জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শহীদ পরিবার এবং আহত যোদ্ধারা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন সংবিধান তৈরি করতে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন। তারা আরও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তাড়াহুড়ো করে নির্বাচনের জন্য দুই হাজার মানুষ জীবন দেয়নি। শুধু নির্বাচনের জন্য প্রায় ২৫ হাজার মানুষ গুলিতে পঙ্গু হয়নি। মানুষ স্বৈরাচারের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য জীবন দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধানে অধিকারের কথা নেই। তারা সেই সংবিধান চান না। বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করতে হবে। নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলায় হেফাজত হত্যাকাণ্ড, সর্বশেষ চব্বিশের জুলাইয়ে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচারের আগে দেশে কোনো ভোট হবে না। এই মুহূর্তে দরকার ছাত্র-জনতার বিচার আর সংস্কার।
এদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠক করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। জুলাই ঘোষণাপত্রে কী থাকবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি জানিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘আশা করি, আগামী পরশু বৃহস্পতিবার এই বৈঠকের ভেতর দিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি দলিল প্রণীত হবে। সেদিনই স্পষ্ট হবে কবে ঘোষণাপত্রটি জারি করব এবং সরকার কীভাবে ঘোষণাপত্র জারি করার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।’
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতভিন্নতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধ তীব্র আকারে দেখা দিচ্ছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরামর্শদাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতভিন্নতা ও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ভবিষ্যৎ রাজনীতি যে সহজ হচ্ছে না, বিদ্যমান সংকটকে তীব্রতর করবে এবং নতুন করে সংকটের জন্ম দিতে যাচ্ছে, তার আলামত সুস্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনকারীরা আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে নন। তারা চান গণপরিষদ নির্বাচন। বিদ্যমান ৩০০ আসনেই এই নির্বাচন হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারকাজ করছে সাংবিধানিক, আইনগত কোনো ভিত্তি নেই এসবের। এসবের মধ্যে যেসব সংস্কার কাজ মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কার-সংক্রান্ত, সেগুলোকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সে জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। অন্যান্য যেসব সংস্কার করা হচ্ছে বা হবে, যেগুলোর আইনগত বৈধতার জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে না, নতুন আইন প্রণয়ন করেই আইনগত বৈধতা দেওয়া সম্ভব। যেসব ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের আইনগত বৈধতা দেওয়া সম্ভব, সেসব ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন নেই। সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়ই এসবের আইনগত বৈধতা দেওয়া যাবে।
আগামী সংসদে কারা আসবে, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করবে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কাজগুলোর আইনগত, সাংবিধানিক বৈধতা দেবে কি না। সরকারের প্রধান মিত্র বিএনপি ও তার সহযোগীরা। জামায়াতে ইসলামী কার্যত এই সরকারের ধারক ও বাহক। তাদের সক্রিয় সমর্থন-সহযোগিতায় রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ্যহীন অন্তর্বর্তী সরকার টিকে আছে। পেছনে অবশ্য সর্বাধিক প্রভাবশালীরা মূল শক্তি হিসেবে শুরু থেকেই ভূমিকা রেখে আসছে। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের দলীয় বাহিনীগুলোর অত্যাচারে অতিষ্ঠ বিএনপি তাদের অপসারণ চেয়েছে, বছরের পর বছর আন্দোলন করেছে। ওই সরকারের পতন তাদের কাক্সিক্ষত ছিল। এদের অবসানের পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা তাদের কাম্য ও মুখ্য দাবি।
বৈষম্যবিরোধীরা এবং জামায়াত নির্বাচিত সরকার চায়। তবে সবার আগে তারা অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সাধারণ সংস্কার, মৌলিক ও সাংবিধানিক সংস্কারকাজ করেছে এবং সামনে করবে, যেসবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে চায়। সে নিশ্চয়তা না পেলে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে হবেই, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছ না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিএনপিসহ অন্যরা সেই নিশ্চয়তা না দিলে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন না-ও হতে পারে। তাদের আশঙ্কা, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগই যদি নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই। আগামী নির্বাচনে অংশ নিতেও তাদের কোনো আইনগত বাধা নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালে ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছে। এটা তাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নয়, অভিপ্রায়। রাজনৈতিক দলসমূহ, বিশেষ করে বিএনপির অব্যাহত জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সময়সীমা দেওয়া হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হবেই সুস্পষ্টভাবে এমন কোনো অঙ্গীকার করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সরকার অবশ্যই নির্বাচন দেবে। তবে নির্বাচনের তফসিল এ পর্যায়ে ঘোষণা করা হবে না।
