কখনো কচিকাঁচার সরকার, কখনো বুড়াদের সরকার নামে তাচ্ছিল্য। আবার বলা হচ্ছে, এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। জানানো হচ্ছে সরকারকে শতভাগ সমর্থনের কথা। সেই দৃষ্টে নেই সহায়তা। আবার দৃশ্যত অসহযোগিতাও করা হচ্ছে না। কিন্তু সমালোচনা-নিন্দাবাদে একটুও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। রীতিমতো এক আচানক মশকরার শিকার ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
কিছু ভয়, কিছু অনাস্থার জের পড়েছে সরকারটির ওপর। মাহফুজ, নাহিদ, আসিফসহ এ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তরুণেরা আছেন। সারজিস-হাসনাতসহ ঝাঁকে ঝাঁকে তারুণ্য আছে সরকারের ঘোর সমর্থনে। সেই বিবেচনায় এটি ছোটদের সরকার। আবার ড. ইউনূস, ড. সালেহউদ্দীন, ড. ওয়াহিদ উদ্দীনসহ আছেন প্রবীণেরাও। আলী ইমাম মজুমদার, খোদা বক্স চৌধুরী, বদিউল আলম মজুমদারসহ বয়স্করা আছেন গুরুদায়িত্বে। তাই এটি বয়স্কদের সরকার। এ মানের কটাক্ষ রাজনৈতিক মহল থেকে। আমলা পর্যায় থেকেও। একটু প্রশংসা দিয়ে শুরু করে পরক্ষণে নানা সমালোচনার কঠিন তীরে পর্যুদস্ত সরকার। সব ধরনের বিশৃঙ্খলা এ সরকারের আশকারায় সৃষ্টি- এমন মূল্যায়নেও বাধছে না। ছাত্রদের নতুন দল ঘোষণার পর সরকার আরও চ্যালেঞ্জে পড়বে, তা এরই মধ্যে পরিষ্কার। ড. ইউনূসসহ তার সরকারের একটা অংশের নতুন দলের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে, যা সরকারের মধ্যে একাধিক সরকারের নিশানার মতো।
সমন্বয়কদের বাইরে ইউটিউবার, আমলা মিলে আরেক সরকার। বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল সরকারের এ ধরনের অবস্থানে বিরক্ত। এর মাঝে শুরু হয়েছে ডেভিল ধরার অ্যাকশন। অথচ ৫ আগস্টের পর লুণ্ঠিত অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। জেল পলাতকরা গ্রেফতার হয়নি, রাস্তায় খুনাখুনি-চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরা অধরা। এ সরকারের একটা সিলেবাস ও কোর্স রয়েছে। গত ছয় মাসে নানা অপরাধের মাঝে গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধীরা মার খাওয়ামাত্র শুরু হয়েছে শয়তান ধরার অভিযান। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ কোন তালিকা অনুযায়ী চলবে? মাফিয়া হাসিনা কয়েক লাখ সন্ত্রাসের মামলা দিয়ে গেছে বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীদের নামে। হাসিনা পালানোর পর কিছু কিছু জায়গায় বিএনপির নেতারা মামলা দিয়েছেন আওয়ামী লীগসহ অন্যদের নামে।
সেখানেও ব্যাপক গোলমাল। আওয়ামী অপরাধীর চেয়ে সাধারণ মানুষের সংখ্যা বেশি। আওয়ামী ক্রিমিনাল গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সেই মাত্রায় মামলা নেই। প্রকৃত ক্রিমিনাল, ছাত্র-জনতা হত্যাকারী, হত্যার সহযোগীদের তালিকা মতো ধরপাকড় না হলে চলমান ডেভিল হান্ট অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এর মাঝে বিতাড়িত পরাজিতরা আবার ফেরার হুংকার দিচ্ছে। তারা ফিরলে জুলাই-আগস্ট বিজয়ীদের কী হবে? বিজয়ীদের কি রাজনৈতিকভাবে পরাজিতদের পুনর্বাসন উদ্যোগে শামিল হতে হবে? পরাজিতরা যাতে রাজনীতি-নির্বাচন করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে দেবে? পরাজিতরা মাফ না চাইলেও বিজয়ীরা ‘মাফ করে দিলাম’ ঘোষণা দেবে?Ñএমনতর নানা প্রশ্ন ঘুরছে চক্রাকারে। এ চক্রবৃত্তে বহুল আকাক্সিক্ষত সংস্কার দিনে দিনে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। প্রকারান্তরে সেখানেও একধরনের দুষ্টামি। ডেভিল-ইভিল তৎপরতায় সংস্কারের প্রস্তাব-সুপারিশ নিয়ে বাজে রকম প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় নয়াদিল্লির একটি আদল রয়েছে, যেখানে কেধন্দ্রশাসিত রাজধানী মহানগর সরকার গঠন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাসের কথা আছে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদবি পরিবর্তন, জেলা পরিষদ বাতিল, উপজেলা পর্যায়ে একজন এএসপিকে ‘জননিরাপত্তা অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মতো সুপারিশও রয়েছে। একটির বদলের তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন এবং উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে আনার মতো প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘জেলা প্রশাসক’ পদ বিপরিবর্তন করে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। ইংরেজিতে ‘ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’ ও ‘ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার’ হওয়ার সুবাদে সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ডিসি’ অপরিবর্তিত থাকবে।
অনেক দিন থেকেই এ নিয়ে সমালোচনা চলছিল। ডেপুটি কমিশনার, ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার বা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের বাংলা অনুবাদ মোটেই জেলা প্রশাসক হয় না। সেই আলোকে ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ পদবির বদলে ‘উপজেলা কমিশনার’ করতে বলা হয়েছে। ইংরেজিতে যা অভিহিত হবে সাব-ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার বা এসডিসি হিসেবে। এ ছাড়া ‘অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)’ এর স্থলে ‘অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা)’ করা যেতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এসব সংস্কার প্রস্তাবে আমলা মহল ব্যথিত। বিশেষ করে ডিসিরা। তারা তাদের বাংলা তরজমা ‘জেলা প্রশাসক’ রাখতে চান। ‘শাসক-প্রশাসক’ শব্দ ডিসিসহ আমলাদের খুব পছন্দের।
এদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন প্রস্তাবকে জনবিরোধী উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বিসিএস প্রশাসন ছাড়া ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত এই পরিষদের নেতারা বলছেন, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে কোনো কোটা মেনে নেওয়া হবে না। রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া বুঝে আমলারা সাহসী হয়ে উঠেছেন। চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার ভাবনা এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাবকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলেছে বিএনপি। তাদের অনুসরণে আরও কয়েকটি দলের নেতারা বলছেন, এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব জটিলতা বাড়াবে। এ ছাড়া এত দিন পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরির উদ্যোগকেও ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তারা মনে করেন, এই মুহূর্তে এর কোনো দরকার নেই।
প্রবীণ সাবেক আমলা প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দীনও চুপ থাকেননি। তার সমালোচনা নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কয়েকটি সুপারিশ নিয়ে। বিশেষ করে বিদায় নেওয়ার পর ইসির বিষয়ে তদন্তভার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাতে দিলে এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা নিয়ে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ করার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে তা ইসির স্বাধীনতা ‘খর্ব করবে’ বলে মন্তব্য করেছেন সিইসি। এ মতে তিনি একা নন, সহকর্মীসহ আমলা মহলের অনেকের মতিগতি প্রকাশ পেয়েছে তার কথায়।