এবার আগে থেকেই জানানো হয়েছিল মিনিমাম ডেমোক্রেসি, ম্যাক্সিমাম ডেভেলপমেন্টের কথা। বাংলাদেশে ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির গণতন্ত্র অনুসরণের বার্তাও দেওয়া হয়েছে। অনেক পরিপক্ব গণতন্ত্রের সংসদীয় ব্যবস্থা ওয়েস্টমিনস্টার সিস্টেম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেÑএটি ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থায় উদ্ভূত সংসদীয় ফর্ম। এই পদ্ধতিতে বিরোধীদের সংগঠিত করার, নির্বাচনে এবং সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে ভোটের আবেদন করার অধিকার রয়েছে। এই ধারণাটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। জাতিসংঘের মতে, গণতন্ত্র এমন পরিবেশ প্রদান করে, যা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাকে সম্মান করে এবং যেখানে মানুষের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করার ইচ্ছা প্রয়োগ করা হয়।
অনেক পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা সরকারকে জবাবদিহি করার জন্য স্বীকৃত। তা সাংবিধানিক পদ্ধতি। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতিকে সরকার গঠনের চেতনা হিসেবে সমুন্নত করা হলেও পরে তা পাল্টে যায়। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুই প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। বহু পরে ১৯৯১ সালে এসে আবার ফেরানো হয় সংসদীয় পদ্ধতি। প্রতিবেশী ভারতেও তা বহাল। অপরদিকে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে। সেখানে তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়, তবে সংবাদপত্রের কোনো স্বাধীনতা নেই। মিডিয়া সেখানে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত। কঠিন অনুশাসনের মধ্যে চলতে হয় চীনের নাগরিকদের। সেখানে শাসন পরিচালনা করতে হয় সততার সঙ্গে। অসৎদের কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয় অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে দেওয়া হয়। চীন, উত্তর কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ আরও কিছু দেশের অবস্থাও তত ব্যতিক্রম নয়। সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু উন্নয়ন হয় ব্যাপক। তারা উন্নত বিশ্ব বলে পরিচিত। ভেতরের অবস্থা অন্ধকার। ওইসব দেশে চলে নিয়ন্ত্রিত বহু দুর্নীতি, যা আবর্তিত হয় সরকারি ঘরানার নির্দিষ্ট কিছু লোকের হাতে। মাঝেমধ্যে ঘটনাচক্রে তাদের কিছু কিছুকে কঠিন শাস্তির দৃষ্টান্ত দেখানো হয়। শাসনতন্ত্রের পাশাপাশি তাদের নির্বাচন-পদ্ধতিও ডামি মডেলের। কয়েকটি দেশে সরকারি তালিকার বাইরে অন্য প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগও কম। উত্তর কোরিয়ায় তো বিরোধী দল বলে কিছু নেই। সরকার যে দল বা জোট তৈরি করবে, সেখানেই ভোট দিতে হয়। সেখানে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ১০০%ও হয়ে যায়। কেবল ভোট নয়, সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্বাচনের আনন্দ করাও বাধ্যতামূলক। ফল ঘোষণার পর তা কেবল মেনে নেওয়া নয়, তা সমর্থন করে উল্লাস করার নির্দেশ আরোপ রয়েছে।

কমেন্ট বক্স