বাঙালি মায়ের চিরন্তন আকুতি সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করা। মায়ের সন্তান কখনো বড় হয় না। সন্তানকে কাছে পেলে, সন্তানকে স্নেহ, আদর করতে পারলে বাঙালি মায়ের প্রাণ জুড়ায়। মাকে পেয়েও সন্তানের হৃদয়টা ভরে ওঠে। মাকে মা মা ডেকে সন্তান তার মনকে ভরে তোলে। সন্তানদের কাছে মায়ের কোল পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের আঁচলটাই যেন সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিশ্চিত সুরক্ষা দেয়াল। মায়ের আঁচলের তলে আশ্রয় পেলে বাংলা মায়ের সন্তানেরা মনে করে কোনো বিপদই আর তাদের স্পর্শ করতে পারবে না।
প্রবাসী সন্তানদের দেশের সবকিছুর জন্য হৃদয়ে হাহাকার উঠলেও মায়ের অবর্তমানে মায়ের চেয়ে আর কোনো কিছুর জন্য অধিক কষ্ট কেউ অনুভব করে না। বর্তমানে কলিং কার্ডের কারণে টেলিফোন বিল কমে যাওয়ায় প্রায় সবাই প্রায় প্রতিদিন দেশে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। সবার কুশল জানেন। আবার যাদের দেশে মা এখনো বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই প্রায় সকাল-বিকাল দুবেলা টেলিফোন করে মায়ের খোঁজখবর নেন। কাজে বের হওয়ার আগে একবার, কাজ থেকে ফিরে আরেকবার মায়ের খবর নিয়ে মনটাকে শান্ত করে তবেই ঘুমাতে যান।
সেই বাঙালি মায়েদের তুলনা করা হয় প্রিয় দেশের সঙ্গে। বলা হয়, জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী। সেই মায়েরাই প্রবাসী সন্তানদের আকুতি জানিয়ে দেশে যেতে নিষেধ করছেন। যে মায়েরা সন্তানের দেশে আসার খবর শুনলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান, সেই মায়েরা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে সন্তানের মঙ্গল কামনায় বলছেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে আসিস না বাবা।’ কতটা আতঙ্কিত, কতটা শঙ্কিত হলে একজন মা সন্তানকে দেশে না যাওয়ার জন্য বলতে পারেন। সহজেই অনুভব করা যায়, মায়েদের মনে কী রকম কু ডাকলে একজন মা সন্তানকে দেশে না যাওয়ার জন্য আকুতি জানাতে পারেন!
ঠিক সে রকম আকুতিই প্রকাশ পেয়েছে ঠিকানায় গত ২৩ আগস্টের সংখ্যায় প্রকাশিত খবরটিতে। খবরটির মূল শিরোনাম ছিল ‘এই মুহূর্তে দেশে আসিস না বাবা’। উপশিরোনাম ছিল দুটি। এক. নির্বাচন ঘিরে গোলযোগের আশঙ্কা। দুই. উদ্বিগ্ন প্রবাসীর স্বজনেরা। খবরটিতে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সামিউল আলমের ঘটনা। প্রায় এক যুগ প্রবাসে থিতু হয়েছেন সামিউল। গ্রিন কার্ড হাতে আসার পর সামিউল দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাভাবিকভাবে মা তার অপেক্ষার প্রহর গুনবেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে মা আতঙ্কিত। মা জানিয়েছেন, ‘এই মুহূর্তে দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। তুই এখন দেশে আসিসনে সামিউল।’
সামিউলের মতো আরও এমন অনেকের মা ও স্বজনেরা তাদের সন্তানদের এই মুহূর্তে দেশে না যাওয়ার জন্য বলছেন। বর্তমানে দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে তাদের আশঙ্কা। তাই প্রবাস থেকে প্রিয় সন্তানকে দেশে না যাওয়ার জন্য তাদের এই আকুতি। কী বেদনার কথা! প্রবাসীরা দেশে যাবে।
আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবে। ঘুরবে-বেড়াবে। আনন্দ করবে। দেশকে কি তারা কারও চেয়ে কম ভালোবাসেন। দেশের জন্য তাদের অবদানও কম নয়। প্রবাসীদের অর্থ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার পক্ষে অনেকটা অবদান রাখে। এ কথা শুধু দেশের রাজনীতিবিদেরা নন, অনেক অর্থনীতিবিদও স্বীকার করে থাকেন। রাজনৈতিক হানাহানির শিকার হয়ে প্রবাসীরা দেশে যাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেনÑএটা কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়।
সব দলের চৈতন্য ফেরা খুব জরুরি যে দেশটা কেবল শুধু রাজনীতিবিদদের নয়। মুক্তিযুদ্ধে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষ আর প্রবাসীরাও অংশ নিয়েছিলেন। সবাই নিঃস্বার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং দেশ স্বাধীনও করেছেন। তাই প্রবাসীদের দেশে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনীতিবিদদেরই ভূমিকা রাখতে হবে। তাতে দেশের মঙ্গল, মানুষেরও মঙ্গল।