নিউইয়র্কে মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিরা এখন ফ্যাক্টর। কিন্তু সেই ফ্যাক্টরকে পুঁজি করে অন্যরা এগিয়ে গেলেও মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে না। বরং, মুলধারার নির্বাচনের আগে কমিউনিটির ঐক্যে যে ফাটল ধরে, এর রেশ চলে দীর্ঘদিন। অতিসম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে অ্যান্ড্রু ক্যুমো ও জোহরান মামদানিকে সমর্থন দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। চলছে কাদা ছোঁড়াছুড়িও।
আগামী ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে নিউইয়র্কবাসী তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচন করবেন। এর মাধ্যমে শেষ হবে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিজয়ী প্রার্থী হবেন সবার মেয়র। কিন্তু প্রার্থীদের প্রকাশ্য সমর্থন করার ক্ষত বাংলাদেশি কমিউনিটি বয়ে বেড়াবে দীর্ঘকাল। শুধু মেয়র নির্বাচন নয়, অতীতে সিটি কাউন্সিলসহ মূলধারার বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে এই ধারা অব্যাহত ছিল। এমনকী বাংলাদেশ সোসাইটি, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন ও চট্টগ্রাম সমিতিসহ আঞ্চলিক সংগঠনের নির্বাচনেও বাংলাদেশি কমিউনিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সৃষ্ট বিরোধ মনে পুষে রেখে তা পরিণত হয় ব্যক্তিগত শত্রুতায়।
২০২০ সালে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ মেয়র এরিক অ্যাডামসকে সমর্থন জানায়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মেয়র অ্যাডামস বাংলাদেশিদের মূল্যায়ন করেছেন। সিটির প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে একজন বাংলাদেশিকে বসিয়েছেন। নিজের নিরাপত্তায় তিনি বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশি একদল চৌকস পুলিশ কর্মকর্তাকে। কিন্তু দায়িত্ব পালনের শেষভাগে এসে মেয়র অ্যাডামস বাংলাদেশিদের কিছুটা এড়িয়ে চলছেন নানান কারণে।
এদিকে, ডেমোক্রেট মনোনয়ন দৌঁড়ে ছিটকে পড়ার পর মেয়র অ্যাডামস এখন পুনর্নির্বাচন থেকেও সরে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমানে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু ক্যুমো ও জোহরান মামদানি মাঠে রয়েছেন শক্তভাবে। বাংলাদেশিরা একতরফাভাবে জোহরান মামদানিকে সমর্থন দিচ্ছেন। তবে অতিসম্প্রতি কিছু বাংলাদেশি প্রকাশ্যে ক্যুমোর পক্ষে মাঠে নেমেছেন। দুই প্রার্থীর প্রচারণায় নেমে বাংলাদেশিরা একপ্রকার বিভেদে জড়িয়ে পড়েছেন। জোহরান মামদানি কোনো মসজিদে প্রচারণায় গেলে ক্যুমোকেও নিয়ে যাচ্ছেন তার বাংলাদেশি সমর্থকেরা। একইভাবে মন্দিরে পাল্টাপাল্টি আগমনের ঘটনাও ঘটছে।
মেয়র নির্বাচনে দুই প্রার্থী রাজনৈতিক প্রচারণা চালালেও বাংলাদেশিদের অনেকে বাহাসে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ মামদানিকে নিয়ে বলছেন- তিনি নাকি মন্দিরে গিয়ে নিজেকে হিন্দু দাবি করেছেন। তিনি নাকি মায়ের কাছ থেকে হিন্দু রীতি শিখেছেন, একথাও বলছেন। যদিও এসব কথা টুইস্ট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যুমোর ভোটের প্রচারণায়।
অন্যদিকে ক্যুমোর বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগগুলো সামনে আনছেন মামদানির সমর্থকেরা। কথিত যৌন হয়রানির অভিযোগে গভর্নর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন ক্যুমো। কিন্তু সেই অভিযোগকে সামনে আনছেন মামদানির সমর্থকেরাও। ডেমোক্রেট প্রাইমারিতে মামদানির কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হলেও নির্বাচনে তিনি লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে। নির্বাচনে অঘোষিতভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থন রয়েছে তার ওপর।
মেয়র নির্বাচনে প্রাইমারিতে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেও ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ নেতারা এখনো মামদানিকে এনডোর্স করেননি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। একইভাবে ডেমোক্রেট সমর্থকদের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্যুমোকে সমর্থন দিচ্ছেন। মুসলিম হিসাবে বাংলাদেশিদের অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছেন মামদানি, বিশেষ করে বাংলাদেশি মুসলমানরা তার পক্ষে সরব প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে, অ্যান্ড্রু ক্যুমো মাঠে নামায় বাংলাদেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ সরাসরি তার পক্ষে প্রচারে নেমেছেন। বাংলাদেশি মুসলমানরা সরাসরি মুসলিম হিসাবে মামদানিকে সমর্থন করার কথা বললেও বাংলাদেশি হিন্দুদের একটি অংশ ধর্মীয় কোনো বিষয় সামনে আনছেন না। তবে পরোক্ষভাবে তারা মুসলিম প্রার্থী মামদানির বিপক্ষে প্রার্থী হওয়ায় ক্যুমোকে সমর্থন দিচ্ছেন তা অনেকটাই ষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রচারণায়। কিন্তু সাধারণ ডেমোক্রেটরা মনে করছেন- ধর্মীয় বিষয় নির্বাচনি প্রচারে আসা উচিত নয়। মামদানির প্রচার অনুসরণ করে ক্যুমো মসজিদ-মন্দির দুই স্থানেই যাচ্ছেন। যদিও গত মাসে মসজিদ মিশন সেন্টারে প্রচারে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন ক্যুমো।
