Thikana News
১৮ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪


 

মধ্যপ্রাচ্য কি পরমাণু যুদ্ধের সম্মুখীন?

মধ্যপ্রাচ্য কি পরমাণু যুদ্ধের সম্মুখীন?


জায়েনিস্টদের দ্বারা গাজা আক্রমণের এক বছর পূর্ণ হলো। ফিলিস্তিনি জাতি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিদ্যা-শিক্ষায় একটি সমৃদ্ধ জাতি ছিল। দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে তিলে তিলে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর, জায়গা দখল, বাস্তুচ্যুত করে ইসরায়েলিরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করে চলছে। প্রতিদিন তাদের হত্যা, নির্যাতন এবং কাঁটাতারের বেড়া ও দেয়াল নির্মাণ করে, খোলা আকাশের নিচে পৃথিবীর বৃহৎ কারাগারে বন্দী রাখছে ফিলিস্তিনিদের। নিজ ভূমে পরবাসী দুর্বিষহ জীবন করে রাখছে জায়েনিস্টরা। ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের দাবি স্বাধীন আবাসভূমি। অর্ধশতাব্দী থেকে স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে এই ভূখণ্ড। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বারবার আলোচনা হলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি। বরং দিন দিন আক্রমণ ও আগ্রাসনের মাত্রা বাড়ছেই। স্বাধীন ফিলিস্তিন এই আশা ক্রমেই ক্ষিয়মাণ। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা হার না-মানা জাতি। পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে লড়াই করছে। তাদের এই বীরত্বের সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
দেশমাতৃকার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। বিশ্বমোড়লদের কাছে তাদের দাবি উপেক্ষিত। তাই গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বিশ্ববাসীকে অবাক করে ইসরায়েলের ভূমিতে আক্রমণ করে। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিতে আধুনিক বিশ্বের সমরসজ্জিত ইসরায়েলি বাহিনী ও চৌকস মোসাদকে ফাঁকি দিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা ও ২৫০ লোককে জিম্মি করে নেয়। এই নিখুঁত, মরণপণ আঘাতের মধ্য দিয়ে হামাস জানান দেয়, তাদেরকে বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি সম্ভব নয়। তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় এর কোনো বিকল্প ছিল না।
এই ঘটনার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, এই আক্রমণের জন্য ফিলিস্তিনিদের চরম মূল্য দিতে হবে। এ রকম এক সুযোগের অপেক্ষায় যেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্থলে, বিমানে আক্রমণ শুরু করেন। ফলে প্রতিদিন নারী, শিশু, বৃদ্ধের লাশের পাহাড় জমা হয়। যার সংখ্যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার। আদম সন্তানদের অনেকে বিকলাঙ্গ হয়ে, কেউ কেউ হাত, পা, চোখ ইত্যাদি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। বাড়িঘর, হাসপাতাল, উপাসনালয়, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট সবকিছু ধ্বংস করে গাজাকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ, কালো ধোঁয়া, মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী। পৃথিবীর কোনো দেশ বা মানবজাতি নেই এই একতরফা আক্রমণ, গণহত্যাকে থামিয়ে নিরীহ মানুষদের ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করতে। এই নির্বিচারে নারী-শিশু গণহত্যা বন্ধের জন্য একমাত্র মানবতাবাদী মানুষেরা এবং সংগঠনগুলো বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরগুলোতে প্রতিনিয়ত মিটিং-মিছিল অব্যাহত রেখেছে। এই আগ্রাসী জায়েনিস্টদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে লড়াইয়ে যোগ দেয় হুতি বিদ্রোহী, হিজবুল্লাহসহ আরও কয়েকটি ছোট ছোট সশস্ত্র সংগঠন। উল্লেখ্য, এসব সংগঠনকে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে ইসরায়েলি বাহিনী সব সময় সিরিয়া, ইয়েমেনসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে হামলা চালায় এবং এসব দেশের সাধারণ মানুষকে হত্যা, বাড়িঘর ধ্বংস করে হয়রানির মধ্যে রাখে।
গাজাকে ধ্বংসস্তূপে, নরকে পরিণত করার পরিকল্পনা প্রায় সমাপ্ত। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিনের পাশের দেশ লেবাননে আক্রমণ শুরু করেছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর তুমুল লড়াই হচ্ছে। ইতিমধ্যেই দুই হাজার মানুষ নিহত এবং ১০ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে। লেবানন সরকারের হিসাবে ১০ দিনে প্রায় চার লাখের বেশি মানুষ ভয়ে সিরিয়ায় পালিয়েছে। রাজধানী বৈরুতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থাপনা গাজার ন্যায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার কাজ শুরু করেছে। সুযোগ পেয়েই চোরাগোপ্তা হামলা করে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া ও হিজবুল্লাহর প্রধান নসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। হিজবুল্লাহর নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান সাফি আল দ্বীনকেও ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে বলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরানের কুদস ফোর্স ও আইআরজিসির প্রধান বিখ্যাত সমরবিদ মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকেও তারা হত্যা করে। রক্তপিপাসু জায়েনিস্টদের আক্রমণে প্রেসিডেন্ট থেকে