Thikana News
০৭ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৭ জুলাই ২০২৪

পুতুলের বিয়ে!

পুতুলের বিয়ে!
মোহাম্মদ সোহরাব আলী

পুতুলেরও বিয়ে হতো-এ যুগের ছেলেমেয়েরা হয়তো জানেই না। আগের দিনের ছেলেমেয়েরা পুতুলের বিয়েকে কেন্দ্র করে কতই-না মজা করত। কীভাবে পুতুলকে সাজাবে-বিয়ের দিনে এ নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। বিয়েতে একটা পালকিরও ব্যবস্থা রাখা হতো। সেই পালকি বানানো হতো দেশলাইয়ের কভার দিয়ে। চারটি দেশলাইয়ের কভারের ভেতরের অংশটা আলাদা করে একটার মধ্যে আরেকটা ঢুকিয়ে দিয়ে সুন্দর করে পালকি তৈরি করা হতো। দুই পাশ দিয়ে পাটখড়ি চিকন করে ঢোকানো হলে একেবারে পালকির মতো মনে হতো। 

সাদা পাটখড়ির ওপর কলম দিয়ে এঁকে কালো রং করা হতো। থাকত নাচ-গানের আয়োজন। একটা ভ্রমর ধরে দেশলাইয়ের কভারে ঢুকিয়ে হাত দিয়ে টোকা দিলে ভোঁ ভোঁ করে শব্দ করত। আবার থালা বা বাটির ওপর ছোট একটা লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে ঝনঝন শব্দ করানো হতো। কাঁঠালের বা কলার পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে পুঁ পুঁ করে শব্দ করা হতো। অনেক সময় একটা মোটা পাটখড়ির সঙ্গে আরেকটা মোটা পাটখড়ি ঢুকিয়ে খড়ির মধ্যে একটু কেরোসিন দিয়ে প্যাপু প্যাপু শব্দ করানো হতো। দেশলাইয়ের বারুদ দিয়ে বোমা ফোটানো হতো। কার ছেলেপুতুলের সঙ্গে কার মেয়েপুতুলের বিয়ে হবে, সেটাও ঠিক করা নিয়ে চলত নানা আয়োজন।

পুতুলের বিয়ের দিনে অনেক ছেলেমেয়ের একসঙ্গে সমবেত হওয়া ছিল উৎসবের মতো। পুতুলের বিয়ে হবে আর সেই পুতুল ভালোভাবে সাজানো হবে না-এটা হতে পারে না। পুতুল তৈরি করা হতো ছেঁড়া জামাকাপড় দিয়ে। মেয়েপুতুলের চুল বানানো হতো বিভিন্ন রঙিন সুতা দিয়ে। আর ছেলেপুতুলের মাথার চুল বানানো হতো পাতিলের নিচে লেগে থাকা কালো কালি দিয়ে। অনেক সময় ছেলেমেয়েরা দর্জির দোকানে গিয়েও কিছু কাটা জামাকাপড়ের অংশ সংগ্রহ করত। এই কাপড় দিয়ে পুতুল সুন্দর করে সাজানো হতো, বিশেষ করে মেয়েপুতুলটা অনেক সুন্দর করে সাজানো হতো।

পুতুলের বিয়ে হবে-একটা ঘরের ব্যবস্থা তো করতে হবে। কলাপাতা কেটে টিন বানানো হতো আর বাঁশের কঞ্চি কেটে খাম বানানো হতো। চারপাশে গামছা দিয়ে বেড়া দেওয়া হতো। আর কলাগাছের খোলস দিয়ে খাট বানানো হতো। বিয়েতে দুই পক্ষের লোককে দাওয়াত দেওয়া হতো। কখনো ছাগল আবার কখনো গরু বানিয়ে বলাকা ব্লেড দিয়ে জবাই করে ছোট মাটির পাতিলে রান্না করে কাঁঠালের পাতায় করে খা খা বলে মুখের কাছে নিয়ে দূরে পাতাসহ খাবার ছুড়ে মারা হতো।

