নতুন করে সংকটমুখী বাংলাদেশের রাজনীতি। টেনে আনতে ছিঁড়ে যায় দশা। অর্থনীতি একটু ঘুছিয়ে আনতে না আনতেই আবার ঝুঁকিতে। বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে গত ২৩ এপ্রিল রাতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আবার নিয়ন্ত্রণহীন, বেসামাল। সমানে চলছে মামলাবাজি ব্যবসা। যে যেদিক দিয়ে পারছে মামলা ঠুকছে। যাকে তাকে ফ্যাসিস্ট বানাচ্ছে। অর্থ কামাচ্ছে। অবস্থার জেরে আইজিপিকে বলতে হয়েছে, নিরীহ লোককে মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে না। এ জন্য ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে করা মামলাগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করতে হবে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা না ফেরার কারণেই মবের ঘটনা ঘটছে বলেও মনে করেন আইজিপি। আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ঢালাও হত্যা মামলায় ক্ষুব্ধ সরকার। সঙ্গে এও বলেছেন, মামলা করার ব্যাপারে কাউকে বাধা দেওয়া যায় না। এমন হরেক কথার মাঝে বেপরোয়া এগিয়ে চলছে নতুন একদল ডাকাত-লুণ্ঠনকারী। শিক্ষা চলে গেছে অনেকটা রসাতলে। মানুষ আশাহীনতার অন্ধকার টানেলে। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও আক্রান্ত। এত দিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার প্রতি আনহ্যাপির কথা বলা হলেও সাম্প্রতিক ভাষা বড় আক্রমণাত্মক। কখনো কখনো ব্যঙ্গাত্মকও।
প্রধান উপদেষ্টা তার সাম্প্রতিক কাতার সফরের সময় আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখনো জনগণ ভালো সমাধান মনে করে। সরকার এমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়নি যে, জনগণ বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার বিচার এবং ভারত থেকে বিবৃতি দেওয়া নিয়েও কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথাও আবার জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টার এসব কথায় কষ্ট পাওয়া মহল নানাভাবে প্রকাশ ঘটাচ্ছে। বড় দল বিএনপি ক্ষোভ জানালে বাকিরা তা লুফে নেবে, বর্তমান বাস্তবতায় এটাই স্বাভাবিক। নানা কথার খই ফোটাচ্ছে বিভিন্ন দল। মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বিএনপির বড় বড় জায়গা থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে, কোন ‘জনগণের’ কথা বলেছেন তিনি। কোনো মহামানবকে ‘জনগণ’ দেশ শাসনের ভার দেয়নি।
কোন জনগণ এখন কার?-এ প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠেছে। জবাব বহুমুখী। এ সরকারের বৈধতা নেই- এমন কথা বলতেও ইদানীং আর ছাড়ছে না বিএনপি। দলটির অভ্যন্তরীণ অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে বিস্ময়কর বিপন্ন দশা। ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতাদের ধারণা ছিল, তারা একদম ক্ষমতার কাছাকাছি। ১৭ বছর বুভুক্ষ নেতা-কর্মীরা কখন কোন দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, দল নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ৪ আগস্টও যে হাটবাজার, দোকান, ফুটপাত আওয়ামী লীগের দখলে ছিল; তা পরদিন বিএনপির দখলে চলে যায়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বারবার সতর্ক করা, প্রচুর বহিষ্কারসহ শাস্তির পরও তারা বুঝতেই পারেনি সামনে কী কঠিন সময় আসছে। আওয়ামী লীগ নয়, ক্রমশ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ এখন এনসিপি। এনসিপির পেছনে সরকারের প্রকাশ্য সমর্থন।