বিজ্ঞানী, কূটনীতিবিদ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, অতিশিগগিরই লেবাননের অবস্থা গাজার মতো হবে। আরব বিশ্বসহ বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম দেশের চোখের সামনে ছোট্ট একটা ইহুদি রাষ্ট্র তাদের মিত্র ইউরোপ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় মুসলমানদের রক্তে হোলিখেলা করছে। একের পর এক দেশ দখল করে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে দেশছাড়া, যাযাবর করছে। ইরানসহ হাতে গোনা ছোট্ট কয়েকটি মুসলিম দেশ ছাড়া সবাই নির্বিকার। নিজের গা বাঁচানো আর পশ্চিমাদের সঙ্গে দালালি নিয়েই তারা ব্যস্ত। এদিকে অনেক দিন থেকেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর টার্গেট ইরান। কারণ ইরানই প্রথম থেকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাসহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অস্ত্রসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
তাই ইসরায়েলি বাহিনী একে একে সবাইকে পর্যুদস্ত করার পর এবার ইরানে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। এদিকে ইরানের মাটিতে এবং অন্যান্য দেশেও তাদের কূটনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের একের পর এক হত্যা করে চলেছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর হিজবুল্লার প্রধান হাসান নসরুল্লাহকে বিমান হামলার মাধ্যমে হত্যার পর পরিস্থিতি সার্বিক যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়। এই হত্যার পর এর বদলা নেওয়ার জন্য ইরানও সুযোগ খুঁজছিল। তাই গত ১ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে ইরান ১৮০টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল, তেল আবিব, হাইফা, জেরুজালেমের মতো প্রধান শহরগুলোতে আঘাত হানে। এ সময় ইসরায়েলে বিপৎসংকেত সাইরেন বাজালে মন্ত্রিপরিষদসহ সাধারণ মানুষকেও এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এই হামলার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলের মাটিতে আঘাতের জন্য ইরানকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে। তাদের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের আক্রমণ প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতৃত্ব উভয় পক্ষকেই ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান। ইরান বলেছে, ইসরায়েল যদি আর হামলা না করে, তবে তারাও আর হামলা চালাবে না।
কিন্তু মুসলিম রক্তপিপাসু উন্মাদ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেকোনো ছুতোয় ইরানে আক্রমণের অপেক্ষায়। কারণ এত দিন ধরে তারা ইরানের সহযোগী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করে আসছে। সুতরাং এখন তারা ফাইনাল মহড়া দিতে চায়। ইসরায়েল থেকে ইরানের দূরত্ব প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার হওয়ায় অতীতে এই দুই দেশ কখনো যুদ্ধের মুখোমুখি হয়নি। সে কারণে ইসরায়েলি বাহিনী হিসাব-নিকাশ করে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আঘাত হানবে। তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো আরব ভূখণ্ডে ইহুদিদের একক সাম্রাজ্য ও আধিপত্য বিস্তার করা। বিশ্বনেতৃত্ব যা-ই বলুক না কেন, সে কখনোই জাতিসংঘ বা বিশ্বনেতাদের অনুরোধ আমলে নেয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই আক্রমণ শুধু সময়ের ব্যাপার। ইসরায়েলের আক্রমণের ভয়াবহতা হবে ভয়ংকর। কারণ ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে কি না, কেউ জানে না। গত ৫ অক্টোবর ইরানে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কারণ এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। সবাই ধারণা করছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করছে। সুতরাং একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের ওপর যদি আক্রমণ হয়, তবে সেই দেশ শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে লড়বে। আর ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তু হবে ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষতি ও ধ্বংস করা। তাই তাদের প্রধান টার্গেট পারমাণবিক স্থাপনা এবং ‘খার্গ আইল্যান্ড’, যা পারস্য উপসাগরের ২০ কিলোমিটার আয়তনের রুক্ষ পাথুরে দ্বীপ। এই ছোট্ট দ্বীপটির ওপর নির্ভর করছে বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা, বিশ্বের অর্থনীতি, স্থিতিশীলতা। এই দ্বীপটি ইরানের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। এই দ্বীপের ‘অয়েল টার্মিনাল’ দিয়েই ইরান দেশের ৯০ ভাগ তেল রফতানি করে। সুতরাং দ্বীপটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশ্ব বঞ্চিত হবে প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ব্যারেল তেল থেকে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। এ নিয়েই বিশ্বনেতৃত্ব উদ্বিগ্ন। এই আক্রমণের কারণে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে নরকে পরিণত করে সূত্রপাত হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। বিশ্বনেতৃত্বের নাকের ডগায় ছোট্ট একটা ইহুদি রাষ্ট্র মার্কিনি ও তার সহযোগীদের দ্বারা সারা পৃথিবী অশান্ত করে তুলছে। বিশ্বশান্তি ও মানবজীবনকে ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষার জন্য এই মুহূর্তে জায়েনিস্টদের লাগাম টেনে ধরা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক

কমেন্ট বক্স