Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

ছোটগল্প-জবানবন্দী

ছোটগল্প-জবানবন্দী
শিউলি নামের মেয়েটি কতক্ষণ যাবৎ পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসে আছে, তা তার মনে নেই। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও হালকা জামাকাপড় পরেই বসে আছে। আপন মনে কী যেন বিড়বিড় করছে। নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটনের সেন্ট্রাল পার্কে শীতের এই সময়টাতে তেমন কোনো দর্শনার্থী এদিকটায় আসে না। যাদের কোনো কাজকর্ম নেই, অলস সময়টা পার হতে চায় না এমন কেউ কেউ এখানে এসে কিছুটা সময় পার করে।
শিউলির বিষয়টা অন্য রকম। সুন্দরী-রূপবতী বলতে যা বোঝায় তা-ই। বয়স ২৮-৩০ হবে। ছিমছাম পরিপাটি। হালকা মেকআপ দেওয়া, তবে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। হঠাৎ শিউলি খিলখিল করে হেসে উঠল। লেকের পানিতে যেন ছোট্ট ঢেউ খেলে গেল। শিউলি ভাবে, পানিতে কেন এত ঢেউ। এ কি তার মনের ভুল। আবারও হাসে ঢেউ দেখে। মনে মনে ভাবে, কী তার সম্মোহনী শক্তি। আবার হাসে।
একটু দূরে বসে এই দৃশ্যটি দেখছিল শফিক। বয়স ৪৮-৫০ হবে। বাঙালি মনে করে একটু কাছে এগিয়ে শিউলির কাছে গিয়ে বলল, ‘আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ এ কথা শুনেই শিউলি থমকে গেল। আপাদমস্তক ভালো করে শফিকের দিকে তাকাল। অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, ‘তুই কী সাহায্য করবি, তোকেই তো আমার সাহায্য করা দরকার।’
শফিক ভয় পেয়ে গেল। একজন সুন্দরী মেয়ের মুখে এ কেমন ভাষা? অশরীরী কিছু ভেবে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল।
শিউলি আবার খিলখিল করে হাসতে থাকল। শফিক একবার পেছন দিকে তাকাল, আবার দ্রুত গতিতে প্রস্থান করল।
শিউলি খুব মজা পেল। শিউলির ধারণা এসব আগন্তুককে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে জীবনে শুধু সমস্যাই বাড়ে। আসলেই কি শফিক শুধুই আগন্তুক?
শিউলি দ্রুত পা চালায়। কখন যে তার বাসার সামনে চলে এসেছে, তা বুঝতে পারেনি। ঘরে ঢুকবে, তাই চাবি খুঁজে পাচ্ছে না। পার্কে ফেলে আসেনি তো? তার ভ্যানিটি ব্যাগে খুঁজতে লাগল। এমন সময় দেখল তার সামনে একজন দাঁড়ানো, বলল, ‘চাবি খুঁজছেন? আপনি মনে হয় পার্কে ফেলে এসেছিলেন।’ শিউলি মাথা ঘুরিয়ে দেখে, এ যে শফিক, পার্কে যাকে শাসিয়েছিল। শিউলি ভাবে, এ কেমন করে সম্ভব? শফিক কি তাহলে তাকে অনুসরণ করছে? দুর্বল হলে চলবে না, তাকে আরও শক্ত হতে হবে।
-এটা আমার চাবি নয়। আপনি কেন আমাকে অনুসরণ করছেন?
-আপনিই তো আমাকে অনুসরণ করছেন।
-না, আপনি।
-আমি? প্রশ্নই ওঠে না। এটা আমার বাড়ি।
-কী আজগুবি কথা বলছেন। গত পাঁচ বছর যাবৎ আমি এ বাড়িতে আছি। আর আপনি বলছেন এটি আপনার বাড়ি?
শিউলি এবার রেগে গিয়ে বলল, আপনি একজন পাগল, প্রতারক। চিকিৎসা প্রয়োজন।
শফিক এবার শান্ত হয়ে বলল, আপনি কি মানসিক ডাক্তার? আমাকে চিকিৎসা করতে বলছেন।
-হ্যাঁ, আমি ডাক্তার। আপনি কেন আমাকে ডিস্টার্ব করছেন?
-আমি তো আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না। সহযোগিতা করতে চেয়েছি মাত্র।
-তা তো দেখতেই পারছি। আপনিই তো আমার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, আপনি। -ত ১০ বছর যাবৎ আপনি আমার পেছনে লেগে আছেন। বাংলাদেশে তো ভালোই ছিলাম।
-আমি কী করলাম? আমি তো সব সময় আপনাদের পরিবারের পাশে থাকতে চেয়েছি। আমি আমেরিকা থাকি। যখন যা পেয়েছি আপনাদের সহযোগিতা করতে চেয়েছি। তুমিই তো সব এলোমেলো করে দিলে।
-আমাকে ‘তুমি’ করে বলছেন কেন? আমি আপনার কে হই?
