হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে ফিরিয়ে নিতেই সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়েছেন।
হার মানা যেন তার স্বভাবে নেই। এ কারণে অদম্য ট্রাম্প ২০২০ সালের ভোটে হেরেও পরাজয় মানতে অস্বীকার করেছিলেন। সেখান থেকে বীরের বেশে ফিরে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে চার বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার নিলেন তিনি; বাসিন্দা হলেন হোয়াইট হাউসের।
গত ২০ জানুয়ারি স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের সবার নজর তখন ওয়াশিংটনে তার অভিষেক অনুষ্ঠানে। পাদপ্রদীপের আলোর পুরোটা জুড়েই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ হতে যাওয়া ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসা ট্রাম্প।
দুইটি বাইবেলে হাত রেখে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন এই চির তরুণ রিপাবলিকান নেতা। শপথ নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বর্ণযুগ’ শুরুর ঘোষণা দেন নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের গল্প তৈরি করা এই রাজনীতিক।
তার এই যাত্রার মধ্য দিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, আরেক ‘ট্রাম্প যুগে’ প্রবেশ করল গোটা বিশ্বও। অথচ গল্পটা ভিন্নও হতে পারত।
বছরের পর বছর নানা বিতর্ক জন্ম দিয়ে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকিতে ছিলেন তিনি। অভিশংসিত হয়েছেন, একাধিক ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন, দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন। এত কিছুর মধ্যে আততায়ীর বুলেট এড়িয়ে আমেরিকার ইতিহাসে সবাইকে তাক লাগিয়ে বীরদর্পেই হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন হয়েছে তার।
সোমবার ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস ভবনে ‘ক্যাপিটল রোটুন্ডায়’ প্রত্যাবর্তনের নজরকাড়া অভিষেকে ট্রাম্প বক্তব্য শুরু করেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিসসহ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে।
এর আগে দুইটি বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেন ট্রাম্প। এর একটি তার মায়ের দেওয়া। অন্যটি আব্রাহাম লিংকনের, যেটিতে শপথ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আগের কয়েকজন প্রেসিডেন্টও। ১৮৬১ সালে আব্রাহামও এ বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন।
দেড়শ বছরের সেই পুরোনো বাইবেল ছুঁয়ে ট্রাম্প দৃঢ়কণ্ঠে শপথ বাক্য উচ্চারণ করেন। এরপর অভিষেক ভাষণে আরও জোরালো কণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক এই মুহূর্ত থেকে শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণযুগ। আজ থেকে আমাদের দেশ সমৃদ্ধ এবং সম্মানিত হবে। আমি যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে রাখব।’
যুক্তরাষ্ট্র যেন শ্রেষ্ঠত্বের আসন ফিরে পায়, সে জন্যই সৃষ্টিকর্তা তাকে আততায়ীর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন মন্তব্য করে ট্রাম্প বলেন, মার্কিনিদের ব্যবহার করে অন্য দেশ সমৃদ্ধ হবে, সেটা তিনি আর ঘটতে দেবেন না।
স্বভাবসুলভভাবেই, আমরিকার পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের হুমকি দিয়েছেন নতুন প্রেসিডেন্ট।
নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার এবং ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র আবার নিজেদের বর্ধনশীল একটি জাতি হিসেবেই গণ্য করবে এমন আশা জাগিয়ে ট্রাম্প ‘আমেরিকার সম্পদ এবং ভূখণ্ড বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছেন ভাষণে।
অভিষেক ভাষণে তিনি বিশ্বের জন্যও দিয়েছেন কড়া বার্তা। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ঐক্য বজায় রাখায় ভূমিকা নেওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরের কথাও তিনি সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন।
তার ভাষণটি ছিল বিশ্বকে দেওয়া আরেক কঠোর এবং চ্যালেঞ্জিং বক্তব্য। আর তাতে ছিল আমেরিকার শক্তি ও সম্ভাবনার ফুলঝুরি।
