Thikana News
২০ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫

ঈদে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে

ঈদে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ে



 
ঈদ চলে এল কিন্তু মা যে চিরতরের মতো দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ফিরে এল না। মা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না জানি, অনেক চেষ্টা করলেও আর ফিরে এসে খোকা বলে ডাক দেবে না কিন্তু তার কত স্মৃতি যে মনের পর্দায় এসে উঁকিঝুঁকি মারে প্রতিনিয়ত।
রোজার ঈদ এলে মা আমার পথের দিকে চেয়ে থাকত, তার খোকা কখন বাড়ি এসে মা বলে ডাক দেবে আর তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাবে। মা আমাকে দেখে চোখের পানি ঝরঝর করে ফেলে কাঁদত আর সবার আগে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিত। মাথায় হাত দিয়ে মাথার চুল নড়াচড়া করত।
মুখের দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে থাকত আর কত কী যে বলত! আমার বাজান কত শুকিয়ে গেছে। তোর মুখ রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। মুখে এটা কিসের দাগ রে খোকা। কোথাও পড়ে গিয়ে কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা লেগেছিল নাকি। নিয়মিত কি ঘুমাস নাই রে বেটা। চোখের নিচটা কেমন হয়ে গেছে। খাওয়াদাওয়া ও গোসল মনে হয় নিয়মিত করিস নাই রে খোকা। জামা-কাপড় সবকিছু আমাকে দে, আমি সুন্দর করে সাবান দিয়ে ধুয়ে দিই। নে, গাছের কচি ডাবের পানি একটু চুমুক দিয়ে খায়। এই সাবান আর খোসা নে, নদী থেকে ডুব দিয়ে ভালো করে গোসল করে আয়। কাউকে আবার পাঠাত আমার সঙ্গে নদীতে। মা তাড়াতাড়ি রান্না করতে যেত।
মা ডাল সমবড়া যখন তরকারিতে দিত, কী যে ম-ম গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ত। নাকে সেই ডাল সমবড়ার গন্ধ এলে অনেকে জোরে জোরে হাঁচি দিত। তরকারি কী সুন্দর রঙের হতো। দেখলেই খেতে লোভ জাগত। মা রান্নাঘরে একটা শীতল পাটি বিছিয়ে ভাত প্লেটে ও তরকারি বাটিতে বেড়ে খাওয়ার জন্য ডাকতÑখোকা, ইরে খোকা। ওরে আমার সোনার বেটা, কলিজা বেটা, আমার আকাশের চাঁদ। আয় বাবা তাড়াতাড়ি আয়, দু’মুঠ খেয়ে নে। আমি গরমে ঘেমে গেলে মা একটা তালের পাখা দিয়ে কী সুন্দর করে বাতাস দিত। মাছের বড় মাথাটা আমার পাতে তুলে দিয়ে বলত, খা মাছের মাথাটা, সুন্দর করে চাবায়ে খা। ভাত আরেকটু নে। তরকারি বেশি করে ঢেলে নে।
মা যে হঠাৎ এভাবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমাবে, কোনো দিন তা ভাবিনি। অনেক স্বপ্ন ছিল ঈদের আগে দেশে বেড়াতে যাব, মায়ের হাতের রান্না, সেমাই-পায়েস খাব।
মা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে ঘুম থেকে না ওঠায় তাকে ডাকতে যাওয়া হয়। মা আর কোনো সাড়াশব্দ দেয় নাই। পরে দেখা গেল, আমার জনম দুঃখিনী মা আর দুনিয়াতে নাই। আমাকে ফোন করে জানানো হলো, মা আর নাই। আমার এটা কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমার মা মরে গেছে। আমার কাছে মনে হলো পুরো পৃথিবী ঘুরছে। আমি কোথায় আছি তা আর বুঝতে পারছি না। আমার কত স্বপ্ন মাকে নিয়ে।
সরকারি চাকরি করায় বেশি দিন ছুটি না পাওয়ায় অল্প দিনের ছুটি নিয়ে মাকে গিয়ে একবার দেখে আসি। খুব তাড়াতাড়িই আসতে হয়েছিল ফিরে। আমি আমেরিকায় আসার দুই মাসের মাথায় আমার গর্ভধারিণী মা পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমায়।
ভিডিও কল দিয়ে মাকে দেখলাম। কী সুন্দর আমার মায়ের মুখ। মনে হচ্ছে মা আমার ঘুমিয়ে আছে। মা মা করে কত ডাক দিলাম। মা একটি বারও সাড়া দেয়নি। মায়ের নিথর দেহ খাটিয়াতে রাখা হয়েছে। মনটা কেমন আকুলি-বিকুলি করতে লাগল। সবকিছুর অল্টারেশন হলেও মায়ের কোনো পরিবর্তন হয় না। মা তো মা, যার কোনো তুলনা হয় না। মা মরে যাওয়ার পর দুটি রোজার ঈদ চলে গেছে, আরেকটা রোজার ঈদ আসার পথে। ঈদ এলে মায়ের কথা মনে পড়ে আর মনে পড়ে। এক ঈদের আগে দেশে গিয়ে সৌভাগ্য হয়েছিল মায়ের জন্য ঈদের একটা শাড়ি কেনার। আমার মা ঈদে সেই শাড়িটা পরিধান করেছিল। আমার যে কী আনন্দ লেগেছিল।
