চীনের খাদ থেকে রেহাই মিলছে না বাংলাদেশের। ভারতেরও। ভারতের সঙ্গে ওইভাবে না পারলেও বাংলাদেশকে পেয়ে বসেছে আচ্ছামতো। পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষায় রাশিয়ার অত্যাধুনিক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরোধী ব্যবস্থা মজুদ রেখেই চীনকে টেক্কা দিচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের সমস্যা সীমান্ত নিয়ে নয়, অর্থনৈতিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেকাংশ চীনের ফাঁদে চলে গেছে আগেই। এখন বাকিটা গেলার চেষ্টা। তা গোপনে নয়, অনেকটা প্রকাশ্যেই। চীন নানা পদক্ষেপে তা জানিয়ে দিচ্ছে। একটি সাবমেরিন ঘাঁটি, ৫০০ কোটি ডলার সহায়তা, ভারতের শিলিগুড়ির কাছে অবকাঠামো প্রকল্প, বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য ও সামরিক এক্সারসাইজের মাধ্যমে ভারতকে উদ্দেশ্য জানাতে বাকি রাখেনি বেইজিং। চীনের এ অভিযাত্রা কেবল ভারত বা বাংলাদেশকে নিয়ে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলেই। বাংলাদেশকে বগলে রেখে বন্ধু পাকিস্তানকে আরও আয়ত্তে নিয়ে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটানের দিকেও এ থাবার বিস্তার ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশে বেশুমার বিনিয়োগ চীনের। অস্ত্র বিক্রিও প্রচুর। অন্তত ৫০০ কোটি ডলার। গোটা বিশ্বে ভারত যে অস্ত্র বিক্রি করে, বাংলাদেশেই করে তার প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে চীনের খরচ ৪০০ কোটি ডলার। সামনে আরও ৫০০০ কোটি ডলার খরচের বাজেট করে রেখেছে চীন। চীনের আরেকটি দুঃসাহসী প্রকল্প হলো কক্সবাজারের পেকুয়ায় মার্চে উদ্বোধন করা বিএনএস শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি। এটি নির্মাণে চীনের ১২১ কোটি ডলার তহবিল ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে একসঙ্গে ছয়টি সাবমেরিন এবং আটটি যুদ্ধজাহাজ নোঙর করতে পারে। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে চীনের কাছ থেকে ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দুটি মিং-শ্রেণির সাবমেরিন কেনে বাংলাদেশ।
২০ বছর আগে ঢাকা-বেইজিং বাণিজ্য ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন তা উন্নীত হয়েছে ২২০০ কোটি ডলারে। অথচ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ঘাটতি প্রায় ২১০০ কোটি ডলার। তা বাড়ছেই। একে কোনো ঘটনাই মনে করছে না চীন। বস্ত্র, পাটসহ কিছু পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করে দিতে ঢাকার আবেদন-নিবেদনকে পাত্তাই দিচ্ছে না তারা। এমন নির্দয়-নিষ্ঠুরতার মাঝে চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এ আশ্বাসও মশকরামূলক। কারণ, এখন পর্যন্ত আম নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। তারা বাংলাদেশের আমের মান দেখবে। এর সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চীনের পরিদর্শক দল বাংলাদেশে আসবে, দেখে-শুনে মত দেবে। ভালো বললে তখন আমদানির সিদ্ধান। এতেও লজ্জা পাওয়া বা অভিমান দেখানোর অবস্থা নেই বাংলাদেশের। এরই মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ তো বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে নিয়েই রেখেছে। উপরন্তু, চীনের কাছে আরও ৫০০ কোটি ডলার ঋণের জন্য ধরনা দিচ্ছে। ঢাকার এমন ধরনার অপেক্ষাই করছিল বেইজিং। যেমনটি করেছিল শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও। কিছুটা পাকিস্তানেও। ভারতকে সেভাবে পারছে না। তবে নন-স্টপ টোকা দিচ্ছে আশপাশে।
ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে ভারত। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে চীনের প্রভাব সেই উদ্বেগে বাড়তি টোকা ফেলেছে। লোকসভা নির্বাচনী ঢোলের বাদ্যের মধ্যেও মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল সফর করেছে চীনা সামরিক বাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল। সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ে সহযোগিতা জোরদারের কথা বলছে বেইজিং। প্রতিনিধিদল প্রথমে গেছে মালদ্বীপে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর সঙ্গে বৈঠকও করে। পরে দুই দেশের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, মালেকে বিনা মূল্যে অস্ত্র দেবে বেইজিং। ভারত মহাসাগরে চীন আধিপত্য বিস্তারে কঠিন নিরাপত্তাবলয় তৈরি করছে। ভারতই এখানে মূল টার্গেট। টার্গেট বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে মালদ্বীপে চীনপন্থী সরকার ভারতের জন্য উদ্বেগের। মালদ্বীপের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কায়ও চীনের প্রভাব বাড়ছে। নেপালের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চীনের। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও চীনকে ছাড়তে চায় না বাংলাদেশ। ভারতের শত্রু দেশ পাকিস্তান তো আছেই।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত মিলিয়ে মিয়ানমারের উত্তরাংশ এখন ভারতবিরোধী চীনাপন্থী আরাকান সেনাবাহিনীর দখলে। মিয়ানমারের জান্তাকেও আগলে রেখেছে চীন। তারা সামরিক বাহিনীর দেশ দখল দেখতে চায় না বলে ঘোষণা দেয়, আবার প্রণোদনাও দেয়। সু চির জন্য সমবেদনা জানায়, জান্তাকেও সমর্থন দিয়ে আসছে। প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও এখনো তাদের সঙ্গে আছেন। চীন দেশটির প্রান্তিক সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোকেও সহায়তা দিয়ে আসছে। মিয়ানমারজুড়ে চীনের বহু ধরনের বিনিয়োগ আছে, সে কারণে বেইজিং বহুদিন হলো এই কৌশলে কাজ করে চলেছে। চলতি বিদ্রোহ বা যুদ্ধে চীন উভয় পক্ষেই আছে। যে জিতবে সেটাই চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মিয়ানমারের রাখাইন, চিন, শান ও ওয়া স্টেট অঞ্চলটি চীনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ অঞ্চলের সঙ্গে একদিকে চীনের বিশাল স্থলসীমান্ত, আরেকদিকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত অর্থনৈতিক করিডোর ও জ্বালানি পাইপলাইন এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে চীনের ইউয়ান প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে চীন সব সময় তার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কৌশলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পাশাপাশি এই অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।
এ বাস্তবতার সন্ধিক্ষণে ভারতের নাকের ডগায় চুপিসারে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করছে চীন। রাডারে ধরা না পড়ায় চিকন চোখে বিমানগুলোকে ঠাহর করা সম্ভব নয়। উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়, সিকিম সীমান্ত থেকে অন্তত ১৫০ কিলোমিটার দূরে চীন অধিকৃত তিব্বতের শিগাৎসে বিমানবন্দরে ছয়টি অত্যাধুনিক জে-২০ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা সেনাঘাঁটি থেকে বিমানবন্দরটির দূরত্ব ২৯০ কিলোমিটারেরও কম। এই হাসিমারাতেই ভারতের দ্বিতীয় রাফাল বিমানঘাঁটির অবস্থান। সচরাচর চীনের পূর্বাংশে জে-২০ যুদ্ধবিমানগুলো মোতায়েন থাকে। কিন্তু হঠাৎ ভারত সীমান্তের এত কাছে যুদ্ধবিমান মোতায়েন একটি ঘোর তৈরি করেছে। ভারত সীমান্ত সুরক্ষায় রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরোধী ব্যবস্থা মজুদ রেখেছে পূর্ব ভারতে।