ঐকমত্য, সনদ, ফ্যাসিস্টের বিচার, নির্বাচন ইত্যাদির প্রাসঙ্গিক ডামাডোলে অস্ত্রবাজির লীলাভূমির দিকে ধেয়ে চলছে দেশ। একদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ উপদেষ্টা পরিষদের কাছে জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ নিয়ে তার নতুন দেশ গড়ার উচ্চাশা এবং এর ভালো-মন্দের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে বিভিন্ন মহলের আলোচনা-সমালোচনা। অন্যদিকে ভারত থেকে অস্ত্র ঢুকছে। মিয়ানমার থেকেও আসছে। সেই সঙ্গে যোগ হচ্ছে ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র। লক্ষ্য একটি গোটা প্যাকেজে দেশে অস্থিরতা তৈরি। এরই মধ্যে ধরা পড়েছে বাইরে থেকে আসা একাধিক চালান। এ নিয়ে শোরগোলে না গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নীরবে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। শিগগিরই এর প্রকাশ ঘটবে কয়েকটি সাঁড়াশি অভিযানের পর। নমনীয়তার ভয়ংকর পরিণতি আঁচ করেই এ পথে যাচ্ছে সরকার। কিছু ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর শঙ্কা ঘুরছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা- এআইর অপব্যবহার নিয়ে। তা কেবল আগামী কয়েক মাসের নির্বাচনী মাঠে নয়, ভোটের আগের রাত বা দিনেও ঘটিয়ে দেওয়া হতে পারে। তা রোখা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন মোকাবিলায় একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা কতটা গুজব ঠেকাতে পারবে, এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এমন একটা উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যেই অনেকটা নিঃশব্দে দিয়ে দেওয়া গণজামিনের বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নজরে এসেছে অনেক কাণ্ড ঘটার পর। হাইকোর্টের তিন বিচারকের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ তিন বিচারক হলেন আবু তাহের সাইফুর রহমান, মোস্তফা জামান ইসলাম ও জাকির হোসেন। ধারণার বাইরে ৪-৫ ঘণ্টায় প্রায় ৮০০ মামলায় জামিন দেওয়ার এমন নানা কাণ্ডের মধ্যেই রাজধানীর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে বিদেশি অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বিশেষ অভিযান চালানো হয় রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি নির্দিষ্ট বগিতে। সেখানে মেলে ৮টি বিদেশি পিস্তল, ১৪টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড অ্যামুনিশন, ২.৩৯ কেজি গান পাউডার ও ২.২৩ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক। এ ট্রেনটি অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন। এটি শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে ঢাকা-রাজশাহী রুটে বিরতিহীনভাবে চলাচল করে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে রাজনীতির অনেক সমীকরণ বদলে যাওয়ার আলামত বুঝেই দেশে একটি গন্ডগোল বাধানোর এসব আয়োজন। এ মহলটি নিশ্চিত, নীরবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। তা বানচাল করতেই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মিলিয়ে একাধিক বড় অগ্নিকাণ্ড। অস্ত্রের মজুদ বাড়ানো এবং এআই দিয়ে নানা ছবি ও কাহিনি তৈরির বিশাল প্রকল্প। এসবের পেছনে বিদেশি শক্তির প্রভাবের তথ্যও জেনেছে সরকার। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলার পরিকল্পনার তথ্যের ভিত্তিতে দেশের সব মেট্রোপলিটন, রেঞ্জ ও জেলা পুলিশকে এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জনমনে ভয় সৃষ্টি, সহিংসতা উসকে দেওয়া, ভোট-প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আয়োজনের এ অপচেষ্টা ভণ্ডুল করে দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই আলোকে নিচের দিকে আনসার থেকে শুরু করে উপরের দিকে সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত আরও অ্যাকটিভ করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নির্বাচনের আগে অবৈধ অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার হবে বলে আশা করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। পুলিশ থেকে শুরু করে আনসার পর্যন্ত সবার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে মিলিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে সম্ভাব্য একটি বিশেষ অভিযান ব্যাপক আলোচিত। এ ছাড়া এবার নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার বিধান চূড়ান্ত প্রায়। দেশের এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। তাদেরকে বিব্রত ও ব্যর্থ করার আয়োজনও ব্যাপক। এ অপচেষ্টার বিপরীতে সেনাবাহিনীর ট্রেনে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার ঘটনাটি কেবলই এক অভিযান নয়, দেশের নিরাপত্তা নীতির পরীক্ষাও। সামনে এ ধরনের আরও পরীক্ষা অপেক্ষমাণ। নানা ঘটনার বাঁকে লুট হওয়া ১ হাজারেরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে শুরু করে গণভবন থেকে এসএসএফের লুট হওয়া ৩২টি ভয়ানক অস্ত্রও রয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে যাদের গুলি করতে দেখা গেছে, তাদের বেশির ভাগই এখনো অধরা। হাতে গোনা যে কজন ধরা পড়েছে, তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়নি আন্দোলনকারীদের গুলি ছুড়তে ব্যবহার করা সেই অস্ত্রগুলো।
আন্দোলনের সময় পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে গুলি চালানো এসব অস্ত্রধারীর বড় একটা অংশ দেশ ছেড়ে পালালেও বাকিরা গা-ঢাকা দিয়ে আছে। এরা অনলাইন-অফলাইনে হুমকি দিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এদের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় আছেন অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ব্যক্তি, আহতরা ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। গোয়েন্দা তথ্য এবং গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্য বলছে, আন্দোলনে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোর কিছু অংশ আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে এনেছিল। সেগুলো আবার পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না, এ-সংক্রান্ত আপডেট তথ্য নেই। তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় নতুন যোগ হওয়া চীনের তৈরি ‘ডিপসিক এআই’ মডেল এরই মধ্যে দেশে আমদানি হয়েছে বলে গোপন বার্তা রয়েছে সরকারের কাছে। ডিপসিক এআইয়ের কার্যক্ষমতা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি ও গুগলের জেমিনির মতো বিভিন্ন এআই মডেলকে পেছনে ফেলে দুষ্টচক্রের জন্য নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। আর বাংলাদেশের নির্বাচনসহ এগিয়ে যাওয়ার পথে হয়ে উঠেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়।


ঠিকানা রিপোর্ট


