Thikana News
১৮ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪


 

মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও তাপসীর কাউন্টডাউন

মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও তাপসীর কাউন্টডাউন


মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সর্বত্র। আধুনিক সভ্য সমাজে কারও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সামাজিকভাবে নিন্দনীয় এবং আইনগতভাবেও অপরাধ। তাই বলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দুনিয়ার কোথাও অবাধ নয়। কোনো কোনো মত নৈতিকতার দিক দিয়ে প্রকাশযোগ্য নয়। কোনোটি আবার সামাজিকভাবেও নিষিদ্ধের পর্যায়ে। আবার কিছু কিছু মতামত আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কারও ওপর আপনি বিরক্ত হয়ে যদি তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে হয় এবং আপনার এই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন, তাহলে যেকোনো সভ্য দেশের পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করবে। কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে এবং কেউ যদি এই হত্যাকারীর হত্যাকাণ্ডের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে, তাহলেও সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার সামাজিক ও নৈতিকতার দিক দিয়েও অনেক ইচ্ছা প্রকাশযোগ্য নয়।
আবার অনেক মতামতকে বিভিন্ন দেশে আইনগতভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া আছে। ইউরোপের দেশগুলোতে হলোকাস্ট অস্বীকার করা আইনত অপরাধ। পৃথিবীর বড় বড় ইতিহাসবিদ ও আইনজীবীরা বিভিন্ন গণহত্যাকে অস্বীকার করার কারণে জেল-জরিমানা গুনতে হয়েছে। ব্রিটিশ-আমেরিকান ইতিহাসবিদ প্রফেসর বার্নার্ড লুইস আর্মেনিয়ার হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। একটি ফরাসি পত্রিকায় এ রকম মতামত দেওয়ায় আদালত তাকে এক ফ্রাঙ্ক জরিমানা করেন। উল্লেখ্য, তিনি হত্যার পক্ষে বা হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করেননি। শুধু একাডেমিক বিশ্লেষণে বলেছিলেন, এটা গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না। এভাবে হলোকাস্ট অস্বীকার করার কারণে ব্রিটিশ লেখক ডেভিড আর্ভিংকে ভিয়েনার আদালত এবং মার্কিন অধ্যাপক পিটার আর্লিন্ডারকে রুয়ান্ডার গণহত্যা অস্বীকার করার জন্য রুয়ান্ডার আদালত জেল দেন।
আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এই ব্যক্তিরা আদালত কর্তৃক জেল-জরিমানার মুখোমুখি হয়েছেন শুধু একাডেমিক ডিসকাশনের জন্য। সাধারণ হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে গণহত্যার পার্থক্য করতে গিয়ে কয়েকটি জায়গায় গণহত্যাকে অস্বীকার করায় তাদেরকে আদালত রেহাই দেয়নি। তারা যদি এসব হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করে ভিকটিমকে ডেমোনাইজ করার চেষ্টা করতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক এসব আদালতে তাদের বিচার হতো হত্যাকারী হিসেবে।
এখন আসা যাক, বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা তাপসী তাবাসসুম উর্মির সাম্প্রতিক ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তাপসীর বিস্ফোরক মন্তব্যের ব্যবচ্ছেদ করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অসাংবিধানিক বলেছেন। এই সরকারের পতনের কাউন্টডাউন শুরু করেছেন। একাত্তরের চেতনা নিয়ে তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেছেন। জুলাই-আগস্ট গণহত্যাকে তদন্তসাপেক্ষ বলে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করেছেন। একই সঙ্গে শহীদ আবু সাঈদকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজেকে গণহত্যাকারীর দলভুক্ত করেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য এবং সরকার পতনের কাউন্টডাউন শুরুর মাধ্যমে তিনি চাকরিবিধি ভঙ্গ করেছেন বিধায় তার বিভাগীয় শাস্তি শুরু হয়েছে। তাকে প্রথমে ওএসডি এবং পরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এই শাস্তি দেখে অনেকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে হইচই শুরু করেছেন। সরকারি চাকরি করে সরকার পতনের হুংকার দেওয়ার পরও যারা এটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে চান, এরা আসলে মতলববাজ। এদের ফেসবুক ওয়ালে যান, দেখতে পাবেন না শেখ হাসিনা সরকারের চরম মানবাধিকার-বিরোধী কাজ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো টুঁ শব্দটি। একটি কবিতা লেখার অপরাধে প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সাইদুর রহমানকে (কবি রহমান হেনরি) চাকরিচ্যুত করার সময় এরা নীরব ছিল। আব্দুল কাদের মোল্লার নামের সঙ্গে শহীদ শব্দটি লাগানোর কারণে একজন প্রবীণ সম্পাদক আবুল আসাদকে পত্রিকা অফিস থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা যখন ধরে নিয়ে এসে পুলিশের হাতে তুলে দেয় এবং তাকে জেল খাটতে হয়, তখনো এই মতলববাজরা কথা বলেনি। আবুল আসাদের উদ্ধত কলমের দিকে নির্বাক নয়নে তাকিয়ে ছিল পুরো জাতি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসীরাও কথা বলেনি তার পক্ষে।
