জর্জেস মোহাম্মদ
সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই সিদ্ধান্ত নেয় নিখিল, প্রাণভরে গ্রাম ঘুরে দেখবে। হেমন্তের সকাল, শিউলিঝরা আঙিনা, পথের দু’ধারে ঘাসের খেলা। খাদ্যপুষ্টিতে ভরপুর ঘাস। জুঁইয়াদের বণিক বেসাতির পথচলা, যেন বেদুইন উটের কাফেলা। লাইন বেঁধে চলে সবাই। নানা পাখির সুর, কাঁচা মেঠো পথ, আহা কী মধুর। এই সকাল যেন শরতের জোছনাকে হার মানায়। স্নিগ্ধ সবুজে সোনামাখা আলো। ভালো লাগে পথঘাট, মাঠ। ভালো লাগে মঠের মাথায় বিরহী দোয়েলের সুর। শীতলাদেবীর সেই ছোট ফণীমনসার গাছ, মনোষা বুড়ির ছোট্ট কুঁড়েঘর। শনি মিস্ত্রির মজা পুকুরের গাঁদা ফুলে ঢাকা পাড়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নানা গ্রাম থেকে বড়-ছোট হরেক রকমের কাঠের গাছ কিনে ভিজিয়ে রাখা হয়। সারা বছর ওই গাছের কাঠ বানিয়ে বিক্রি করাই ছিল তার ব্যবসা। গত কয়েক বছরে ছত্রিশের বন্দরে ঘর তুলেছে, ছেলে দুলাল ও নারায়ণকে কলেজে পড়ালেখার সুযোগ দিয়েছে, মেয়ে নারানীকে হাইস্কুলে ভর্তি করেছে। নারানীর মায়ের চুলে নারিকেল তেল দেওয়া শুরু হয়েছে, মাঝে মাঝে মহাভিংরাজ কেশ তৈলের সুবাস আসতে শুরু করেছে। নারানী প্রতিবছর শরৎ-হেমন্ত সার বেঁধে রক্ত গেন্দা, হলুদ গেন্দা (গাঁদা) ফুলগাছ লাগায়। গাঁদা ফুল পুকুরপাড়ে, ঘাটের ধারে সুন্দর হয়। মানায়ও বেশ ভালো। যখন ফুল ফুটতে আরম্ভ করে, সারা পুকুরপাড় যেন এক বিশাল ফুলের বাগান। স্কুলে যাবার পথে গ্রামের ছেলেমেয়েরা যদি ফুল তুলে নেয়, এতে নারানীর কোনো আপত্তি নেই। প্রতিটি গাছই প্রায় গলাসমান লম্বা।
শত ডালায় অগণিত ফুল ফোটে। কতই-বা নেবে ছেলেমেয়েরা? তা ছাড়া স্কুলে ছেলেমেয়েরা ফুল ছোড়াছুড়ি করে বলে, নারানীর গাছের ফুল নিবি? এতে নারানী অফুরন্ত আনন্দ পায়। এটুকু আনন্দই নারানীর জীবনসাথি। অতি সামান্যতেই নারানী সন্তুষ্ট। এই তো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র নিখিল কুমার নারানীর ফুলের প্রশংসা করেছে, এতেই নারানী নিজেকে ধন্য মনে করে। হেমন্তে শুধু ফুলের জন্য পুকুরটা অতি গর্বিত আর কখনোই এই পুকুর কোনো কাজে ব্যবহৃত হয় না। কই, শিং মাছ ধরার জন্যও কেউ এই পুকুরে নামে না। স্নান করা, বাসনকোসন ধোয়া তো দূরের কথা; নবজাতকের পায়খানা-প্রস্রাবের কাঁথাও কেউ এখানে ধোয় না। সারা পুকুর ভরা কচুরি, কয়েক বছরেও পরিষ্কার করা হয়নি। নানা প্রকার গাছ ও পানি পচে সব সময় গন্ধ ছড়ায়। অনেকেই আপত্তি তুলেছে, গাছ যেন এই পুকুরে না ভেজানো হয়। গাছের মদা গন্ধ অনেকের কাছে খারাপ লাগলেও নিখিলের ভালো লাগত। ওই পুকুরের সবকিছুই নিখিলের ভালো লাগে। ঘন সবুজে ভরা পুকুর, মাঝে মাঝে বেগুনি আনারসের মতো কচুরি ফুল। হেমন্ত কালে তো পুকুরজোড়া কচুরি ফুল, যেন বেগুনি একটা ফুলের ডালা। পানি কমে গেলে এক কোণে কয়েকটি গাছের গুঁড়ির ওপর শুকিয়ে যাওয়া কচুরিপানায়ও এক গোছা ফুল ফুটে থাকে, যেন মাসি ঘাটের মাসি, কেউ তুলে নেয় না। সবাই দেখে যায়, ফুলদানিতে সাজায় না।
