বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতার তলের খেলা গলা উপচে আরও উপরে উঠে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এবার জাতিসংঘও জানিয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আগের অবস্থানের নড়চড় হয়নি। সেই সঙ্গে জনগণের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতে ভীতি প্রদর্শন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদ সম্মেলন করে বার্তাটি পরিষ্কার করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক। বলেছেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায়, যেখানে জনগণ প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয় ছাড়াই কথা বলতে পারবে। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত ও যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সংলাপ প্রস্তাবে সায় দিয়েছে জাতিসংঘ।
এদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও পাল্টায়নি- ঢাকা সফরের সময় তা নতুন করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন দেশটির উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আখতার। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি তা খোলাসা করেন। সেই সঙ্গে জানতে চান মার্কিন আগাম নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দেওয়া সংলাপসহ পাঁচ সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে। আফরিনকে স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি মাসুদ বিন মোমেন। অনেকটা আমতা আমতা করতে হয়েছে তাকে। কথা ঘুরিয়েছেন অন্যদিকে। বলেছেন, সরকার সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠালে তাদের সব ধরনের সহায়তা দেবে বাংলাদেশ। র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামনে আরও ভালো হবে। গুম-খুনের কোনো ঘটনা আর ঘটবে না। মার্কিন পর্যবেক্ষক দলের সফর ও দেশে ফিরে গিয়ে সংলাপের তাগিদসহ পাঁচ সুপারিশ প্রকাশ-পরবর্তী পরিস্থিতি জানতে-বুঝতে আসা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও একান্তে মতবিনিময় করেছেন। গুলশানে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় আমন্ত্রিত সিভিল সোসাইটির অতিথিদের কাছে তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র নিয়ে জানতে চান।
জবাবে সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, টিআইবির ড. ইফতেখারুজ্জামান, অধিকারের সদ্য জামিনে মুক্ত আদিলুর রহমান খান, নাসিরুদ্দীন এলান, বেলার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, চাকমা সার্কেলের রানি য়েন য়েনসহ কয়েকজন একবাক্যে আফরিনকে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একটি ব্যাখ্যাও উঠে আসে তাদের আলোচনায়। জনগণ এবং প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ নয় বলে মত দিয়েছেন তারা। কথা হয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রক্রিয়া নিয়েও। আমন্ত্রিতদের প্রায় সবাই বলেছেন, বিদ্যমান সংবিধান ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারও হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে মনে হতে পারে, সে ধরনের পদক্ষেপ যেন নেওয়া না হয়Ñআফরিন তা ভাবনায় রাখার মত দেন। সেই সঙ্গে বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
কূটনৈতিক শালীনতায় এ কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। গত ৮-১২ অক্টোবর ঢাকা সফর করে গেছে প্রতিনিধি দলটি। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসার আহ্বানসহ পাঁচটি পরামর্শ জানিয়েছে বিবৃতির মাধ্যমে। অহিংসার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং রাজনৈতিক সহিংসতার অপরাধীদের জবাবদিহি করারও আহ্বান জানানো হয়। এবং শেষে সব দলকে অর্থবহ এবং সমান রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে বলা হয়েছে, যেন তা স্বাধীন নির্বাচন পরিচালনাকে শক্তিশালী করে। এর মাঝেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকাশ্যে কড়া বার্তা, ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন হবেই।’ তার এ বক্তব্যের মাঝে ২০১৪ সালের মতো বা একই কায়দায় ভিন্ন রূপে নির্বাচন তুলে আনার ধারণা মিলছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে পরপর অনুষ্ঠিত দুটো গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায়নি। তার ওপর আরোপ করেছে স্যাংশন এবং ভিসা রেস্ট্রিকশন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফর বেড়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় লু, ব্লু, জেয়া ও আফরিনের ফের ঢাকা আসা। এর আগে গত বছরের ৬-৭ নভেম্বর সফর করে গেছেন আফরিন। তার এবারের সফরের সাবজেক্ট-অবজেক্টে অনেক তফাত। ভেতরে ভেতরে পানি গড়াচ্ছে অন্যদিকে। ভারতের সুজাতা সিংদের সশরীরে এসে নির্বাচন তুলে দেওয়ার ছায়া স্পষ্ট আজরা জেয়া-আফরিন আক্তারদের মধ্যে। কাজের ধরনে ভিন্নতা