আমার উপজেলা হাসপাতালের একজন ডাক্তার শেখ হাসিনার আমলে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এ জন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্থানীয় ছাত্রলীগের ছেলেরা থানায় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের ছেলেরা হন্যে হয়ে তাকে খোঁজে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাকরিরত অবস্থায় ওই ডাক্তারের এ রকম ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়াকে পছন্দ করিনি। কিন্তু এই ডাক্তার সাহেবের বিরুদ্ধে যে আওয়ামী জুলুমের শুরু হয়েছিল, তখন তা ছিল নজিরবিহীন। এই ডাক্তারের পরিবার বিভিন্ন হুমকি-ধমকিতে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তখন। আজকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল।
তাপসী তাবাসসুম উর্মির বিরুদ্ধে এ রকম কোনো কাজ করা হয়নি। কেউ তাকে নির্যাতন করতে যায়নি। কেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেনি। তার পরিবার এখনো কোনো হুমকি পেয়েছে বলে শুনিনি। অবশ্যই কেউ তাপসীকে নির্যাতনের হুমকি দিলে আমরা এর প্রতিবাদ করব। সে যে মতামত প্রকাশ করেছে, তা একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে দিতে পারে না। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবেÑএটাই স্বাভাবিক। একই সঙ্গে তার নিরাপত্তা দেবে, এটাও আমরা চাই।
কিন্তু গণহত্যা অস্বীকার করে ভিকটিমকে ডেমোনাইজ করা নিশ্চয় ফৌজদারি অপরাধ। হাজার হাজার শহীদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। এখনো শহীদদের কবরের মাটি শক্ত হয়নি। এ অবস্থায় সরকারের চাকরি করে একজন মানুষ কীভাবে শহীদ আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলার সাহস পায়! কীভাবে এখনো সে গ্রেফতার না হয়ে আইনের নাগালের বাইরে থাকে, তা এক বিস্ময়কর ঘটনা। গণহত্যা অস্বীকার এবং শহীদদের চরিত্রহননের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি দেখিনি! মজলুমের মুক্তি আন্দোলনের আইকন শহীদ আবু সাঈদও হয়তো কবর থেকে তার জীবিত সহযোদ্ধাদের নীরবতা ও ফ্যাসিস্ট খুনিদের উদ্ধত আস্ফালন দেখে চিৎকার করছে!
এখন বাংলাদেশের মানুষই ঠিক করবে তাদের মতপ্রকাশের সীমা-পরিসীমা কতটুকু। তাপসীর মতো আরেকজন হয়তো অন্য সময়ে বলবে মুগ্ধ ছিল মাদক ব্যবসায়ী। পানির বোতলে আসলে পানি নয়Ñছিল মাদক। এভাবে বীর শহীদদের চরিত্রহননকে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে বাংলাদেশের বীর জনতা মেনে নেবে নাকি আন্তর্জাতিক আইনি দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করবে, তা একান্তই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সিদ্ধান্তের বিষয়।
তাপসী কাউন্টডাউন শুরু করেছেন এই সরকারের পতন ও তার নেত্রী ফিরে আসার। নেত্রীর এক মাসের মধ্যে ফিরে আসার অডিও শুনে তিনি হয়তো আশাবাদী হয়েছেন। জুয়ায় বাজি ধরেছেন এসব বেআইনি ও চাকরির আচরণবিরোধী মন্তব্য করে। এক মাসের মধ্যে শেখ হাসিনা ফিরে এলে তিনি হয়তো যা হারাবেন তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি ফেরত পাবেন। কিন্তু তাপসীরা বুঝতে ভুল করছেন, এখনো হাজার হাজার শহীদের কবরের মাটি নরম রয়ে গেছে। এসব কবরের মাটি থেকে ভেসে আসা রক্তের ঘ্রাণ তাদের সহযোদ্ধাদের পাগল করে তুলবে। খুনি হাসিনার জন্য বাংলার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি আগুনের মতো জ্বলে উঠবে। ছাইচাপা এ আগুন উসকে দিলে পতিত ফ্যাসিস্ট ও তার দোসররা আরও অনেক বছর তা সামলাতে পারবে না। তাপসীর মাধ্যমে ফ্যাসিস্টরা আগুনের তাপ কতটুকু এখনো আছে, তা একটু আঁচ করতে চাচ্ছে। প্রফেসর ইউনূস সরকারের আপাত হযবরল ও উদারতার মাপকাঠিতে জনতার হৃদয়ের আগুনের তাপ মাপলে ওরা আরেকবার ভুল করবে। নিশ্চিত ভুল করবে। তাপসী যেমন মতপ্রকাশের শেষ সীমা এবং অপরাধ শুরুর সীমানা চিনতে ভুল করেছেন।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান।
 

কমেন্ট বক্স