লেখাপড়ায় নারানীর নাম ছড়িয়েছে, এলাকার বাইরেও। কর্তারাই গাঁয়ের ভালোমন্দ দেখত, মাটি ও মানুষকে ভালোবাসত। রাজা হওয়ার নীতি ছিল না কারোরই। শান্তি ও উন্নতিই ছিল কাম্য; অশান্তি, অবনতি নয়। কর্তাশাসিত গাঁয়ের অনেক কর্তার আশীর্বাদের ছায়া পড়েছে নারানীর মাথায়। লেখাপড়ার কোনো অসুবিধা হলেই শৈন্যা মিস্ত্রি গামছা কাঁধে কোনো এক কর্তার বাড়িতে হাজির হয়ে যেত। কাঁধের গামছাটা তুলে দূরে সিঁড়িতে দুটি বাড়ি দিয়ে বসে যেত। কর্তাদের ভেতর অনেক ভাগ ছিলÑহিন্দু ও মুসলমান কর্তা, বড়কর্তা, ছোটকর্তা। নারানীর বাবা ওইসব কর্তার কাছে ছুটে যেত, যে কর্তারা মাঝে মাঝেই খোঁজ নিত। মেয়ের লেখাপড়ার জন্য শৈন্যা মিস্ত্রি কখনো পিছপা হয়নি। উপরে মা সরস্বতী, নিচে কর্তারা আছেন। তাদের কৃপায় যদি মেয়েটার মনের আশা পূর্ণ হয়। কর্তার ইচ্ছায় কীর্ত্তন হতে দেয়নি শৈন্যা মিস্ত্রি। অনেক কর্তাই বলেছেন, মণ্ডলের মেয়ে, এত পড়িয়ে লাভ কী? সুপাত্র দেখে তুলে দাও। বেশি পড়ালে পাত্র পাওয়া কষ্ট হবে। আইবুড়ি রেখে স্বর্গবাস নেওয়ার চেয়ে যা বলি তাই করো।
সব কর্তার গীত এক নয়। কোনো কোনো কর্তা চান ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করুক। গাঁয়ের মান বাড়ুক, একটু পরামর্শ বা সহযোগিতায় যদি গাঁয়ের মানসম্মান বাড়ে, তবে কেন হবে না? জাতধর্ম শিক্ষার ঊর্ধ্বে নয়। জ্ঞানই বড় ধর্ম। ভেতর বাড়ি থেকে মেজোকর্তা এলেন। লেখাপড়ার বিস্তারিত শুনে বললেন, তোমার মেয়ে যদি কষ্ট করতে চায়, তবে ঢাকা পাঠাও। চিন্তা করো না, আমিই ব্যবস্থা করব। মেয়েকে অজানা পরিবারের সঙ্গে রাখা উচিত হবে না। কয়েকটা বছরই তো। আমার নাতনিকে লেখাপড়া দেখিয়ে দেবে আর নিজেরটাও চালিয়ে যাবে। কষ্ট না করে কেউ বড় হতে পারেনি, বুঝে নিয়ো কথাটা। শিক্ষাই জীবনের মেরুদণ্ড, জাতির মেরুদণ্ড। যাও, এখন ঘরে গিয়ে বোঝো গে, কী করতে চাও। ঢাকায় যেতে নারানীর যতটা ভয় ছিল, অনেকটা কেটে গেল নিখিলদার কথা ভেবে। নিখিলদা ঢাকায় বড় হয়েছেন, আমাকে ছোট বোনের মতো জানেন। মাকেও বলেছেন, নারানী ঢাকায় পড়াশোনা করলে যোগাযোগ রাখবেন। সুবিধা/অসুবিধায় আমরা তো আছিই। নিখিলদার এইটুকু কথাই যথেষ্ট।
ঢাকায় গেল নারানী। নতুন জায়গা, নতুন মুখ। পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তার ঢং, রংচং সবই যেন অজানা। ক্লাসে প্রথম মাসে কেউই কোনো পাত্তা দিল না। পুঁথিগত জ্ঞানের সঙ্গে রুচিজ্ঞানও অতি প্রয়োজন।
তাল মিলিয়ে নিল নতুন ছাত্রসমাজের সঙ্গে। উদ্দেশ্য একটাইÑআরও ভালো করতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, আমারও যোগ্যতা তোমাদের চেয়ে কম নয়। তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তোমাদের স্বনামধন্য পরিবার, আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার পুরো গ্রাম। ভালো করল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছুটিতে এল না মায়ের কাছে। মা কাঁদে। শুধু একটাই উত্তরÑআশীর্বাদ করো মা, গাঁয়ের মুখ যেন উজ্জ্বল করতে পারি। করলও তা-ই। গ্রামে গেন্দা ফুল ফুটিয়ে স্কুলে নাম করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের ফুল ফুটিয়ে নাম করেছে। ভালো করার জন্য নিখিলদার সহযোগিতা ছিল অকল্পনীয়। লেখাপড়ার জন্য নতুন নতুন জায়গায় নিয়েছেনÑব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান কালচারাল সেন্টার, জার্মান ও রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, বেইলি রোডের মঞ্চনাটক। পুঁথিগত জ্ঞানের সঙ্গে বাইরের জ্ঞানের মিশ্রণে আরেক দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। নিখিলদার বিয়েতে নারানীকে ছোট বোনের পরিচয় দিয়ে, বড় জ্ঞানীজনের কাছে মান বাড়িয়েছে। জ্ঞানী লোকের সঙ্গে চলার যোগ্যতা দিয়েছে।
আজ মিস নারানী মণ্ডল নিজ গাঁয়ে মায়ের কাছে আসবে। শুধু মা বললে বাবার প্রতি অবিচার করা হবে। এই সেই বাবা নিজে অনেক মশার কামড় খেয়েছে, মেয়ের গায়ে বসতে দেয়নি। রাত জেগেছে তালের পাখায় বাতাস দিয়ে। অগ্রহায়ণ মাস হালকা শীত, নাইয়র এসেছে গাঁয়। থাকবে প্রায় তিন মাস। বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়। সেই গতবার দেখেছে দোয়েল বন, লেবুতল। সবুজের সঙ্গে কুয়াশার প্রেমলীলা, জড়োসড়ো প্রকৃতি। ধীরে ধীরে নাইয়র শীত জেঁকে বসবে। প্রবাদকে বাস্তব রূপ দেবে। আগনের শীত বাগনের গায়, পৌষের শীত ভৌষের গায়। মাঘের শীত বাঘের গায়। শীত প্রতিবছর নাইয়র আসে, আবার চলে যায় হিমালয়ে শ্বশুরবাড়ি।
আজই জেলা সদরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিয়েছেন ম্যাডাম শ্রীমতী নারায়ণী মণ্ডল। কাল-পরশু ছুটি। সোমবার থেকে কাজ শুরু। সরকারি বাড়ি, গাড়ি, ড্রাইভার, দারোয়ান, বাবুর্চি-আরও কত কী। প্রতিবছর শীত আসে বেড়াতে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ম্যাডাম মিস নারায়ণী মণ্ডল আসবেন, সবার মনে আগ্রহ, কৌতূহল। এখন তো আর শৈন্যার মেয়ে নারানী নয়। শ্রীমান শনি মণ্ডল বাবুর কন্যা মিস নারায়ণী মণ্ডল মহোদয়া। প্রতিবেশী টেপার মারও নারানী ডাকতে বুক কেঁপে ওঠে। তবে কী নামে ডাকবে? শুধু ‘মা’ সম্বোধনই উত্তম। সরাসরি বাড়িতে এলেন না ম্যাডাম নারায়ণী। বাবাকে নিয়ে চলে গেলেন মেজোকর্তার চিতায় তুলসী জল প্রণাম করতে। এই সেই মহাপুরুষ বদলে দিয়েছিল গাঁয়ের একটি মেয়ের জীবন। মাকে দেখার জন্য ব্যাকুল মন, সোজা নিয়ে যায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে। পথে যেতে হিন্দুবাড়িতে শুভসংবাদের উলু দেয়, মুসলমান বাড়িতে শুভ সংবাদের আজান। স্কুলের বারান্দায় মান্নান দফতরিকে পায়ে ধরে দোয়া চাইতেই বুকে জড়িয়ে ধরল অবহেলিত দফতরি। ঋষিদের সানাই আর ঢোলের শব্দে প্রধান শিক্ষকও বেরিয়ে এলেন। আশীর্বাদ দিলেন সেই ছোট নারানীকে। নারানী আর মায়ের সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই। সে এখন জাতীয় সম্পদ, সরকারি বড় আমলা। এ গাঁয়ের গর্ব, সম্মান। এ গাঁয়ের মেয়ে।