শক্তি-ভবিষ্যৎ না জেনেও খেলছে দেশের প্রধান দল বিএনপি। হোঁচট খায়, আবার এগোয়। তেজি হয়ে আগোয়ান জামায়াত। বড় ধাক্কা খেলে একটু দমে। পরে আবার বিগড়ায়। নানা চক্করে ঘুরছে নতুন দল এনসিপি। স্পষ্ট বার্তা কারও কাছেই নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার কথাই শোনেন। আবার কারও কথাই শোনেন না। কিন্তু মাথা নাড়েন। ‘বিষয়টা দেখছেন বা দেখবেন’ বলে সায় দেন।
এর জেরে তিনি প্রকারান্তরে একলা চলছেন বলে প্রতীয়মান অনেকের কাছে। ড. ইউনূস তার পর্যায়ের কাউকে সহযোগী পাননি বলেও প্রচারিত। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার আগের মতো এন্ট্রেন্স দেন না। মোটামুটি কাছে যেতে দেওয়ায় কেউ কেউ এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যত বড় মুখ নয়, কথা বলেছেন তার চেয়েও ঢের বড় করে। তাই নিজেকে অনেকটা সীমিত করে ফেলেছেন। গোটা পরিস্থিতির মাঝে রহস্যময়তা। সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীকে চটানো, উত্তেজিত করা, বিভ্রান্তিতে ফেলার হেন কুচেষ্টা নেই, যা না করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন, বিশেষ করে রাতে এমন সব গুজব ও ফেক ফুটেজ ছড়ানো হচ্ছে, যা অবিশ্বাস করা কঠিন। সেনাপ্রধানের জরুরি বৈঠক, সাঁজোয়া যান বের হওয়ার মতো অপতথ্য কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্বাস করে তা আরও ছড়াচ্ছে ইনোসেন্ট মানুষও। এর নেপথ্য হোতাদের উদ্দেশ্য সেটাই।
তার ওপর দেশজুড়ে সমানে আবার নানা দাবিতে রাস্তায় নামার প্রবণতা। আল্টিমেটামের ধুম। এসবের পেছনে কার বা কোন মহলের কী ভূমিকা, ক্লু বের হচ্ছে না। ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে পেছনের আয়োজকসহ নগর ভবন এলাকায় ব্লকেড অনেকটা পরিষ্কার। কিন্তু নানা অপরাধে চাকরিচ্যুত সৈনিকদের ঢাকা উত্তরে সেনানিবাসের আশপাশে জমায়েত করে অঘটনচেষ্টার আয়োজকদের সম্পর্কে এখনো হালনাগাদ তথ্য মেলেনি। কেন ওই এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা চেপে যাওয়া হয়েছে আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে।
এর মাঝে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে কর্মরত ৪৪ আমলা ও ৯৫ ম্যাজিস্ট্রেটের তালিকা প্রকাশ করে রাজনীতির বাঁক বদলের ধাক্কা দিয়েছে ৫ আগস্ট বিপ্লবের ফ্রন্টলাইনার ছাত্রদের সংগঠন ‘জুলাই ঐক্য’। গত ২০ মে সংবাদ সম্মেলন করে এ তালিকা প্রকাশ করেছে তারা। এসব আমলা ও ম্যাজিস্ট্রেটদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোসহ ৭ দফা দাবিও জানিয়েছে ৮০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্মটি। ৩১ মে’র মধ্যে দাবি আদায় না হলে ‘মার্চ টু সচিবালয়’ কর্মসূচি ঘোষণারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এর নেতারা। সরকারকে বলেছেন, দেশের তথ্য পাচারকারী ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালানো, নির্দেশকারী এবং সহযোগিতাকারী সব আমলা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পরিবারসহ সবার ব্যাংক হিসাব ও অবৈধ সম্পদ জব্দ করতে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে দৃশ্যমান কাজের অগ্রগতি দেখাতে।
কেবল তা নয়; আগামী ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) এর মধ্যে স্বৈরাচারের চিহ্নিত দোসরদের শ্বেতপত্র সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। আইনের ১৩২ ধারার কারণে থানায় খুনি পুলিশদের নামে মামলা নেওয়া হয় না বলে ৩১ মে’র মধ্যে এ ধারাটিও বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ৬২৬ জনের তালিকাও প্রকাশ করতে হবে। সেই সঙ্গে জানাতে হবে তারা এখন কোথায় আছে? কতজন কার সহযোগিতায় দেশ ছেড়েছে? পরবর্তীতে কালচারাল ফ্যাসিস্ট, শিক্ষাঙ্গন, চিকিৎসাঙ্গন, আইনাঙ্গন এবং গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সেক্টরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের তালিকা প্রকাশের হুমকিও দিয়ে রেখেছে জুলাই ঐক্য। পরিস্থিতিটা ঘোলাটে। গত ক’দিন ধরে একেকটা গুজবের মাঝে এমন দাবি ও আল্টিমেটামে সামনে এল সংগঠনটি। এনসিপিতে নানা বিভাজনের মধ্যে জুলাই ঐক্যের আবার সামনে আসা। দলটা গড়ে উঠুক, একটা শক্তি হোক, অনেকে তা চাইলেও এখন অন্য কিছু চায়। এনসিপি নেতারা যেভাবে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে গেছেন, এতে এর বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। নেতৃত্বের বড় অংশ সারা দিন সচিবালয়সহ বড় বড় জায়গায় তদবির করে বলে অভিযোগ বেশ চাউর।
এদিকে সপ্তাহখানেক ধরে হেন গুজব ও কনটেন্ট নেই, যা না ছড়ানো হয়েছে। কখনো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের চরম বিরোধ, বঙ্গভবনে বিশেষ সেনা মহড়া, ওয়াকার বাহিনীর মুভমেন্ট, কয়েক উপদেষ্টার দেশ ছেড়ে পলায়ন-সবই রয়েছে এই গুজব প্যাকেজে। নানান ফ্যাক আইডি থেকে ছড়ানো এসব গুজব বেশ মার্কেটও পাচ্ছে। একটি গুজব প্রমাণ হওয়ার আগেই আরেকটি ছড়ানো হয়েছে।
দেশের বাইরে এবং দেশে কারাভ্যন্তর থেকেও এসব গুজবের স্ক্রিপ্টসহ মালমসলা জোগান দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন কারাগারে থাকা কয়েক নেতার উৎপাতও কিছুদিন ধরে সীমা ছাড়ানো। যখন-তখন কারা কর্মকর্তা ও রক্ষীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ধমকান। এয়ারকুলার, মোবাইল দিতে বলেন। এটা-ওটা খেতে চান। এমন কিছু চেয়ে বসেন, যা কর্তৃপক্ষের দেওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন কারাগারে থাকা বিগত সরকারের এ ধরনের মন্ত্রী-এমপিদের কয়েকজনকে সাজাও দেওয়া হয়েছে। ডিভিশন বাতিলের ঘটনাও আছে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ দেড় শতাধিক ভিআইপি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাবেক সচিব, সাবেক দুই আইজিপি, সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন। ১৫০ জন কারাগারে ডিভিশন পেয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। অন্যরা আছেন কাশিমপুরের তিনটি পুরুষ ও মহিলা কারাগারে।
এদিকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের উৎপাতও চরমে। যে কারণে অবৈধ নাগরিকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ভারত সরকার। তারাসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রায় দেড় লাখ নেতা-কর্মী ও তাদের পরিবার। দেশে ফেরার মতো নিরাপদ পরিস্থিতি না থাকায় নেতারা দ্বিধায় রয়েছেন। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাইকে ভারত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে এবং অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বলেছে। এর মাঝেও গুজব ছড়ানোর অন্ত থাকছে না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয় উদ্ধার, বিভিন্ন জায়গায় শিনা টান করার ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে ব্যাপক আয়োজনে।
দেশে নতুন করে বেকারত্ব গজানোর কারণে ফেক নিউজের বাজারও বড় হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো দলের হয়ে দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়েছে। বিনিয়োগ সম্মেলনে পাওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ২ বছরের মধ্যে ১০ হাজার লোকের চাকরি হবে-এমন আশাবাদ শোনানোর পরবর্তী বাস্তবতা বড় করুণ। নতুন চাকরি দূরে থাক, গত ৮-৯ মাসে অন্তত ১১৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরি হারিয়েছে এক লাখেরও বেশি মানুষ। নতুন-পুরান মিলিয়ে বেকারের এ কিলবিল সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ফুঁসছে। তার ওপর সরকারের কাছে গ্রাহ্যতা পাচ্ছে না। সরকারের বড় অংশের কাছে ব্যবসায়ী মানেই লুটেরা।