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী এবং সরকারের মধ্যেও কিছু মতভিন্নতা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির দ্বিমত রয়েছে। ১৪ জানুয়ারি দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই, এটা গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে জন্য এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাইয়ের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এ জন্য সরকারকে, নির্বাচন কমিশনকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আমরা নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে পারি।
তবে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা নির্বাচন বিলম্বিত করতে চান। কেবল জরুরি কিছু ক্ষেত্রে নয়, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করার পরই নির্বাচনের পক্ষে। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কাজগুলো নির্বাচিত সরকার সংসদে অনুমোদন করে কি না, সে অনিশ্চয়তায় না থেকে বৈষম্যবিরোধীরা সংসদ নির্বাচন না করে গণপরিষদ নির্বাচন করতে চান, অর্থাৎ তারা নতুন সংবিধান রচনা করতে চান। রাজনৈতিক মহল এতে বিস্মিত হলেও এতে করে গণঅভ্যুত্থান সংঘটনকারীদের আসল উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়েছে। সরকার পরিবর্তনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য নয়, তাদের মূল লক্ষ্য বাহাত্তরের সংবিধানের পরিবর্তন। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচনার কথা বলেছেন।
বিএনপির অবস্থান এর বিপক্ষে। তারা বাহাত্তরের সংবিধান বহাল রেখেই প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার পক্ষে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস তীব্র অসন্তোষ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান বাদ দেওয়ার কথা বললে আমাদের কষ্ট হয়। জামায়াতে ইসলামী এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হতে বিরত রয়েছে। মূলত তারাও বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান আনার পক্ষে। শিক্ষার্থীদের দাবির পেছনে জামায়াতের সমর্থন রয়েছে। তারা গণপ্রজাতন্ত্রের স্থলে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পক্ষে। এরশাদ ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে শেষ বেলায় সংবিধানে আল্লাহ সর্বশক্তিমান, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ঘোষণা সংযুক্ত করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রচারণামূলক হিসেবে তা পরে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার প্রস্তাব দাবি আকারে এনেছিল জামায়াত। এরশাদ সাহস পাননি। তার ওপর ভারত-ভীতি ছিল প্রবলভাবে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করেছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে অভ্যুত্থান সংঘটনকারীদের পছন্দের অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ মাস অতিবাহিত করার পর তাদের মনে হয়েছে, একটা প্রোক্লেমেশন বা ঘোষণাপত্র জরুরি। এই ঘোষণাপত্র হবে ঐতিহাসিক দলিল, অভ্যুত্থানকারীদের আগামী কর্মপরিকল্পনা। যাতে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পাশাপাশি অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতনের কাহিনি তুলে ধরা হবে। বিজাতীয়, বিশেষত ভারতের শোষণ-বঞ্চনা, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনাচারের কথা উল্লেখ করা হবে।
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা নিয়ে উদ্যোক্তাদের ও তাদের নেপথ্যের পরামর্শকদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তাও কাজ করছে। ভারতের প্রতিক্রিয়ার দিকটি তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দীর্ঘ মেয়াদে তাদের কঠোর নীতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে। শিক্ষার্থীদের সমন্বয়কদের একটি অংশ এবং তাদের সমর্থন, সহযোগিতাকারী মূল শক্তি বিষয়টি বাড়াবাড়িমূলক বলে মনে করছেন। শেষ পর্যন্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণার কথা সরাসরি যদি বলা নাও হয়, সরকার পরিচালনা, শিক্ষা, সমাজব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামি মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হবে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণাসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমন্বয়কদের মতভিন্নতা থাকলেও তা যাতে প্রকাশ্যে না আসে, সে ব্যাপারে তাদের সবাই সতর্ক।
বিএনপি ও তাদের অনুগামী বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী গণপরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে। তারা মনে করেন, এর প্রয়োজন নেই। সংসদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও সাধারণ সংশোধনী পাস করিয়ে নিতে কোনোই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। গণপরিষদের মাধ্যমে এসব সংশোধনী অনুমোদন ও সংবিধানভুক্ত করার পর এই গণপরিষদকেই সংসদে রূপান্তর করার জটিল প্রক্রিয়ায় যাওয়ার প্রয়োজনই নেই। স্বাধীনতার পর এমএনও ও এমপিদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে তার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। তার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হয় ১৯৭৩ সালে। এ ক্ষেত্রেও নতুন করে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্ন উঠতে পারে।