-সরি, ভুল হয়ে গেছে। তুমি আমার কখনো কেউ ছিলে না, সবই ছিল অভিনয়।
-কী বলছেন এসব। আমি আপনাকে চিনি না।
-এখন তো চিনবেন না। আপনি ছাত্রী ভালো। মেডিকেলে ভর্তি হবেন। কিন্তু পরিবারের সামর্থ্য নেই। সেই সময় আমিই তো আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আমেরিকান সিটিজেন আমি। তাই আমাকে মিথ্যে প্রলোভনের মাধ্যমে প্রেমের অভিনয় করেছেন, যাতে আপনি আমেরিকা আসতে পারেন।
-আমি? আপনি ভুল করছেন। পৃথিবীতে একই রকম চেহারার ৮ জন মানুষ থাকে। তাই হয়তো আপনি অন্য কারও সাথে গুলিয়ে ফেলছেন।
-হয়তো তা-ই, হয়তো না। রবিন এখন কোথায়। তাকে জিজ্ঞেস করো আমি কি আসল শফিক, নাকি ৮ জনের একজন, অন্য কেউ?
-কে রবিন? আমি তাকে চিনি না।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। এখন তো রবিনকেও চিনবে না।
-আপনি যান তো, বিরক্ত করবেন না। পুলিশ ডাকব কিন্তু, তখন বুঝবেন মজা।
-হ্যাঁ, সেদিনও তো পুলিশ ডেকেছিলেন। সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন আমি আপনাকে অত্যাচার করি, মারধর করি। আপনি আমার সাথে আর থাকতে চান না।
-হ্যাঁ, বলেছি। আপনার প্রথম স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে কেন চলে গেল, তা তো একবারও বলেননি। যাক সেসব কথা, আমি সব ভুলে গেছি।
-সব ভুলে গেলে? তোমার প্রেমের ফাঁদে পড়ে আমি তোমাকে বিয়ে করলাম। আমেরিকায় নিয়ে এলাম। তুমিও এই দেশের সিটিজেন হলে। তখনো কি আমি জানতাম, আরও কত দুঃসময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
-আপনি চলে যান। আপনার সাথে আমার বয়সের যে ব্যবধান, তাতে কী করে ভাবলেন আপনার সাথে আমার সংসার হয়েছিল?
শিউলি-শফিকের হট্টগোল শুনে দুজন পথচারী এগিয়ে এল। তারা জিজ্ঞেস করল, কোনো সমস্যা কি না। শিউলি বলল, না, ধন্যবাদ। পথচারীরা চলে যায়। শিউলি চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। এক গ্লাস পানি খেয়ে চেয়ারে বসে। তারপর গরম কফিতে চুমুক দেয়। হঠাৎ মনে হলো চাবি কোথা থেকে এল। এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলল। শফিক কোথায়? গরম কফি কোথা থেকে এল?
-কফিতে তো চিনি এক চামচ খেতে। দেখো ঠিক আছে কি না?
পরিচিত একজনের কথায় পেছন ফিরে তাকায়। রবিন দাঁড়িয়ে তার সামনে, একজন স্মার্ট যুবক। বয়স ৩০-৩২ হবে।
-তুমি কোথা থেকে এলে? এখানে কেন? আবার কী চাও? তোমার প্রলোভনে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।
-আমিও তো। তুমি কীভাবে নিঃস্ব হলে?
-রবিন, প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও। পার্কে গেলাম সেখানে শফিক। ঘরের দরজায় শফিক। ঘরের ভেতরে তুমি, আমাকে কি একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না?
