জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বিজয়ী ছাত্রনেতা, প্রধান রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপ শেষে নিজের সিদ্ধান্ত পাকা করে নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যের ডাক। তা কবুল করেছে দেশের প্রায় সব মহল। এ কাজে ঠান্ডা মাথায় সময় নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। আর জাতীয় ঐক্যের ডাকটা এসেছে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপের আগেই। ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসস্থ ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ কমপ্লেক্সে ন্যাশনাল ডিফেন্স এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠান থেকে। সেখানে সার্টিফিকেট প্রদান শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। তার এ বক্তব্যে ব্যাপক করতালি পড়ে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে। সেনানিবাস থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়ার আলাদা গুরুত্ব রাজনীতিকেরা বুঝে গেছেন তাৎক্ষণিকই।
আধিপত্যবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করতে সামরিক ও বেসামরিক শক্তির একটি শক্ত সেতুবন্ধ তিনি তৈরি করেই রেখেছেন। তার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের সঙ্গে ৯ ডিসেম্বর সোমবার ঢাকায় তার বিশেষ সেশন ঘটেছে আনুষ্ঠানিকভাবে। সে দিনটিতেই ঢাকা সফর করে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। শেখ হাসিনার পতন ও ড. ইউনূসের ক্ষমতায় অভিষেকের পর এটিই ভারত সরকারের কোনো শীর্ষ ব্যক্তির ঢাকা সফর। বাংলাদেশ তাকে যা বলার বলে দিয়েছে শক্ত ভাষায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাতেও বলে দেওয়া হয়েছে।
ডান-বাম-মধ্য মিলিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বুঝমান নেতারা ড. ইউনূসের এ জার্নিতে শামিল হতে দেরি করেননি। ঘটনার ফের বুঝেছেন ভারতে ফেরারি ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ তার একান্তরাও। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভার্চুয়াল মিডিয়ায়। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুতির পর জনগণের উদ্দেশে, নিদেনপক্ষে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য না দিয়েই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। লন্ডনে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তৃতা কি ঢাকার কোনো মিডিয়ায় প্রকাশ করেনি। শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা’ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা নেইÑএমন একটি ছুতো খাটানোর চেষ্টা হলেও সফল হয়নি। এর আগে তার টেলিফোন কল ফাঁস হতো। এখন তিনি সভা-সমাবেশে বক্তৃতা শুরু করেছেন।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের একান্ত পার্টনার জাতীয় পার্টির চতুর নেতারাও অনেকটা বুঝে গেছেন তাদের ভবিষ্যৎ। পার্টির চেয়ারম্যান আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন বিএনপি-জামায়াতসহ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে ভিড়তে। বলার চেষ্টা করছেন, তারাও শেখ হাসিনার অপশাসন অপছন্দ করতেন। তারাও ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন চেয়েছেন কিন্তু তাদেরকে চাপে ফেলে, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বারবার ব্যবহার করেছে। নির্বাচনে নিয়েছে, মন্ত্রি-এমপি বানিয়েছে। তারা এসব হতে চাননি। সেখানে চেষ্টার চেয়ে বেশি ছিল চাতুরী। তা যথাসময়ে ধরা পড়ে গেছে।
এ অবস্থায় জিএম কাদের ও তার গ্রুপ নিজেদের কীভাবে ভারতের আশীর্বাদে সিক্ত করা যায়, আলাদা লাইনে সেই চেষ্টায় ব্যস্ত। এ রকম সময়েই ৭ ডিসেম্বর ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ ছেড়েছে আচানক এক জনমত জরিপ। সেখানে বলা হয়, ভারতকে পছন্দ করেন ৫৩.৬%, অপছন্দ করেন ৪১.৩% বাংলাদেশি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দেশের ৫০% মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের মন্তব্যের সঙ্গে তা বেশ মিলছে।
যেখানে বাংলাদেশে রুশ-ভারত আবার একটি গালির মতো ফিরে এসেছে, সেখানে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির এ দ্বৈরথ একটি সূক্ষ্ম ঘটনা। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে শেখ হাসিনা আশ্রয় পেয়েছেন ভারতে। সিরিয়া থেকে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় হয়েছে বাশার আল আসাদের। টানা ২৪ বছর সিরিয়ায় ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। আর বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ছিলেন সাড়ে ১৫ বছর। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের কারণে ভারত বিশ্বব্যাপী মান-সম্মান খুইয়েছে, তার আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি আসাদের পতনের কারণে বিনষ্ট হয়েছে রাশিয়ার আত্মসম্মান। ঠিক শেখ হাসিনার বাংলাদেশের কপি পেস্ট সিরিয়ায়। হাসিনার মতোই প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়েছেন আসাদ। গণভবনে যা হয়েছিল, আসাদের প্রাসাদেও তা-ই। হাসিনার বাবার মূর্তি যেভাবে ভাঙা হয়েছে, আসাদের বাবার মূর্তিও সেভাবেই।
বাংলাদেশকে পদানত করতে রুশ-ভারত সিন্ডিকেটের ছক অনেক দিনের। গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধিতাও করেছে। সেখানে খেয়েছে চরম ধাক্কা। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং সিরিয়ার ঘটনাবলি ভারতকে হতবাক করে দিয়েছে। তার মিত্র রাশিয়ারও এখন কাছাকাছি অবস্থা। আগে রাশিয়ার শক্তির ওপর নির্ভর করে ভারত যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করত, সে অবস্থার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো নয় ভারতের। পাকিস্তান তার ‘চিরশত্রু’। নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও দিল্লির সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে অনেক আগেই। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত আরও দিশেহারা। তালহারা হয়ে এখন একের পর এক বাংলাদেশ-বিরোধী কর্মকাণ্ড ছাড়া ভারতের তেমন কূটনীতিও নেই। এ ক্ষেত্রে ভারত ও দেশটির কিছু গণমাধ্যম নিয়েছে গুজব ছড়ানোর নোংরা পথ। এ নিয়ে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এখন চরম উত্তেজনা চলছে। সেখানে যথাসময়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ভারতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন ড. ইউনূস। এ সময়টাতে নেপাল বাধিয়েছে আরেক কাণ্ড। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে চীনের সঙ্গে একটি কাঠামোগত চুক্তি সই করেছে নেপাল। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি বেইজিং সফর করেও ফিরেছেন।