Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

প্রেম ও প্রার্থনার মূর্ত প্রতীক

প্রেম ও প্রার্থনার মূর্ত প্রতীক
প্রেম মানুষের মনুষ্যত্ববোধের সত্যিকার অলংকার। যত প্রেম তত পূর্ণতা। প্রেমের ভরপুর পূর্ণতার মাধ্যমে একজন মানুষের ইহকাল-পরকালের জীবন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পিত সত্তার সত্যিকার স্বরূপকে অবলম্বন করেই বাংলা সাহিত্যের সত্যালোকে সুপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন। পুণ্য-প্রেমের আলোকপ্রভা তাঁর জীবনের পর্বে পর্বে বিস্ময়করভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রেম সর্বদা অবিনশ্বর। প্রেমের মধ্য দিয়ে প্রার্থনার পথ খুলে যায়। প্রেম দ্বারা মূলত প্রশান্তির পথ অবারিত হয়। অন্তরের গহিন কোণ থেকে দীপ্যমান আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। জীবনের পর্বে পর্বে আলোকরশ্মির অনুরঞ্জন ঘটে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ বলেন :
‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
এবার হৃদয়মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।’
একই সঙ্গে প্রার্থনার মিলিত সম্মোহনে স্রষ্টার কাছে নিবেদনÑ
‘যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু
এবার এ জীবনে
তবে তোমায় আমি পাই নি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।’
কবিগুরুর গভীর প্রেমানন্দ এবং প্রেমের কত রকম দুঃখের কথা তাঁর অসীম কাব্যধারায় ‘গীতাঞ্জলি’তে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার কখনো দেখি মুগ্ধতার সৃষ্টি ছোঁয়ায় স্রষ্টার অপার সৃষ্টির মহিমায় গেঁথে দিয়ে গেছেন তাঁর অমোঘ ছন্দময়তায়। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে সবকিছুই সুন্দর, মধুরালোকের আনন্দে মাতোয়ারা। কবিগুরুর মহানন্দে সবকিছুই উদ্বেলিতÑ
‘প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলক-ভূলক
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।’
রবীন্দ্রনাথ আস্তিক্যবাদী ছিলেন। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ। তবে ‘ঠাকুর’ পদবি পূর্বে ছিল না। ইংরেজ আমলে রবীন্দ্রনাথের ষষ্ঠতম পূর্বপুরুষ পঞ্চানন ‘ঠাকুর’ পদবি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর উত্তরসূরিরা ঠাকুর হিসেবে পরিচিতি পান।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ ‘হিবার্ট লেকচার’ দেন। তার ভিত্তিতে ‘মানুষের ধর্ম’ নামক একটি বই রচিত হয়। বইটি ইংরেজি ভাষায় লন্ডন থেকে ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়।
শুরুতেই বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ বেদ-বাইবেল থেকে কোরআন শরিফ পর্যন্ত পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে অনুভব করেছিলেন, সব ধর্মগ্রন্থ প্রায় একই কথা বলছেÑকীভাবে ভালোবাসার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়! রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্মের পরিভাষা অনেক গভীর এবং অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মতো।
ধর্মের মহানুভবতার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাংলার বাউলদের সম্পর্কে মানবধর্মের বড় উপাদান বলতেও দ্বিধা করেননি। কেননা বাউলরা কোনো প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করে না। সবাই বাউল হতে পারে। বাউল হতে কারও বাধা নেই। ‘মানুষের ধর্ম’ (১৯৩৪) গ্রন্থে দর্শনের নানা জটিল বিষয়ানুষঙ্গকে তিনি যে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
জীবনের পরতে পরতে মহামহিম স্রষ্টার প্রবলতর মহিমার শেষ নেই। সেই মহিমা থেকে কিছুটা মানুষের জন্য বরাদ্দ। ঐ আকাশের দিকে যখন তাকাই। পুণ্যবান হই তারই ঝলকে। তাই নিজের আকুতিকে নিজেই ব্যক্ত করি গুনগুনিয়েÑ
‘যদি চাহো, হতে পারো প্রেমময়
তবে, স্বকীয় শতরূপে হয়ে ওঠো পুণ্যবান
পরিপূর্ণ পুণ্যতায়...।’
রবীন্দ্রনাথ বিনিদ্র তপস্যায় জীবনসাহিত্যে মানুষের অন্তর্নিহিত মনস্তত্ত্বের চিরন্তনী রূপকে নানান আঙ্গিকে, বিচিত্র বৈভবের রূপ দিয়েছেন। শিল্প-সাহিত্যের মহাসমুদ্রে মানুষের জীবনের অনন্ত মায়াকে আনন্দ, বেদনা ও বিরহ-বিদ্রƒপের তুলিতে সুন্দরতম অবয়বে এঁকেছেন। সে কথা ভেবে তাঁরই ভাষায়Ñ
‘আমারে ফিরায়ে লহ অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে, বিপুল অঞ্চল-তলে। ওগো মা মৃন্ময়ী, তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই...’