-দেখো আমিও তো শান্তিতে নেই। আমারও তো জীবনটা শেষ।
Ñতোমার কথায় আমি শফিককে বিয়ে করে আমেরিকায় এলাম। কথা ছিল বিয়ের পর আমি সিটিজেন হয়ে শফিককে ডিভোর্স দিয়ে তোমাকে বিয়ে করব। লোকলজ্জার ভয়ে ডিভোর্স না দিয়ে খাবারের সঙ্গে স্নো-পয়জন দিয়ে ধীরে ধীরে শেষ করে দিয়েছি শফিককে। তারপর তোমাকে নিয়ে সুখের সংসার শুরু করার দিন গুনলাম।
-আমিও তো তা-ই চেয়েছিলাম।
-আমার সঙ্গে বিয়ের পর তোমারও এই দেশের কাগজপত্র ঠিক হয়ে গেল। প্রথমে গ্রিন কার্ড, তারপর সিটিজেন। তারপর তুমিও একদম বদলে যেতে থাকলে।
-আমারও মনে সন্দেহ হতে শুরু করল। আমাকে পাওয়ার জন্য শফিককে শেষ করে দিতে পারলে। একদিন হয়তো আমাকেও শেষ করে দিতে পারবে কোনো স্বার্থের জন্য। তাই আমি ভয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চেয়েছি।
-শফিক কেন বারবার আমার সামনে দেখা দেয়। শুনেছি, ও তো মারা গেছে।
-শফিক তো আমার সামনেও দেখা দেয়। এখনো সহযোগিতা করতে চায়।
-মৃত মানুষ কী সহযোগিতা করবে?
-তা কী করে সম্ভব? শুনেছিলাম শফিক মারা গেছে।
-তুমিও তো জীবিত, শুনেছিলাম অপঘাতে তোমার মৃত্যু হয়েছে। তাহলে এত দিন পর এখানে কীভাবে এলে?
-অপঘাত নয়, এটাও ছিল তোমার পরিকল্পনা।
-তুমি মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর, ধোঁকাবাজ।
এমন সময় শফিক উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
শফিক : তোমরা দুজনই স্বার্থপর, যে যার অবস্থান থেকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছ।
রবিন : তুমি কোথা থেকে এলে?
শফিক : তোমাদের সাথেই আছি। ভেবেছ এত সহজেই তোমাদের ছেড়ে দেব?
শিউলি : আবার তুমি কী চাও?
শফিক : তোমাদের পরিণতি দেখার জন্য আছি। এই যে রবিন, তোমার সিলভিয়ার খবর কী?
রবিন : কে সিলভিয়া?
শফিক : বাহ্, তুমি যার সাথে প্রেমে মজেছিলে। দুজনে মিলে শিউলিকে শেষ করার পরিকল্পনা করেছিলে। রাতদিন পানশালায় বসে মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নতুন দিনের রঙিন স্বপ্ন দেখতে।
শিউলি : (রবিনের দিকে তাকিয়ে) কে সিলভিয়া? তুমি আমাকে এভাবে ধোঁকা দিলে?
রবিন : শফিক মিথ্যা বলছে। আমি কোনো সিলভিয়াকে চিনি না।
শফিক : তা তো ঠিকই বলেছ। সিলভিয়াও তো এখন অন্যের বাহুবন্ধনে উচ্চাভিলাষী দিন যাপন করছে।
শিউলি : শুনেছিলাম অতিরিক্ত মদ্যপান করে গাড়ি চালাতে গিয়ে এক্সসিডেন্ট করে তুমিও মারা গেছ।
রবিন : তুমি মিথ্যাবাদী, কল্পনার জগতে বসবাস করছ।
শিউলি : আমার গাড়ি এক্সসিডেন্টের জন্যও তুমি দায়ী।
রবিন : না। আমি কেন দায়ী হব। আমিও তো ভালো নেই। চারপাশে এত রক্ত কেন? আমি কোথায়? বাইরে পুলিশ কেন?
শিউলি : কী হচ্ছে এসব। আমি, শফিক, রবিন, সিলভিয়া। হয়তো আরও কোনো চরিত্র বের হয়ে আসবে।
শফিক : স্বপ্ন কেন চলে যায়? বাঁচতে চেয়েছিলাম। সুন্দর পৃথিবী বড় ভালোবাসি।
শিউলি : আমিও বড্ড ভালবাসি। ‘মা’ হতে চেয়েছিলাম। সুখের একটি সংসার হবে, ফুটফুটে একটি সন্তান, আহ্...
রবিন : আমিও তো স্বপ্ন দেখছিলাম আগামী সুন্দর দিনের।
শিউলি : কেন এমন হয়?
রবিন : কেন এমন হয়?
শফিক : কেন এমন হয়?
গবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমরা কি সকলেই অপরাধী?’
ঘরের ভেতরে এসব শব্দ শুনে একজন পথচারী পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে বলে, লং আইল্যান্ডের এই বাড়িটি গত পাঁচ বছর যাবৎ পরিত্যক্ত। অনেক পথচারী প্রায়ই পুলিশ কল করে আসতে বলে। আসলে এখানে কেউ থাকে না। তবু গভীর রাতে হট্টগোলের শব্দ ভেসে আসে প্রতিনিয়ত।
লেখক : সম্পাদক, ইউএস বাংলা নিউজ, নিউইয়র্ক।
প্রধান সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, যুক্তরাষ্ট্র।

কমেন্ট বক্স