কী মধুময় আনন্দের ছিল আগেকার দিন! সকালে বা বিকেলে বসে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করত। খেলা শেষ হলে খেলার ঘর সবাই একসঙ্গে লাথি দিয়ে আবার ভেঙে ফেলত। ছোটরা তাদের পুতুল বিয়ে দিত আর বড়রা এসে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন। একটা পলিথিনের ব্যাগে খেলনাগুলো ভরে রাখা হতো। যার যা খেলনা আছে, তা নিয়ে এসে সবাই এক জায়গায় সমবেত হয়ে কত আগ্রহসহকারে খেলাধুলা করত। পুতুলের বিয়েতে পিঠা তৈরি করার হিড়িক পড়ে যেত। পিঠা তৈরি করার জন্য ছিল ধুলা ও পানি। একসঙ্গে ধুলা জমা করে পানি ঢেলে পিঠা তৈরি করা হতো।

মেয়েপুতুল বিয়ে করে ছেলেপুতুল যখন তার বাড়িতে নিয়ে যেত, সেই মেয়েপুতুলের জন্য কান্নাকাটি করা হতো। কবি জসীমউদ্্দীন তার কবর কবিতায় লিখেছেন, পুতুলের বিয়ে ভেঙে যাবে বলে কেঁদে ভাসাত বুক। পুতুল বানিয়ে সেই পুতুলকে বাচ্চারা আবার কোলে করে রাখত। অনেক সময় বাচ্চারা একে অপরের পুতুল লুকিয়ে রেখে মজা পেত। পুতুল হারিয়ে গেলে খোঁজাখুঁজি করা হতো। পুতুলের জন্য কেউ আবার মায়াকান্না করত। হারিয়ে যাওয়া পুতুল ফিরে পেলে কী আনন্দ পেত! কাঁঠাল, আম বা বটগাছের তলায় বা খড়ের পালার কাছে বাচ্চারা সমবেত হয়ে পুতুল খেলা খেলত। একসঙ্গে বাচ্চারা অল্প সময়ের মধ্যে জমা হতো। আগে ছিল কাঁসার বদনা। সেই বদনায় করে পানি নিত। মাঝেমধ্যে কাঁসার বদনার মধ্যে মাটি-পানি দিয়ে মিকশ্চার করত। সেই বদনা দেখে মায়েরা শক্ত বকুনি দিত। কখনো তারা পেঁপের ডাগুর কেটে মাটির মধ্যে পুঁতে রেখে ধানক্ষেত বানিয়ে পানি দিত। 

গা ও জামাকাপড়ে মাটি লেগে যেত। মাটিতে ঘোষ খেলে সারা গায়ে কাদা জড়িয়ে বাসায় এসে টিউবওয়েলে কাঁসার বদনা দিয়ে গোসল করত। আজ অমুকের পুতুলের সঙ্গে অমুকের পুতুলের বিয়ে হবেÑতা নিয়ে কথাবার্তা বলা হতো। কখনো ফাঁকা মাঠে বসেও ছেলেমেয়েরা পুতুলের বিয়ে দিত। বাচ্চারা কত হাসি-তামাশা করত পুতুলের বিয়ে দেওয়া নিয়ে। আবার মাঝেমধ্যে পুতুলের বিয়ে দেওয়া নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। ঝগড়া লেগে কখনো পুতুলের বিয়ে ভেঙে যেত। সেই পুতুলের বিয়ে দেওয়া খেলা এ যুগের ছেলেমেয়েরা খেলে না। তারা সহপাঠীদের সঙ্গে একত্রও তেমন হয় না। আজ তারা বাসায় বসে ভিডিও গেম খেলে, কার্টুন দেখে। বর্তমান টেকনোলজি তাদের অনেকটা একা করে ফেলেছে। বাচ্চারা আজ আমাদের সেই অতীত ঐতিহ্য পুতুলের বিয়ে ভুলে যেতে বসেছে। তাদের মননশীলতা বিকশিত হচ্ছে না। তারা সৃজনশীলতা হারাচ্ছে। তারা একের পর এক গেম খেলায় ব্যস্ত। ফলে অনেকের চোখের সমস্যা, ব্রেনের সমস্যাÑকত সমস্যা যে হচ্ছে। অথচ সেই আগের ছেলেমেয়েরা সারা দিন কত হই-হুল্লোড় করত। কত আনন্দে মেতে থাকত। এ যুগে সেই পুতুলের বিয়ে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে, বলা চলে।

কমেন্ট বক্স