ধর্ম বরাবরই ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাসঙ্গিক দিক। ধর্মদর্শন ছাড়া ভারতীয় সাধারণ জীবনপ্রবাহ অসম্ভব। রাজনৈতিকভাবে ধর্মের ব্যবহার লক্ষণীয়। যেখানে রাজনীতি ধর্ম ছাড়া অচল, সেখানে দাঁড়িয়ে বাঙালির গুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে ধর্মের পরিভাষা কী, তা জেনে নেওয়া জরুরি।
আগেই উল্লেখ করেছি, পিতার হাত ধরে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচর্চা অথবা ধর্মবিষয়ক পড়াশোনা শুধু হয়েছিল ছোটবেলাতেই। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রদের বেদ ও উপনিষদের শ্লোকগুলো আবৃত্তি করাতেন। রবীন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের পুরোধা। এ ছাড়া তিনি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের অনুরাগী। পিতার জীবনে বেদ, উপনিষদ ছিল আদর্শ। বাবার এই উপনিষদ শিক্ষা এবং জ্ঞান গভীর প্রভাব ফেলেছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে।
ধর্মসচেতনতার জন্য মাত্র ২৩ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে ব্রাহ্ম সমাজের সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের সমাজ-সচেতনতার জন্য হিন্দুসমাজের গোঁড়ামিগুলোর বিরুদ্ধে বারবার আওয়াজ তুলেছেন, কলম ধরেছেন। তবে সবকিছু পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়। আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন, আমি পঙ্্ক্তিহীন, আমি তোমাদেরই লোক।’
বিপরীতে হিন্দুসমাজ ব্রাহ্ম সমাজকে নিয়েও সমালোচনা করতেন। ফলে একে অপরের রুচিশীল সমালোচনা চলত দীর্ঘ দিন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দুসমাজ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে নিয়মিত দুটো ভিন্ন পত্রিকায় সমানুপাতিকভাবে লেখালেখি করতেন।
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সর্বাবস্থায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রেম বিলিয়েছেন। শত দুঃখের কথা শতবার গেয়ে তিনি আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত আনন্দের কলতানে নিখাদ প্রেম ছড়িয়ে দিয়েছেন। ইবাদত, পূজা কিংবা উপাসনা হচ্ছে প্রার্থনারই নির্মল আনন্দ, যা মানুষের সকল মলিনতা বিদূরিত করে স্রষ্টার সমীপে নিষ্কণ্টকভাবে হাজির করে। পূজার কথায় তিনি একটি গানে বলেন :
‘জানি গো আজ হা হা করে
তোমার পূজা সারা হবে
নিখিল-অশ্রু সাগর কূলে ॥’

‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একলা রয়েছে নীরব শয়ন-পরে
প্রিয়তম হে জাগো জাগো জাগো ॥’
নারীকে চির যৌবনার সৌন্দর্যে মূর্তিমান করে তিনি বলেন :
‘নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল
বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটিছে বাহিরে
সৌরভসুধায় করে পরাণ পাগল।’
শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের মোহনীয়তার সঙ্গেই কবির অনুভূতিকে মেলানো যায়। যেন এই কবি পৃথিবীর সকল প্রান্তেই বিচরণ করছেন। প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। কবিগণ এমনই হয়ে থাকেন। এমনই হওয়া উচিত। এটাই তো স্বাভাবিক এবং এতেই মানুষের আনন্দ। যেমন মহাস্রষ্টার সৃষ্টিশীলতার আনন্দে কবিগুরু অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দেন :
‘আকাশতলে উঠল ফুটে
আলোর শতদল।
পাপড়িগুলি থরে থরে
ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে
নিবিড় কালো জল।’
আবার সেই আকাশতলে দাঁড়িয়ে নিবিড়তর শান্ত ছায়ার আঁধারবাহিকায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান মুক্ত বাতাসের সুখানন্দের নিবিড় ছায়ায় :
‘মুক্ত করো হে মুক্ত করো আমারে
তোমার নিবিড় নীরব উদার
অনন্ত আঁধারে।’
নিষিক্ত আঁধারের মধ্যেই শুভ্রানন্দের সন্ধান পেয়েই যেন মহামানবদের মতো রবীন্দ্রনাথও স্বর্গের আলোপ্রাপ্ত হয়ে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি ছিল সূক্ষ্ম। তিনি মাটির গন্ধ, পাখির গান ও গোধূলির আলোর কাছে নিজেকে ঋণী ভাবতেন।
তিনি যখন ধ্যানে বসতেন, অঙ্কুর গজানো শব্দ পেতেন।
প্রকৃতির সৃষ্টির প্রতি যদি নিঃশব্দ সাধনার মাধ্যমে চিন্তার কপাটগুলো খুলে দেওয়া যায়, তাহলে যেমন মনের জানালা অবারিত হবে, তেমনি ঈশ্বরের প্রতিও বিশ্বাসের পথ সুগম ও অবারিত হয়ে উঠবে। ঈশ্বরকে ধর্মের বিনীত বর্ণনায় যতই ব্যাখ্যা করা হোক, নিখিল বিশ্বের নিয়মতান্ত্রিক নিয়ামক চৈতন্য দ্বারা এবং মানুষকে নির্মোহ ভালোবাসার মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া সম্ভব। স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্যের ওপর গবেষণা দোষের নয়। কিন্তু সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরকে পাশ কাটিয়ে, নিজের খেয়াল-খুশিতে চলা উচিত নয়।
বুঝে না বুঝে যারা রবীন্দ্রনাথের সমালোচনায় মুখর থাকেন, একপেশে হিসেবে সেটি স্থূলচিন্তায় রবীন্দ্রনাথকে বিচার করেন, সেটি মোটেই ঠিক নয়। কাউকে বিচার করতে গেলে তার ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই যে সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে সেটি আরও বেশি প্রযোজ্য। আধুনিক বিজ্ঞানে সেই বোধসত্তাকে সামনে রেখে শিল্প-সাহিত্যের ক্রমবিকাশ মানুষের চিন্তাশক্তির অনেক সম্প্রসারণ ঘটেছে। কিন্তু প্রেমের যথার্থ মূল্য এখনো আজও সমাজে সমান মর্যাদা পায়নি। এ জন্য সুশীল সমাজ বিনির্মাণেও সাহিত্যমনস্ক কবি-সাহিত্যিকের ভূমিকা আরও বেশি থাকা প্রয়োজন।
আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেতনের একটি চিরন্তন বাক্য : knowledge is power সমগ্র শিক্ষাক্রমে স্থান পেলেও তার যথাযথ মূল্যমানে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রেম ও মানবিকতার সর্বব্যাপক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে আরও বেশি সুষম করে তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম আমাদের সেসব বিষয়ে আন্দোলিত করে তোলে। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ প্রকৃতির সবকিছুতে প্রেম ও প্রার্থনার সর্বক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথের দিশায় বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। সমাজ বিচ্ছিন্ন জনসমাজ নয়, জনসমাজকে মানবিকতার উন্নয়ন এবং তার উজ্জ্বলতর সিঁড়ির বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়। তিনি অবিনশ্বর ॥
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

কমেন্ট বক্স