Thikana News
১৮ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪


 

চট্টগ্রাম ও পশ্চিমবঙ্গের পূজামণ্ডপে ইসলামি গান, মোরাল পুলিশিং ও ফ্যাসিবাদের প্রতিস্থাপন

চট্টগ্রাম ও পশ্চিমবঙ্গের পূজামণ্ডপে ইসলামি গান, মোরাল পুলিশিং ও ফ্যাসিবাদের প্রতিস্থাপন


‘আমার হৃদয় মাঝে কাবা, নয়নে মদিনা’Ñভারতের একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে নবীকে নিয়ে গান গাইছেন সুতাপা গাঙ্গুলি নামের এক গায়িকা। পেছনে দুর্গা প্রতিমা। সামনে দেবী দর্শনে আসা মানুষজন উপভোগ করছেন সেই গান। আর ধারণকৃত পুরো গানটি শেয়ার করেছেন কেএসইউসি দুর্গাপূজা গ্রুপ থেকে স্বপন কুমার দাশ নামের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক মানুষ। ঘটনাটি ২০১৮ সালের অক্টোবরের দুর্গাপূজার। তখন থেকেই ভারতে এমনটা চলে আসছে।
ভারতে পূজামণ্ডপে নবীকে নিয়ে গান। কোনো মোরাল পুলিশিং নেই। সেখানে বিজেপি আর শিবসেনার লোকজন বাধা দিচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটা। ইসলামি গান গায় এমন গানের দলকে নেমন্তন্ন করে আনা হচ্ছে, তাদের গাইতে বলা হচ্ছে। তারা তো গায় ইসলামি গান, আর কী গাইবে! তারা যখন তাদের ঘরানার গান গাইল, তখনই তুমুল শোরগোল। সব রসাতলে গেল। স্লোগান উঠল জয় শ্রীরাম এবং হর হর মহাদেব বলে। ধর্ম রসাতলে গেল বলে মাতম উঠল। বিপরীতে ভারতের মণ্ডপে সেই ২০১৮ থেকে নবীকে নিয়ে গান চলছে। গাইছেন খোদ হিন্দু গায়িকা।
বিপরীত চিত্রও রয়েছে। ইসলামি স্কলার ডা. জাকির নায়েক যখন হিন্দুধর্মের বেদ, গীতা সব থেকে উদাহরণ দেন, তখন বাংলাদেশে তাদের অনুসারীরা বলেন, ‘দেখো, জাকির নায়েক সব জানেন।’ তারা গর্ববোধ করেন জাকির নায়েকের পাণ্ডিত্যের। অথচ বাংলাদেশের পূজামণ্ডপে যখন কোনো ইসলামিস্ট গীতার শ্লোক উচ্চারণ করেন, তখন রব ওঠে সেই গেল গেল বলে। জাকির নায়েক গীতার শ্লোক বললে ঠিক আছে, কিন্তু অন্য কোনো ইসলামিস্ট বললে প্রশ্ন ওঠার কারণ কী? বাংলাদেশে এত মোরাল পুলিশিং কেন?
তবে বলে রাখি, উপরিল্লিখিত দুটো কাজই ভুল। কেন ভুল ব্যাখ্যা করতে গেলে ইনক্লুসিভ ও ইনক্লুসিভিটি বিষয়টি বুঝতে হবে। বাংলাভাষী হিসেবে মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পণ্ডিতেরা অসাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িকতার ইংরেজি করেছিলেন সেক্যুলার ও সেক্যুলারিজম বলে। কিন্তু আমরা জুলাই বিপ্লবোত্তর যে সমাজ গড়তে চাইছি, তার সঙ্গে সেক্যুলার সমাজের বিস্তর ফারাক রয়েছে। সেক্যুলার ও সেক্যুলারিজমের মূল প্রায়োগিক অর্থ হলো ধর্মহীন ও ধর্মহীনতা। কিন্তু আমাদের সমাজ ধর্মহীনতার বিপক্ষে। সুতরাং ধর্মহীনদের গ্রহণ করলেও ধর্মহীনতাকে এ সমাজ গ্রহণ করে না। সেক্যুলারিজমের ধারণাটা আমাদের সমাজের সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। যাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা যদি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি সমাজ গড়তে চাই, তবে নতুন ধারণায় এগিয়ে যেতে হবে। সেই ধারণাটিই হচ্ছে ইনক্লুসিভিটি। আভিধানিকভাবে বলতে গেলে, ইনক্লুসিভিটি মূলত একটি সামাজিক ধারণা, যা বৈষম্যহীনতার সঙ্গে সমাজের প্রতিটি অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। আমরা যে ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটি ব্যবহার করি, তা মূলত ধর্মহীনতা। সে অনুযায়ী সেক্যুলার হতে গেলে সবাইকে ধর্মহীন হতে হয়। কিন্তু ইনক্লুসিভ হতে গেলে কিছুই ত্যাগ করতে হয় না, হীন হতে হয় না, শুধু অংশীদার হতে হয়। কিন্তু এই অংশীদারিত্ব মানে পূজায় ইসলামি গান কিংবা মিলাদে ভজন গাওয়া নয়। পরস্পরের ধর্ম, সংস্কৃতি তথা আচরণগত বৈচিত্র্য বজায় রেখেই সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রগত চিন্তায় এক থাকাই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা, ইনক্লুসিভিটি।
বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে গেলে ধর্মকে তার অবস্থানে রাখতে হবে। সঙ্গে ধর্মের উৎসবকেও। এই যে পূজায় ইসলামি গান, এটা ইনক্লুসিভিটি নয়। ইনক্লুসিভিটি না বোঝার কারণে এই গন্ডগোলটা সৃষ্টি হয়েছে। উপরেই বলেছি, ইনক্লুসিভ তথা অসাম্প্রদায়িক হতে গেলে কোনো কিছুই ত্যাগ করতে হয় না, বরং খেয়াল রাখতে হয় অংশীজন হতে গিয়ে অন্যের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করছি কি না। যে ঘটনাটা ঘটেছে চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে।