শপথ নিয়েই প্রথম দিন একশোর বেশি নির্বাহী আদেশ সই করলেন ট্রাম্প। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে অ্যামেরিকার সরে আসা, ক্যাপিটলে দাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত দেড় হাজার সমর্থকের মুক্তি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্ব বাতিল : যুক্তরাষ্ট্রে জন্মালেই মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান স্বীকৃত এই আইনে বদল করতে চাইছেন ট্রাম্প। এদিন ওভাল অফিসে বসে এই বিষয়েও একটি প্রশাসনিক নির্দেশে সই করেছেন তিনি।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, সংবিধান স্বীকৃত এই অধিকার এইভাবে প্রশাসনিক নির্দেশে বদল করা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্ত আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে।
আশ্রয়প্রার্থীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল : ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম প্রভাব তার উদ্বোধনের কয়েক মিনিট পরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আশ্রয়প্রার্থীদের অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে চালু করা একটি অ্যাপ অফলাইন হয়ে যায়। এই অ্যাপের মাধ্যমে মূলত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের জন্য আগে থেকেই বুকিং করতে হয়।
মার্কিন গণমাধ্যম জানিয়েছে, এই অ্যাপে ৩০ হাজার লোকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নির্ধারিত ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের ‘নতুন যুগে’ বিশ্ব কেবল তার প্রথম মেয়াদের (২০১৭-২০২১) পুনরাবৃত্তিই দেখবে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি নিপীড়নমূলক, বর্ণবাদী ও আত্মগরিমাপূর্ণ চরিত্র সামনে আসারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
মেক্সিকো সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা : ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণায় সই করেছেন। এর ফলে ট্রাম্প এই সীমান্তে সেনা পাঠাতে পারবেন। তিনি বলেছেন, ‘আইনি পথে অভিবাসীরা আসুক, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমাদের মানুষ দরকার। কিন্তু তাদের আইনি পথে আসতে হবে।’
আরেকটি নির্দেশে বলা হয়েছে, মোক্সিকোর মাদক পাচারকারী সংগঠনগুলেঅ হলো সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।
ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গাকারীদের ক্ষমা : ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে ঢুকে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল এবং ব্যাপক ভাঙচুর করেছিল ট্রাম্প সমর্থকরা। বাইডেনের আমলে তাদের বিচার শুরু হয়। বেশ কয়েকজন শাস্তি পায়।
ট্রাম্প প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করে বলেছেন, তাদের সবাইকে ক্ষমা করা হলো। এদের প্রতি জাতীয় অন্যায় হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে সব বকেয়া মামলা প্রত্যাহার করা হবে। যারা জেলে আছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে।
সরকারি হিসাব, দেড় হাজার জনেরও বেশি মানুষকে ক্যাপিটল দাঙ্গার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম সুবিধা বাতিল : সরকারি কর্মীদের বাসায় থেকে দাপ্তরিক কাজ করার (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) সুবিধা বাতিল করে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন ট্রাম্প।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত : ট্রাম্প যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক নির্দেশে সই করেছেন, তা হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত। এই নির্দেশে বলা হয়েছে, এক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে এবং আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেবে।
ট্রাম্পের অভিযোগ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। কিছু সদস্য রাষ্ট্রের অন্যায্য রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এই সংস্থায়। চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এখানে অনেক বেশি অর্থ দিচ্ছে।
ট্রাম্প বলেছেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের ছিঁড়ে খাচ্ছে। সবাই অ্যামেরিকাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কিন্তু আমি তা আর হতে দেব না।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবচেয়ে বড় আর্থিক সাহায্যকারী ছিল অ্যামেরিকা। তারাই এই সংস্থার ১৮ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করতো।
২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প এই একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তা পরিবর্তন করেন এবং অ্যামেরিকা আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যোগ দেয়।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসা : বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করার জন্য এই চুক্তি করা হয়েছিল। তার থেকে সরে এলেন ট্রাম্প। তবে চুক্তির নিয়ম অনুসারে বর্তমান কোনো সদস্য দেশ জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাঠানোর পর এক বছরের মতো সময় লাগে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে।
ট্রাম্প এদিন জাতিসংঘকে আনুষ্ঠানিক নোটিশ দেয়ার সিদ্ধান্তে সই করেছেন। এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদক। আমরা ড্রিলিংয়ের কাজ অনেকটাই বাড়াব।’ প্রশাসনিক নির্দেশ জারির পর তিনি বলেছেন, ‘এখন আমরা ড্রিল করব। ড্রিল বেবি ড্রিল।’
টিকটকে নিষেধাজ্ঞা এখনই নয় : টিকটক নিয়ে আরেকটি প্রশাসনিক নির্দেশে সই করেছেন ট্রাম্প। সেখানে বলা হয়েছে, টিকটক নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত এখনই কার্যকর করা হবে না। প্রশাসনিক নির্দেশে বলা হয়েছে, টিকটক বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ৭৫ দিন পিছিয়ে দেওয়া হলো।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, ‘টিকটক বন্ধ করা হবে নাকি বিক্রি করা হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমাকে একটু সময় দিন।’
টিক টকের সিইও সোউ চিউ ট্রাম্পের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
কেমন হতে পারেন এবারের ট্রাম্প : ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ এখনই অনেকটা তার প্রথম মেয়াদের মতোই অনিশ্চয়তায় ভরা ও টালমাটাল মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তার সঙ্গে আছে রিপাবলিকানদের মধ্যকার নানা কোন্দলও। নির্বাচনে জয়ের পর থেকে শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত ট্রাম্প আইনি প্রক্রিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব ফলিয়ে এসেছেন।
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিজ্ঞতা যাচাই না করেই ট্রাম্প কেবল তার অনুগতদের নিয়োগ দিয়েছেন, যা নিয়ে হতবাক হয়েছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন ট্রাম্পের বেশ কিছু মিত্রও।
ট্রাম্পের কম যোগ্যতাসম্পন্ন এই অনুগতদের নতুন প্রশাসন সফলভাবে কতদূর যেতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তার ওপর নতুন এই প্রশাসনে আছেন ইলন মাস্কের মতো শীর্ষ ধনী। রাজনীতিতে ট্রাম্পকে ছাপিয়ে ইতোমধ্যেই যার প্রভাব অনেকটাই প্রকাশ্যে এসেছে।
ট্রাম্প শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক অর্থে, পবিত্র বাইবেলে হাত রাখা হয়ে গেছে ধনকুবের ইলন মাস্কেরও। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ সম্পর্ক নজিরবিহীন। উচ্চাকাক্সক্ষা, কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর প্রভাব রাখাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে মিল আছে মাস্কের।
তবে যথেষ্ট মিল থাকলেও বিরাট প্রভাবশালী এ দুই মানুষের ভার হোয়াইট হাউস বইতে পারবে কি না সেটি প্রশ্ন। মাস্ককে নিয়ে ট্রাম্প বড় ধরনের স্বার্থের সংঘাতে জড়াতে পারেন তেমন আশঙ্কা আছে। ট্রাম্প একজন কট্টর পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী; রাজনীতি কিংবা কূটনীতির চেয়েও তার ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।
ফলে ট্রাম্প দেশের স্বার্থকে নিজ স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিতে অপারগ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া ট্রাম্প শপথ গ্রহণের পরই ‘ডিপ স্টেট’ ভেঙে দিয়ে মার্কিন প্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য আগেই পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছেন।
ট্রাম্পের এবারের শাসনামলে কী কী ঘটতে পারে : দেশটির ফেডারেল সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করতে তিনি প্রস্তুত।
তার ভয়ঙ্কর নীলনকশা ‘প্রজেক্ট ২০২৫’ বা ‘প্রজেক্ট টু থাউজ্যান্ড টোয়েন্টিফাইভ’ এর আওতায় ফেডারেল সিভিল সার্ভিসের গোটা কাঠামোই এবার হুমকিতে থাকবে। এই নীলনকশা ধরে ট্রাম্প এবং কংগ্রেস ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন (ডিওই) এবং ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনস্ট্রেশনকে (এনওএএ) বাদ দিয়ে দেবেন।
