অবশেষে সেই আশঙ্কাই বাস্তবে রূপ নিতে বসেছে। নির্বাচনের আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দেশগুলোতেও জল্পনা-কল্পনা ছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলে বিশ্বজুড়ে একটা তোলপাড় উঠবে। নির্বাচনী প্রচারকালের শেষ দিকে কিছুটা শান্ত থাকলেও শপথ নেওয়ার পর গত ২০ জানুয়ারি থেকে তিনি নির্বাহী আদেশের ঝড় তোলেন। শপথ নিয়েই ট্রাম্প প্রায় ২০০ নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। প্রথম দিনের সেই আদেশেই জলবায়ু কমিটি থেকে তিনি আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন। যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকোর দক্ষিণ সীমান্তে বেড়া নির্মাণের কাজ শেষ করার আদেশ দিয়ে বিদেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।
এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধদের জন্য এক আতঙ্কের নাম। একদিকে যোগ্যদের জন্য গ্রিনকার্ড প্রাপ্তি সহজ করে দিচ্ছেন, অন্যদিকে অবৈধদের জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে আমেরিকা। একসময় বিশ্বের সব বঞ্চিত মানুষ যে দেশে এলে ভাগ্য গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, সেই দেশ এখন তাদের জন্য এক মহা দুঃস্বপ্নের দেশ। এরই মধ্যে কয়েক লাখ অভিবাসীকে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের কাগজপত্র নেই, তাদের মধ্যে মহা আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা। রেস্টুরেন্টগুলোতে চিরচেনা সেই আড্ডার দৃশ্য নেই। কর্মীর অভাব দেখা দিয়েছে।
দেশজুড়ে চলছে ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্টের (আইস) অভিযান। নির্বাসনের আদেশ পেয়েছেন নিউইয়র্কের আড়াই লক্ষাধিক বাসিন্দা। নিউইয়র্কের ট্রাম্প প্রশাসন গণনির্বাসনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকায় নথিবিহীন লাখ লাখ অভিবাসীকে নির্বাসনে পাঠানোর অঙ্গীকার রক্ষার লক্ষ্যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিউইয়র্কে যেকোনো সময় আকস্মিক অভিযান চলতে পারে। নিউইয়র্ক সিটিতে যারা নথিবিহীন অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন, সিটির সেই ইমিগ্রেশন অ্যাডভোকেটরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, চার বছর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে যেমন নথিপত্রবিহীন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, এবার হয়তো তার চেয়েও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এ অভিযান সিটির প্রতিটি পাড়া/মহল্লাসহ সব জনপদে পরিচালিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক সিটিতে ‘অভিবাসী অভয়ারণ্য আইন’ রয়েছে। কিন্তু সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেছেন, যারা বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের গ্রেফতারে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ফেডারেল আইনের সঙ্গে কাজ করবেন।
নিউইয়র্কের বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, নিউইয়র্ক সিটিতে প্রায় ৫ লাখ নথিপত্রহীন অভিবাসী বাস করেন। জানা যায়, এরই মধ্যে নিউইয়র্কের আড়াই লক্ষাধিক বাসিন্দা নির্বাসনের আদেশ পেয়েছেন। এদের মধ্যে বাঙালি অবশ্য নেই বললেই চলে। এশিয়ার চীন, ভারত ছাড়া সবাই ল্যাটিন আমেরিকার অধিবাসী। এ সময়ে এমনকি অনাগরিকেরাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আইসের কবলে পড়ে বৈধ নাগরিকেরাও হেনস্তার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই সবাইকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উপসংহারে এ কথা বলা যেতেই পারে, আড়াইশ বছরের স্বাধীন আমেরিকায় এ অবস্থা অবশ্যই কাম্য হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রকে, এ দেশের নাগরিকেরাই বলে থাকেন, আমেরিকা যে আজকে সবচেয়ে সুন্দর ও শক্তিশালী দেশ, তা অভিবাসীদের রক্ত-মাংসেই গড়ে উঠেছে। এ দেশ যে কেবল বিশ্বের সব প্রান্তের নিপীড়িত, নির্যাতিত, স্বপ্নহীন মানুষের জন্যই নিরাপদ, স্বপ্ন গড়ার দেশ তা নয়; নিজের স্বপ্ন গড়তে গিয়ে বহু মানুষের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে। এ দেশের ইট-পাথর আর লোহা-লক্কড়ের আঘাতে তাদের স্বপ্ন চাপা পড়ে আছে আমেরিকার সভ্যতার নিচে। এ দেশটি শাসন করেছে রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটরা। সবাই ইমিগ্র্যান্টদের অবদানের কথা স্বীকার করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। সেসব কি আজ মুছে যাবে একজনের রক্তচক্ষু আর আইনের অজুহাতে?