সোশ্যাল মিডিয়ারও এখন প্রধান টার্গেট বিএনপি। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে, মারামারি, খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। জামায়াতও এখন বিএনপির সঙ্গে প্রতারক প্রেমিকের মতো আচরণ করছে। তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও বৈঠক করে। স্বাধীন আরাকান রাজ্যও চায়। জামায়াতে ইসলামী অবশ্য বলেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য তারা এই ‘স্বাধীন রাজ্য’ চায়। জামায়াত তাদের এই চাওয়াটা তুলে ধরেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের কাছে। সমান্তরালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, আরাকানে ‘মানবিক সহায়তা’ পাঠানোর জন্য করিডোর দিতে বাংলাদেশ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না তা ভাবিয়ে তুলেছে বিএনপিসহ অনেককে। আরাকানে যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজমান এবং নানা বৃহৎ শক্তি নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে সেখানে সক্রিয়। ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান’ একটি ভূখণ্ডের জন্য নিজ দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার আগে সরকার কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি। বিএনপি এতে ক্ষোভ জানিয়েছে। এসব উপাদান ও নতুন স্রোত রাজনীতিকে কঠিন জাঁতাকলে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে।
মাসখানেক আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয় খুব হাইলাইট করা হলেও মানবিক করিডোরের আলোচনা লো ভলিউমে রাখার বিষয়টা ছিল রহস্যজনক। কিছুদিনের মধ্যে কারও কারও উপলব্ধি ওটাই ছিল জাতিসংঘ মহাসচিবের ওই সফরের মূল লক্ষ্য। মিয়ানমারের সিত্রো নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগ থাকার পরও বাংলাদেশের ভেতর থেকে করিডোর নেওয়ার চেষ্টার পেছনে আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। করিডোর দেওয়ার ভেতর থেকে বাংলাদেশকে মিয়ানমারে আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দিকে ঠেলে দেওয়া হবে কি না, এ প্রশ্নও রয়েছে। এদিকে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিষয়ে সরকারের পজিশন স্পষ্ট নয়। বিএনপি-জামায়াতের ভূমিকাও অস্পষ্ট। আওয়ামী লীগের কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টও উতলা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে তারা এটা রোজ বলতে চায়, বলেও। হুমকি দেয়। তাদের হাতে টাকা আছে, প্রশাসনে লোক আছে। এসবের মধ্য দিয়ে তারা নিয়মিত প্রাসঙ্গিক থাকছে। ফোকাস হচ্ছে। এর বিপরীতে জুলাই-আগস্টের চেতনা বাধাগ্রস্ত। সস্তাও হয়ে যাচ্ছে। মানুষ সাদা চোখেই দেখছে, কেউ জুলাই বিক্রি করে গাড়ি কিনছে, কেউ মুগ্ধকে বিক্রি করে দল বানিয়েছে, কেউ আবু সাঈদকে বিক্রি করে বিদেশ ঘুরছে।
তাদের এই বীরত্ব ও জৌলুশের মাঝে জুলাই বিপ্লবের এক শহিদের কন্যা ধর্ষিতা হয়ে আত্মহত্যা করেছে। এক শহিদের ভাইকে কোপানো হয়েছে। সমন্বয়ক নামের কিশোর-যুবকরা কোথাও কোথাও শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। মাস্টারমাইন্ডের বাবারও নিস্তার মিলছে না। জনা কয়েক সমন্বয়কের কারণে ছাত্রদের দলটির সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে তো পড়ছেই। ৫ আগস্টের পর ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা হওয়া কয়েকজনের ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তরা শেখ হাসিনার পিয়নের ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে পালানোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এসবের জেরে জুলাই বিপ্লবীদের আলোচিত প্রক্লেমেশনও অপ্রাসঙ্গিকতায় সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলছে। সমন্বয়কদের মধ্যে হাসনাত আবদুল্লাহই এখনো জুলাই চার্টারের কথা বলে গলা ফাটাচ্ছেন। এর মাঝেই একের পর এক নতুন দলের বাম্পার ফলন ঘটছে। পুরোটাই কখনো সার্কাস, কখনো ভজঘটের মতো।