পাশাপাশি বেসরকারিকরণ করবেন ট্রান্সপোর্ট সিকিউরিটি অ্যাডমিনসট্রেশন (টিএসএ), দ্য ন্যাশনাল ফ্লাড ইনস্যুরেন্স প্রোগ্রাম। ট্রাম্প-বিরোধীদের কথায়, এ প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘ভয়ঙ্কর বিপর্যয়’ ডেকে আনবে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বিপুলসংখ্যক উদারপন্থী কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করে ডানপন্থীদের জায়গা করে দেওয়া হতে পারে।
আর ট্রাম্প এবার যে কেবল হোয়াইট হাউসে ফিরছেন তাই নয়, তার দল রিপাবলিকান পার্টি কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে হারানো আধিপত্য ফিরে পেয়েছে। নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও তাদেরই জয়জয়কার।
সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার মানে, যেকোনো নীতি বাস্তবায়ন, আইন পাস ও বিচারপতি নিয়োগের কাজ সহজ হবে ট্রাম্পের জন্য। ফলে ট্রাম্প যেকোনো কাজ করতে খুব কমই বাধা পাবেন। সেকারণে নিজের সিদ্ধান্তগুলো সহজেই বাস্তবায়ন করে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠতে পারেন তিনি। সবচেয়ে বেশি বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বিষয় হয়ে উঠতে পারে ট্রাম্পের সাংবিধানিক ধারা ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে কেন্দ্রীভূত করাসহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে অনেকাংশে ক্ষুণ্ন করতে পারেন। বড় বড় টেক কোম্পানিগুলোকে দিতে পারেন সহ-শাসনের ক্ষমতা (কো-গভার্নিং পাওয়ার)।
বিচারবিভাগ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারেন এবং তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন। ট্রাম্প শপথ নেওয়ার আগেই গোপন এক কূটনৈতিক নথি থেকে এমন আভাস পাওয়া গেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে সতর্কবার্তাও দিয়েছেন।
এই সবকিছুর প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ট্রাম্পের ফিরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিশাল এক পরিবর্তনের সূচনা, যা কেবল দেশে নয় বিশ্বেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয় কেবল তার নিজের রাজনৈতিক দক্ষতাই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে গভীর বিভক্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ‘আমেরিকা সর্বাগ্রে’ নীতি নিয়ে ট্রাম্পের ফিরে আসা এবং দেশি বিষয়গুলো সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে।
ট্রাম্পের আগেরবারের শাসনামলে যে বিভেদ ও উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল, এবার তা আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা আছে, যার প্রভাব পড়তে পারে ঘরে-বাইরে সবখানে।
বিশ্বচালকের আসনে কেমন হবেন ট্রাম্প : ২০২৪ সালে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পরই বিশ্বে অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল।
অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন থেকে শুরু করে সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণ, প্রতিবেশী দেশ কানাডা ও মেক্সিকোসহ চীনের পণ্য রপ্তানিতে নতুন করে উচ্চ হারে শুল্কারোপের হুমকি, জলবায়ু নীতি বাতিলের পরিকল্পনা এবং কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল জোর করে নিতে চাওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ট্রাম্পের মন্তব্যই এ উদ্বেগ বা চিন্তার কারণ হয়েছে।
ফলে তার দ্বিতীয় মেয়াদ বিশ্বের জন্য কেমন হতে চলেছে তা এরই মধ্যে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বৈদেশিক নীতির দিক থেকে ট্রাম্প এবার বিদ্যমান নানা নীতি, যেগুলো এরই মধ্যে ধ্বংসাত্মক এবং ব্যয়বহুল প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলোরই আরও বিস্তার ঘটাতে পারেন। এতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ প্রথমবারের চেয়ে যে কেবল জটিল হবে তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, তাও তিনি ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
তার ‘আমেরিকা সর্বাগ্রে’ নীতির পুনরুত্থান বিশ্বব্যাপী একটি অস্থির পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তার এই নীতিতে বৈশ্বিক জোট এবং সহযোগিতার গণ্ডি সীমিত হয়ে পড়তে পারে এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপরও তা প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির যেকোনো পরিবর্তন বিশ্ববাজারে বিশাল প্রভাব ফেলে।
সর্বোপরি ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফেরা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কসহ দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে প্রভাব ফেলবে।