আসতে পারে। তাদের ভূমিকা এবার কোনমুখী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে পথ আগেরটাই। যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ দফার মধ্যে বল দুদিকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সরকারের যে বিএনপিকে কোনো দল মানতেই আপত্তি, সেই বিএনপির সঙ্গেই এখন সরকারকে সংলাপ করতে বলছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার বিএনপি যেখানে সরকারকেই অবৈধ বলছে, সেখানে ওই সরকারের সঙ্গেই তাদেরকে বসতে বলা হচ্ছে। আবার বিপুল বৈষম্য-কর্তৃত্ববাদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠন, পাচারে থাবা বসিয়েছে স্যাংশন-ভিসা রেস্ট্রিকশন দিয়ে। সেই সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণে অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করেও রেখেছে।
এসবের রসায়নে বাংলাদেশের রাজনীতির টম অ্যান্ড জেরির খেলা আরও জমছে। বাড়ছে আকথা-অপকথার ধুম। যার এক কদাকার শোডাউন হয়েছিল বহুল আলোচিত-সমালোচিত ওয়ান ইলেভেনের আগেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটেনের আনোয়ার চৌধুরী, জাতিসংঘের রেনাটা লক ডেসালিয়ানসহ বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিডর বইয়ে দিয়েছিল। বিউটেনিস-রেনাটা লকরা তখন সব দিকেই তাড় ও তাড়না দিয়েছেন। রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য তারা দফায় দফায় খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছেন। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তারা প্রায়ই বিবৃতি দিতেন। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককেও (এডিবি) এক করে ফেলেছিলেন তারা। রাজনীতিকেরাও ছুটে গেছেন তাদের কাছে। এতে কেউ বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন, কেউ নিগৃহীত হয়েছেন। তাদের ল্যাঠা মেটাতে ঢাকায় এসেছিলেন জাতিসংঘের তখনকার মহাসচিবের বিশেষ দূতও। ২০১৪-১৮-তে ধরন বদলায়। ভারত খেলেছে চরম নোংরাভাবে। সুজাতা সিংসহ ভারতের হাই-প্রোফাইলরা সশরীরেও চলে এসেছেন বাংলাদেশে। ভারতের হাইকমিশনের কর্মকর্তারা ঢাকার রাজনীতির মাঠ দাবড়েছেন প্রকাশ্যে হাইরেসে। দিল্লি থেকে হটলাইনে চলেছে নানা নির্দেশনা। এবার ভারতের ভূমিকা রহস্যাবৃত। হালে রহস্যের তীব্রতা আরও বেশি। থাকছে দম ধরার মতো। দিল্লির সর্বশেষ বার্তায় আবারও বলা হয়েছে, ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে, কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে নয়। নয়াদিল্লি চায়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। ভারতের এ ধরনের সুবোধ বার্তার মাঝে গলদের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। কারণ মুখে একটা বলে কাজে অন্যটা করার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে ভারতের।
এবার ঘটনা ও প্রেক্ষিত পাল্টে গেছে ভারতের। ‘মোদি হটাও’-এর কৌশল হিসেবে ‘ইন্ডিয়া’ জোট হয়েছে। বিজেপি হারছে বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে। একদিকে লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদির এ দশা, আরেকদিকে বিশ্বায়নের রাজনীতি-কূটনীতিতে বাড়তি যন্ত্রণা। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবেন, না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করবেন? এ প্রশ্নের হামাগুড়ির মাঝে ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলার পরই মোদি সেটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে উল্লেখ করে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়ে অনেকটা গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছেন। প্রশ্ন ওঠে, ভারত কি তাহলে অনেক দশক ধরে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানো অবস্থান বদল করল? ওই হামলা এবং হামাস-ইসরায়েল সংঘর্ষ শুরু হওয়ার ছয় দিন পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক প্রথমবারের মতো বিষয়টি নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, তাতে ফিলিস্তিনের সমর্থনের কথা বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি ফিলিস্তিন নিয়ে ভারতের দীর্ঘকালের যে অবস্থান, সেটাকেই তুলে ধরেছেন যে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত দেশ ফিলিস্তিনের দাবির প্রতি ভারত সমর্থন জানাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যখন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিলেন, তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফিলিস্তিনের দাবির প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা তাদের স্নায়ুচাপেরই প্রকাশ। এমন ইন্টারনাল-এক্সটারনাল চাপের মাঝে বাংলাদেশকে নিয়ে আগের মতো একতরফা কর্তৃত্ববাদী ভাবনার ফুরসত তার নেই।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 ঠিকানা রিপোর্ট
 ঠিকানা রিপোর্ট  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