মায়ের মতো এখন কেউ আর বলে না ঈদের আগে বাড়িতে আয়, গেদা। রাস্তাঘাট দেখেশুনে আসিস রে বাবা। যেদিন রওনা দিবি সকালে সকালে রওনা দিবি। রাস্তায় কারও দেওয়া কোনো কিছু খাস না রে বাবা। আল্লাহ-রাসুলের নাম নিয়ে রওনা দিবি। যদি বলতাম, মা, ঈদে তোমার জন্য কী কিনে আনব। মা বলত, পাগল ছেলে, আমার জন্য তোর কিছু কিনতে হবে না, তুই আসলেই আমার আর কিছু লাগবে না রে বাজান। তোর জন্য মন আমার আনচান করে। কোথায় সাত নদী তেরো বিল পাড়ি দিয়ে থাকিস। কী খাস আর না খাস, কিছুই দেখতে পারি না রে বেটা। মোরগটা তোর জন্য রাখছি, তুই এলে জবাই করে খাব। গাছের পেয়ারা, আতা, বরই, আম, জামগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আয় বাবা তুই তাড়াতাড়ি, ঈদের আগে বাড়ি আয়। তুই এলে সিপন, লিটন ও মনজু ওদের সুন্নতে খাতনা দেব। অনেক বড় অনুষ্ঠান করে সবাইকে খাওয়াব। আয় বাবা আমার, কোলের বেটা কোলে ফিরে আয়। মা মাঝে মাঝেই আমার সাথে কথা বলতে বলতে কেঁদে দিত।
ও আমার মা জননী, কীভাবে আমাদের রেখে কবর দেশে ঘুমাও তুমি। কত যে মনে পড়ে তোমার স্মৃতি। মায়ের মতো মধু আর দুনিয়াতে নাই। ঈদে কল দিলে মা কী যে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করত। বাজান রে, তুই ঈদে বাড়িতে আসলি না, আমার একটুও ভালো লাগছে না। সবাই সেমাই-পায়েস খেয়ে মজা করলেও মা সেমাই-পায়েস তেমন মুখে দেয় না। মুখে দিলেও কতবার যে বেটার নাম স্মরণ করে। মা প্রায়ই বলত, ওরে আমার বুকের ধন, সবার ভাত দেশে জুটল, তোর ভাত আর দেশে হলো না। একবার মা বলেছে, তুই এবার এলে আর যেতে দেব না। দেশে দুটি ডাল-ভাত যা জোটে, তা-ই খাবি। আমার চোখের সামনে থাকবি, ঘুরে বেড়াবি, কী যে আনন্দ লাগবে। ঈদে সবার সাথে তুইও মজা করবি, আমার যে কী ভালো লাগবে রে বেটা। আমি তো মা, আমার সব বেটাবেটির কথা মনে পড়ে আর তোর কথা বেশি মনে পড়ে। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে সবাই আসে, কত মজা করে কিন্তু তোকে না দেখে আমার মনটা ভীষণ কাঁদে রে বেটা। ঈদে, দেশে থাকতে তুই সবার সাথে ঘোরাঘুরি করতি, আমার কী যে ভালো লাগত। আয় বেটা, ঈদের আগে আমার কোলে আয়।
মায়ের কথা সব সময় মনে পড়ে। ঈদ এলে আরও বেশি মনে পড়ে। মাঝেমধ্যে মনের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মা মা বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। ঈদ নামাজ শেষে মায়ের কবর জিয়ারত করতে যাই। মা বাটপাড়ার গোরস্তানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছে। মায়ের কবরের কাছে গেলে বুকের মধ্যে কম্পন শুরু হয়ে যায়। গা-হাত-পা অবশ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় মায়ের কত স্মৃতি। মা মা বলে কত ডাকি আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। মা আমার কী এক নিঝুম পরিবেশে ঘুমিয়ে আছে। আমি মাকে ডেকে বলি, মা আমি তোমার খোকা। আমাকে ঈদে না দেখলে কত কান্নাকাটি করতে। আমি আমেরিকা থেকে বাড়িতে এসেছি, মা। বাড়িতে সবই আছে, কেবল মা তুমি নাই। তুমি ছাড়া বাড়ি ফাঁকা লাগে। মা, তুমি ছাড়া জগৎ অন্ধকার মনে হয়। তুমি ছাড়া আমি একা, অনেক একা।
কবরের কাছে গিয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে মায়ের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়ার দরখাস্ত করি। সৃষ্টিকর্তা মায়ের গোনাহ মাফ করে তাকে জান্নাত নসিব করুন। চোখ হয়ে যায় নদী। মায়ের কবরের দিকে ফিরে চেয়ে বারবার দেখি। ও মা, আমাদের রেখে কবর পরিবেশে কেমনে ঘুমাও তুমি। বাড়িতে এসে ছুটে যাই মায়ের ঘরে। মনটা কেমন যে ছটফট করে। ঈদে মা ছাড়া একটুও ভালো লাগে না। যাদের মা দুনিয়াতে বেঁচে আছে, তারা কত সৌভাগ্যবান। সব মায়ের প্রতি ঈদে রইল আমার সালাম। যারা বেঁচে আছে, তারা যেন সহিসালামতে থাকে আর যারা প্রভুর ডাকে দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে গেছে, আল্লাহ যেন তাদের জান্নাত নসিব করেন। আমিন।
 

কমেন্ট বক্স