কাজে আর কথায় আচ্ছা কাউর বাধছে রাজনীতির ময়দানে। এক গিট্টু ছোটাতে না ছোটাতেই লাগছে আরেক গিট্টু। যার কিছুটা ঠান্ডা পরিকল্পনার জের। কিছুটা কেবলই অবান্তর হিরোইজমের কুফল। বুঝে না বুঝে কথার বোম পড়ছে এদিকে-ওদিকে। সেই সঙ্গে সইতে হচ্ছে ভারতের ঢোল-তবলার বেদম তাল। একের পর এক ভারতীয় অপপ্রচার-যন্ত্রের একেকটি প্রোডাকশন-কন্টেন্ট আপাতত বুমেবাং হয়ে গেলেও ধকল পড়ছে মারাত্মকভাবে। ট্রাম্পের ছবির ওপর আক্রমণ ঘটাতে দলীয় কর্মীদের প্রতি শেখ হাসিনার অডিও বার্তার মাঝে আরেক সমীকরণ। ইন্ডিয়া টুডের ‘বাংলাদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন’ শিরোনামে প্রতিবেদন এর একটি মাত্রাযোগ মাত্র।
বাংলাদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য না থাকলেও ভারতের পত্রপত্রিকায় এ-সংক্রান্ত প্রচারণা ব্যাপক। পালানোর পর থেকে শেখ হাসিনা ভারতেই আছেন। সেখানে বসেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘায়েলের হেন চেষ্টা নেই, যা না করছেন। এখন পর্যন্ত গোল দিতে না পারলেও চেষ্টায় কমতি দিচ্ছেন না। সামান্য হলেও গোলমাল বাধানোর চেষ্টায় বলীয়ান তিনি। ঢাকার জিরো চত্বরে ১০ নভেম্বর ঐতিহাসিক নূর হোসেন দিবসটি বরবাদ করতে পেরেছেন।
অর্জন জিরো হলেও প্যানিক ডিজঅর্ডার ঘটাতে পেরেছেন। দিনটিতে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মী জিরো পয়েন্টে জড়ো হয়ে ড. ইউনূস সরকারের পতন ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে- উদ্দেশ্য এমন ছিল না। কিন্তু তার কয়েকটা ছবি দরকার ছিল, সেগুলোকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাজারে বিক্রি করার। সরকার ও তার সমর্থকেরা সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। রাজনীতির খেলার চাল সামান্য হলেও সফল হয়েছে। দুয়েক দিনের মাথায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এবারের জন্মদিনের আয়োজন না করার রাজনীতিও প্রশংসিত। সোমবার রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, ২০ নভেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিনে কোনো অনুষ্ঠান হবে না। তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে কেউ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। সময় বিবেচনায় একে একটি ভালো দিক বলে বিবেচনা পায়। প্রশংসিত ঢাকা মহানগরীতে বিএনপির টাঙানো সকল ব্যানার-ফেস্টুন নামিয়ে ফেলার নির্দেশনাও। সেখানে ভালোর ওপর ভালোর মতো যোগ হয় রিজভীর বঙ্গবন্ধুর ছবি-বিষয়ক বয়ান।
আওয়ামী লীগের জিরো পয়েন্টের জিরো কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্ল্যাকার্ডসহ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১০ নভেম্বরের আগের রাতে। আর পরদিন আওয়ামী লীগ ধোলাই পর্বে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলেছে বিএনপি-ছাত্রদলের কর্মীরাও। এমন ভালোর মাঝে আরও ভালো আওয়াজ দিয়ে বুমেরাং হয়ে গেছে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বচন। বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামানো উচিত হয়নি মন্তব্য করে ঘায়েল হয়ে গেছেন তিনি। তিনি শেখ মুজিবের উত্থান-ইতিহাসের নানা পথে তার ভূমিকা নিয়ে তার মতো করে কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু মিডিয়া ফোকাস করেছে ‘ছবি নামানো ঠিক হয়নি’।
আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল একাত্তর বেস করে লাইন টানা। একদিকে আওয়ামী লীগ থাকবে, একাত্তরের সুবিধা একা ভোগ করবে, বাকিদের বিপরীতে ঠেলে দেবে। দাঁড় করতে চেয়েছে ‘যারা আওয়ামী লীগ নয় তারা একাত্তরের বিরুদ্ধে’। মানে একাত্তর আওয়ামী লীগের একার। তার এই রাজনৈতিক ভাগাভাগিতে প্রো-একাত্তরের পক্ষে আর কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে দাঁড়াতে দেয়নি, সবাইকে তল্পিবাহক করে জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনীতি খেয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভাগ করে দেওয়া সীমারেখার ওপারে যে শক্তি দাঁড়িয়েছে, তাদের কয়েকটা পোলে বিভক্তি এসেছে। বিএনপি টের পাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের একটা অংশ দলটিকে টার্গেট করে তাদের কোণঠাসা করে উগ্রবাদী রাজনীতি নিয়ে আসতে চাইছে।
৫ আগস্টের পরের খুন-লুটের ঘটনার ইমডেমনিটি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিবৃতিতে ৭৫-পরবর্তী ইনডেমনিটি ইস্যুতে জিয়াউর রহমানের নাম আনেনি, মোশতাকের নাম বলেছে দুবার। অথচ আগে তারা এ বিষয়ে খন্দকার মোশতাকের বদলে জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করত। আবার ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে শেখ হাসিনার বাণীতে ইনডেমনিটি ইস্যুতে জিয়াউর রহমানের নাম আনেননি। এখানেও মোশতাককে অভিযুক্ত করেছে। যেটা গত বছরও করেনি। এমন কানাঘুষার মাঝেই রিজভী মঙ্গলবার সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় ‘ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরানো নিয়ে একটা জ্ঞানী মন্তব্য ছাড়েন। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার এরশাদ স্টাইলে আগের বক্তব্য থেকে সরে আসা। বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। এর আগে বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সোমবার জানিয়েছিলেন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে। এরপর বঙ্গভবনের দরবার হলের পর তিন উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও নামানো হয়ে যায় শেখ মুজিবের ছবি।
১০ নভেম্বর তারিখটি বেশ ঐতিহাসিক। যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ তাকে সরে যেতে বললেও তিনি শোনেননি। এরপর পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হলে তিনি হয়ে ওঠেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। এবার যেমন ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে প্রতীক হয়েছিলেন রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। কয়েক দিন আগে শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া একটি অডিও ক্লিপে বলতে শোনা যায়, সমাবেশে তিনি নিজের ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দিয়ে বানানো ফেস্টুন রাখতে বলেছেন। সেখানে হামলা হলে সেই ছবি তোলার জন্য আগে থেকেই ক্যামেরাম্যান ঠিক করে রাখতে হবে। এরপর হামলার ছবি আমেরিকায় পাঠিয়ে বলা হবে, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।’ কথোপকথনটি সত্য হোক বা বানানো হোক, দলীয় আবেগী কর্মী-সমর্থকেরা বিশ্বাস করেছেন, ট্রাম্পের ছবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। আর নগদে ছেঁচা মার খেয়ে এখন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁতরাচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায়নি, আগামী দিনের রাজনীতির চাতুরীর একটি ছকও আঁচ করা যায়। সেখানে কারও ছবিকে উপাদান করে ফেলার মধ্য দিয়ে আরেক দেউলিয়াত্ব। নিজের মুখে বলা কথা কিছুক্ষণের মধ্যে উইথড্র করা আরও বড় দেউলিয়াপনা।