Thikana News
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

দুর্নীতিবাজ ধরতে আইএমএফ টনিক

বেনজীর-মতিউরকে বাঁচিয়ে আমলা ফাঁসানোর রাজরোগ
দুর্নীতিবাজ ধরতে আইএমএফ টনিক
সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী আইন অনুযায়ী দাখিল ও ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা কেবল জানতেই চাননি হাইকোর্ট, রুলও জারি করেছেন। সেই সঙ্গে সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে হাইকোর্টে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চলমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম আদালতি অ্যাকশন এটি। বিষয়টি বেশ ইন্টারেস্টিংও। শুনানিতে রিটের পক্ষের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস হাইকোর্টে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘জনগণের ট্যাক্সের ৪৩ শতাংশ টাকা যেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনে যাচ্ছে, সেখানে তাদের সম্পদের হিসাব কেন প্রকাশিত হবে না? আর পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সম্পত্তি আর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয় সামনে এলে তিনি কী রক্ষা করবেন? তার সম্পত্তি নাকি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব?’ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা কোনো বাধ সাধেননি। বরং বলেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা উচিত। আমরাও তা চাই।’ শুনানি শেষে রুলিং। সঙ্গে কিছু মতামতও দিয়েছেন হাইকোর্ট। এতে বলা হয়, ‘দুর্নীতি হচ্ছে উন্নয়ন ও সুশাসনের অন্তরায়। এটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।’
বেনজীর, মতিউর, শামসুদ্দোহা, আছাদুজ্জামান মিয়াসহ সাম্প্রতিক আলোচিত দুর্নীতিবাজ শনাক্তের মিশনটির গোড়া অন্যখানে। দেশেও নয়। দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার পরামর্শটা এসেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে। বাংলাদেশ বিষয়ে আইএমএফের কান্ট্রি রিপোর্টে এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদনের দিনে কান্ট্রি রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়। এর আগে-পরে পেন্টাগন প্রেস সেক্রেটারি মেজর জেনারেল প্যাট রাইডারও এর একটা আভাস দিয়েছিলেন। এরও আগে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়টিকে সামনে আনেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু।
তার... ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ কথার মানে তখন অনেকেরই চিন্তায় আসেনি। তার আরেকটা বাক্য ছিল, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে মিলে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করে যাব।’ তার এ কথার মাঝেও ফের দেখছেন কোনো কোনো কূটনীতিক। লু ‘বাংলাদেশের জনগণের সাথে মিলে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের’ কথা বলেছেন, সরকারকে সাথে নিয়ে নয়। মার্কিনিরা পরিষ্কারভাবে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছে। এ লড়াই তারা জনগণকে সাথে নিয়েই করতে চাইছে।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়ালে যেসব আইন ও বিধির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সেসব আইন ও বিধি গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে শিথিল করা হয়েছে। ফলে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের শাস্তির মাত্রা কমেছে। এতে সরকারি কর্মচারীদেরকে দুর্নীতি-অনিয়মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন দুই সরকারই এ-সংক্রান্ত আইন-বিধিমালা সংশোধন করে দুর্নীতির শাস্তি কমিয়েছে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা (১৯৮৫) সংশোধনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তি হিসেবে তাকে ‘তিরস্কার’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সংশোধনীর আগে এই শাস্তি ছিল ‘বাধ্যতামূলক অবসর’, ‘চাকরি থেকে অপসারণ’ বা ‘চাকরি থেকে বরখাস্ত’।
এখন দুর্নীতিবাজ ধরতে গিয়ে ভজঘট পেকে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ ধরলে সরকারের অনেক লোকও ফেঁসে যায়। তাই তাদের সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া সরকারের গত্যন্তর থাকছে না। বেনজীর-মতিউরদের দেশ ছেড়ে পালানোর রহস্যটাও সেখানেই। বদলি-ওএসডির মতো চাতুরী করার রাস্তা নেই তাদের বেলায়। নির্ঘাত ধরতে হয়, বিচারও করতে হয়। আর সেটা করতে গেলে ধরা পড়ে যান সরকারের ও দলের বাঘা বাঘা অনেকে। দুর্নীতির অভিযোগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসরসহ কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয়। দুর্নীতির অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও পুলিশের কোনো কোনো কর্মকর্তাকে বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া বিভাগীয় পদক্ষেপ হিসেবে আশাব্যঞ্জক প্রথম পদক্ষেপ মনে হলেও ভেতরটাতে চাতুরী। প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই তাকে বদলি করা, বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের মতো বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাকেই স্বাভাবিকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংশোধনের মাধ্যমে বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা শিথিল করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দেওয়া সুরক্ষাকবচে এখন কুলাচ্ছে না। আলামত বুঝতে পেরে এখন সরকারদলীয় হেভিওয়েট নেতাদের কয়েকজন দুর্নীতির দায় ঢালাওভাবে শুধু সরকারি কর্মচারীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। অথচ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিগুলো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব হয়নি। এতে বেশি অস্থিরতা পুলিশ ও কাস্টমসে। প্রশাসন-প্রকৌশল সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরাও আতঙ্কে। কারণ এসব সংস্থায় দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সাব-রেজিস্ট্রার পদের কর্মকর্তারা সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়িত। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। দশম গ্রেডের (দ্বিতীয় শ্রেণি) সাব-রেজিস্ট্রার পদকেই টাকার খনি মনে করা হয়। ডিসি-এসপিসহ মাঠপর্যায়ের সব স্তরেই অস্বস্তি চলছে। এবারের ধাক্কাটা একটু বড় হওয়ায় কে কখন কার বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁস করেন, সেই শঙ্কা ভর করেছে। এদের অভ্যন্তরীণ গাঁথুনি বড় পোক্ত। পদ-পদায়ন-পদোন্নতিসহ নানান সুযোগ-সুবিধা হাতানোতে তাদের কানেকশন আঠার মতো। যে কারণে বিভাগীয় পর্যায়ে দুর্নীতিসহ নানান অভিযোগ তারা উতরে গেছেন ম্যাজিকের মতো।
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কিছু প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতি থাকলেও সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কিছু মামলা হয়। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া প্রশাসনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগের তদন্ত হলেও ফলোআপ জানা যায় না। বরং কিছুদিন পর পদোন্নতি পেয়ে যান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা কঠোর ছিল। ওই বিধিমালা বহাল থাকলে দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হওয়া কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে বিধিমালাটি দুর্বল করে ফেলায় দুর্নীতি করেও কঠোর শাস্তি পাচ্ছে না দুর্নীতিবাজরা। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর সম্পদের বিবরণ দাখিল করা সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক। এই নিয়ম মানার বালাই নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স বেশ আলোচিত। আবার হাস্যকরও। তারা যেন দুর্নীতি না করেন, সে জন্য বেতন বাড়ানোসহ রাজকীয় নানা প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে দুর্নীতি আরও বেড়েছে। বেনজীর-মতিউরের দুর্নীতি এর প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে সরকার প্রশাসনে কারা দুর্নীতি করছে এবং কীভাবে দুর্নীতি করছে, সে ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ তদন্তের কথা শোনা যাচ্ছে। দুই বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের আয়ের বিবরণ প্রকাশের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তটি শোনা কথা পর্যায়েই রয়ে গেছে। সেখানে এখন উচ্চ আদালতের রুল। বাকিটার জন্য আপাতত অপেক্ষা।

কমেন্ট বক্স