এদিকে গত ৮ অক্টোবর বুধবার জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন (জেবিবিএ) এবং ‘বাংলাদেশিজ ফর জোহরান’ যৌথভাবে আয়োজিত এক নির্বাচনী সমাবেশে যোগ দেন জোহরান মামদানি। কিন্তু এই সংগঠনের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ সোলায়মান হঠাৎ মামদানির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে ক্যুমোর প্রচারণায় যোগ দেন। এ নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ৮ অক্টোবর বুধবার অনুষ্ঠিত জেবিবিএ’র সমাবেশে অনেকে ফাহাদ সোলায়মানের সমালোচনা করেন। এমনকী ফাহাদ সোলায়মান জেবিবিএ’র কেউ নন বলে দাবি করেন তারা। জবাবে এক ভিডিও বার্তায় ফাহাদ সোলায়মান তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, নির্বাচনে কাউকে সমর্থন করা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মামদানি ও ক্যুমো নিয়ে আমাদের কমিউনিটিতে অনেক কিছু চলছে। এটা নিয়ে ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। আমি জেনেশুনে ক্যুমোকে সমর্থন দিয়েছি। এ ব্যাপারে আমাকে কেউ মোটিভেটেড করতে পারবে না। ফাহাদ সোলায়মান বলেন, আমি ধর্মের কথা বাদ দিলাম, মামদানি নির্বাচনে যে এজেন্ডাগুলো সামনে এনেছেন তা মেনে নেওয়া যায় না। কোনো ধর্ম তার এজেন্ডা সমর্থন করবে না।
তিনি অভিযোগ করেন, জেবিবিএ’র নাম ব্যবহার করা হয়েছে মামদানির প্রচারণায়। কিন্তু ৫১৩ সি/কে সংগঠন হিসাবে জেবিবিএ কাউকে এনডোর্স করতে পারে না। এই সংগঠনের ৪০০’র বেশী সদস্য রয়েছেন। তাদের কতজন মামদানিকে সমর্থন করেন তা জানা উচিত ছিল। ৮-১০ জন লোক জেবিবিএ’র নাম দিয়ে কাউকে এনডোর্স করলো, তা কাম্য নয়। তিনি বলেন, আমি জেবিবিএ’র সেক্রেটারি, অথচ আমার পদ এবং প্রতিষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যা অনাকাঙ্খিত।
হঠাৎ ক্যুমোকে সমর্থন দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ফাহাদ সোলায়মান ঠিকানাকে বলেন, আমি মনে করি- বাংলাদেশিদের সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। তা না হলে একতরফাভাবে সবাই মামদানিকে সমর্থন দিলে কোনোভাবে যদি ক্যুমো নির্বাচিত হন তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশিদের অবস্থান কী হবে তা ভেবে দেখা উচিত। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে কে কাকে সমর্থন দিয়েছে তা নির্বাচনের পর মনে রাখা উচিত নয়। বর্তমানে ক্যুমো ও মামদানিকে নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যে ফাটল ধরেছে তার অবসান হওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুলধারার রাজনীতিক, বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি এবং জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার ঠিকানাকে বলেন, অ্যান্ড্রু ক্যুমো গভর্নর থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি কমিউনিটি দূরের কথা, কখনো সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতেই আসেননি। অনেক চেষ্টা করেও তাকে আমরা আমাদের কোনো অনুষ্ঠানে আনতে পারিনি। বরং মামদানিকে যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা কাছে পেয়েছি। তিনি ফিলিস্তিনের পক্ষে বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার ছুটে এসেছেন। সাউথ এশিয়ান মুসলিম হিসাবে মামদানি প্রবাসী বাংলাদেশিদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন। এখন হঠাৎ করে কিছু লোক ক্যুমোর পক্ষে প্রচারণায় নেমে কমিউনিটির ঐক্য বিনষ্টের চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, কাউকে সমর্থন দেওয়া ডেমোক্রেটিক রাইটস হলেও কমিউনিটির বৃহৎ স্বার্থে ঐক্য বিনষ্ট করা উচিত নয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আমব্রেলা সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ ঠিকানাকে বলেন, কিছু লোক ব্যক্তি স্বার্থে ক্যুমোর পক্ষে প্রচারণায় নেমেছেন। তিনি ফাহাদ সোলায়মানের নাম উল্লেখ করেই বলেন, মামদানি তার (ফাহাদ সোলায়মান) একটি অনুষ্ঠানে যেতে না পারায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে মামদানির পক্ষ বদল করে ক্যুমোর পক্ষ নিয়েছেন। তিনি বলেন, বিগত মেয়র নির্বাচনেও ফাহাদ সোলায়মান স্কট স্ট্রিংগারের পক্ষে ছিলেন। নির্বাচনের পরে তিনি এরিক অ্যাডামসের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন পদ-পদবী ভোগ করেছেন।
শাহনেওয়াজ বলেন, কাউকে সমর্থন দেওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের জন্য কমিউনিটির ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা না করে বৃহত্তর স্বার্থে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত।