নতুন নতুন ইস্যুর তোড়ে ডাইভারশনের পথে জুলাইর গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা। ইস্যুগুলো তালবেতালে মাঠে এনে তৈরি করা হচ্ছে ঘোর অস্থিরতা। মানুষ যে মুহূর্তে শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়; বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ চায়, সে মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিয়ে মুচলেকা আদায়ের চেষ্টা প্রকট। একে গণঅভ্যুত্থানের গতি পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা প্রত্যাহার দাবি, আওয়ামী লীগসহ ১১টি দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধে রিট, পরে রিট না চালানোর ঘোষণাকে ভালোভাবে দেখছেন না তারা। সেখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া আর সব দল আছে, আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থাকা কমিউনিস্ট পার্টির নামও আছে। এসব করে একটা ভজঘট বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের পর আবেদনকারী হয়ে রিটটি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলমসহ তিনজন। অপর দুজন আবুল হাসনাত ও হাসিবুল ইসলাম। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে অপর একটি রিটও করেছেন তারা। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের ২৯ অক্টোবরের কার্যতালিকায় রিট দুটি ২৮৩ ও ২৮৪ নম্বর ক্রমিকে ছিল। এর আগে ২৮ অক্টোবর বিকেলে ফলাফলের ঘরে দেখা যায়, রিট দুটির বিষয়ে ‘আউট’ লেখা রয়েছে। মানে রিট দুটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অপর ১০টি দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট (বড়ুয়া) ও সোশ্যালিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ।
এই ভজঘটের সময়টাতে ঢাকায় কর্মব্যস্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। নির্বাচন, মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকায় তার বেশ কয়েকটা বিশেষ অ্যাজেন্ডা। ঢাকা সফরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ছয় থেকে সাতজন উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, সেনাবাহিনীর প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে মানবাধিকার ইস্যুর মধ্যে জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত রয়েছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে বৈঠককালে ফলকার টুর্ক জানতে চান, বাংলাদেশে অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করা সম্ভব কি না? জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করা সম্ভব নয়। আসিফ নজরুল বলেন, মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করা যায় কি না, সে বিষয়ে মি. টুর্ক কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তাকে বলা হয়েছে, বর্তমান বাস্তবতায় এটা সম্ভব না। বাংলাদেশের পেনাল সিস্টেম ও শত বছরের জাস্টিস সিস্টেমে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘যে ফ্যাসিস্টদের হাতে হাজার হাজার তরুণ নিহত হয়েছে, তাদের হত্যার বিচারকে সামনে রেখে হঠাৎ করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার প্রশ্নই আসে না। তা ছাড়া যেকোনো বড় ধরনের আইনগত পরিবর্তন সমাজ আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিল রেখে করতে হয়। তবে নিরাপত্তা এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়া সংস্কারে জাতিসংঘের কাছে সহযোগিতা চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এমন সময়ে রাজনীতির মাঠে নানা তুলকালাম কাণ্ড। রাজনীতির এ ডামাঢোলে দুই হাজার মানুষ নাই হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষাতেই থেকে যাচ্ছে। মাস্টারমাইন্ডরাও অনেকটা তালহারা। সব মাস্টার ইনোসেন্ট মাস্টার নন। একেক মাস্টারের একেক ধরনের মাইন্ড। কোনো কোনো মাস্টার নির্বাচনকে প্রলম্বিত করতে চান বলে আঁচ করছেন বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নেতারা। এই সময়ে বিএনপির ভূমিকা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর বাংলাদেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্রের মালিকানা ফেরা না ফেরা নির্ভর করছে। বিএনপির শীর্ষ ও মধ্য পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে চিন্তার বেশ ভিন্নতা। আবার ওয়ান ইলেভেনের শঙ্কায় ভোগার মহলও আছে। তারা ওয়ান ইলেভেনের প্রকল্পকে চলমান দেখছেন। দেশকে গণতান্ত্রিক শাসনে ফেরার পথে ডাইভারশন দেখছেন।
এ ডাইভারশনে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে স্নায়ুচাপের সংযোগ দেখছেন রাজনীতি-কূটনীতি পাঠপঠনে চৌকসরা। চীন বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে বিরোধের ‘মীমাংসা’ করতে ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিশ্চিত করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ায় ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময় বেইজিং চুক্তির জন্য ‘ইতিবাচক অনুমোদনের’ ইঙ্গিত দেন। এর মধ্য দিয়ে ‘ভারত ও চীন সীমান্ত চুক্তি শত্রুতা’ কমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশ দুটির এই চুক্তি বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় এরই মধ্যে সেই প্রভাবের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। চার বছর আগে ভারতের লাদাখে সংঘটিত সংঘর্ষে ভারতের অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সেনাসদস্য নিহত হন। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে থাকলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মধ্যস্থতায় চীনের সঙ্গে ভারতের সমঝোতা হয়। এবার রাশিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনের সময় ভারত ও চীন সীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হলো। পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত মিলে পাকিস্তান ভেঙে ফেলে। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যখন রুশ-ভারত এবং চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ হাসিনাকে ছাত্র-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করেছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশকে সহায়তাকারী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এই ত্রয়ী। এর জেরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বেশি বেড়ে যাচ্ছে এবং এই ত্রিশক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ওপর সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন নজর রাখতে হচ্ছে। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতার পেছনেও এর সংযোগ কিছুটা স্পষ্ট। তা বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে নতুন ব্যবস্থাপনারও ইঙ্গিত। আর বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত এখনো তার আগের আকৃতি-প্রকৃতিতেই আছে। ব্যতিক্রম কেবল প্রকাশে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ফাঁকফোকরের সুযোগ তারা নেবেই। এটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা।