আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ক্যু’ নজরে পড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের ঋণের কিস্তি ছাড়ের শর্ত হিসেবে কোটি প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর করারোপ করতে বলেছে সংস্থাটি। ফলে হুন্ডি কমিয়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে এত দিন ধরে সরকার যে আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসীদের উৎসাহিত করে আসছে, সেখানে উল্টো করারোপের প্রস্তাব রীতিমতো আত্মঘাতী বলে মনে করছেন অনেকে। অজনপ্রিয় এই প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে লোকসানি ব্যবসায় আরো বেশি হারে কর বসানোরও শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এরআগে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রবাসীদের জমানো ব্যাংকের অর্থে এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক বসায় তৎকালীন সরকার। শতভাগ রেমিট্যান্সের পাঠানো টাকায় শুল্ক আরোপের ফলে প্রবাসীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিলেও সরকার তা গায়ে মাখেনি। এই শুল্ক ইতিমধ্যে আরো একদফা বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। প্রতি মাসেই বাড়তি রেমিট্যান্স আসছে। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কারণেও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আইএমএফ-এর পরামর্শ সরকার কতটা এড়াতে পারবে, তা এখন ভাবনার বিষয়। রেমিট্যান্সে করারোপের প্রস্তাব গৃহীত হলে তা হবে আত্মঘাতি বলে অনেকে মনে করছেন। অনেকে এটিকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা অর্থনৈতিক ‘ক্যু’-এর সঙ্গেও তুলনা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬.৮০ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ডলার সংকট কাটাতে সরকার যখন রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে মরিয়া, তখনই আইএমএফের এমন শর্তে প্রবাসীদের ‘পেটে লাথি’ দেওয়ার মতো অবস্থা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কাজ করেন এনবিআরের করনীতি বিভাগের সদস্য ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী ঢাকার প্রথম সারির একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইএমএফের রেমিট্যান্সের ওপর করারোপের প্রস্তাব গ্রহণ করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। তারা অনেক কিছুই প্রস্তাব করে। আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক সময় অনেক কিছুই গ্রহণ করার মতো অবস্থা থাকে না। জাতীয় স্বার্থ মাথায় রাখতে হবে।’
আইএমএফের রেমিট্যান্সের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এটা আমার নলেজে নেই। আমাদের মতো দেশে আপাতত এটা সম্ভবও না। আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও রিজার্ভে সমস্যা আছে। আগে এগুলো ঠিক করে আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হলে এটা সম্ভব। এখন আইএমএফ চাইলেও আমরা রাজি হব না।’
রেমিট্যান্সে কর আরোপের প্রস্তাবের পাশাপাশি সংস্থাটি ব্যবসায় মন্দার সময়ও লোকসানি ব্যবসার ওপর আরো কর বসানোর শর্ত দিয়েছে। আইএমএফ বলেছে, কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও ন্যুনতম কর দিতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে আরো চাপে পড়বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। সংকুচিত হবে মূলধন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বছরে তিন কোটি টাকা বা এর বেশি টার্নওভার থাকলে তাকে ০.৬০ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হবে। একজন ব্যবসায়ী তাঁর ব্যবসায়ে লোকসান করলেও তাঁকে এই কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এই আইনকে আয়কর আইনের মূলনীতির পরিপন্থী উল্লেখ করে দীর্ঘদিন ধরে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘ন্যুনতম করহার বাড়ালে ব্যবসায়ীদের করের বোঝা আরো বাড়বে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ট্যাক্সেশন নীতি অনুযায়ী ন্যূনতম কর অবশ্যই কালাকানুন। তবে সবার আগে দরকার শৃঙ্খলা। সবাই ঠিকমতো কর দিলে কোষাগার ভেসে যেত। কিন্তু কেউ ঠিকমতো কর দিচ্ছে না। সুশাসন ও ডিজিটাইজেশন নেই। ব্যাপক কর ফাঁকি থাকলে চাইলেও অনেক কিছু পরিবর্তন করা যায় না।’
শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে অনুমোদন করা ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের আগে এই অক্টোবরে ঢাকা সফরে যাবে আইএমএফের পরবর্তী মিশন। এই মিশন সামনে রেখে সংস্থাটি রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছে। ভ্যাটে সব ধরনের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে একক ভ্যাটহার (যেমন সবার জন্য ১৫ শতাংশ), আয়কর-ভ্যাট-কাস্টমস অনুবিভাগে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, তথ্যের আদান-প্রদান সহজীকরণসহ রাজস্ব আদায়ে মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।