সেখানে পূজামণ্ডপের এক কর্মকর্তা ইসলামি গান গায় এমন একটি দলকে পূজার অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ইসলামি গানের দল, তারা তো তাদের ঘরানার গানই গাইবে। তার পরও সে দলটি চেষ্টা করেছে সংগতিপূর্ণ গান গাওয়ার জন্য। সে জন্যই তাদের গানের কথা ছিল রাসুলকে ঘিরে। তারা গানের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছিলেন, রাসুল অন্য ধর্মের অধিকার রক্ষার কথা বলেছেন। রাসুল বলেছেন, যারা অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর অত্যাচার করে, শেষ বিচারের দিনে তিনি তার পক্ষে সাফাই গাইবেন না। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল স্থান-কাল-পাত্র নির্ধারণের ভুলে।
শুরুতেই বলেছি, এই ভুলটা শুরু হয়েছিল খোদ ভারতেই। ২০১৮ সালের দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। সে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি পূজামণ্ডপের অনুষ্ঠানে প্রতিমাকে পাশে রেখে সুতাপা গাঙ্গুলি নামের একজন গায়িকা গাইছেন ‘আমার হৃদয় মাঝে কাবা, নয়নে মদিনা’ গানটি। যে গানটি খোদা ও রাসুলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের গান। সে গান নিয়ে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোনো প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, যেমন উঠল এবার বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে। দেওয়া হলো ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির স্লোগান জয় শ্রীরাম এবং শিবসেনার হর হর মহাদেব স্লোগান।
পশ্চিমবঙ্গে একসময় বাম রাজত্ব ছিল। এখনো বহু মানুষ বামধারায় বিশ্বাসী। পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের বামদের সবচেয়ে ভুল হলো তারা ইনক্লুসিভ সমাজ গড়তে চায়নি, চেয়েছে সেক্যুলার সমাজ গড়তে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের পূজায় খোদা ও রাসুলের আনুগত্য-বিষয়ক গান গাওয়া হয়েছে। এই গান মূলত সমাজকে এক করার পরিবর্তে সমাজের বৈচিত্র্যকে নষ্ট করেছে। চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপেও হয়তো সে চিন্তাতেই ইসলামি গানের দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু এখানে শুধু বৈচিত্র্যই নষ্ট হয়নি, সামাজিক বিভেদেরও সৃষ্টি হয়েছে।
বিভেদের সৃষ্টি হয়েছিল না বলে অবশ্য সৃষ্টি করা হয়েছিল বলাই ভালো। মুখে স্বীকার না করলেও আমরা সবাই জানি, ফ্যাসিস্ট রেজিমের পরাজয় ভারত এবং অনেক ভারতীয় নিজেদের ব্যক্তিগত পরাজয় ভেবে নিয়েছে। তারা চেষ্টা করছে ফ্যাসিস্ট রেজিমকে পুনঃস্থাপনের। সেই প্রচেষ্টায় ভারত ও বাংলাদেশ থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরোনো ছবি ও ভিডিওকে এখনকার ভিডিও বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেসব গুজবে। ১১ অক্টোবর আজকের পত্রিকা একটি রিপোর্ট করেছে তাদের ফ্যাক্টচেক ডেস্কের বরাত দিয়ে। খবরটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘মন্দিরে ভাঙচুরের পুরোনো এবং প্রতিমার সামনে মোনাজাতের জোড়াতালি ছবিতে সয়লাব সোশ্যাল মিডিয়া’। এ খবরেও একই কথা বলা হয়েছে গুজবের ব্যাপারে। তারা পরিষ্কার জানিয়েছে, এগুলো সব গুজব। অর্থাৎ গুজবের ওপর ভর করে এবার দুর্গাপূজায় হাঙ্গামা বাধানোর একটা চেষ্টা ছিল, যা মূলত সফল হয়নি। তাই ভর করা হয়েছে চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে ইসলামি গান এবং পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের পূজামণ্ডপে একটি ছিনতাই ঘটনার ওপর।
চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে ইসলামি গান বিষয়টা নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু খুব দূর এগোতে পারেনি। কারণ পূজা কমিটির লোকই সেই গানের দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেহেতু দোষটা মূলত পূজা কমিটির সেই লোকের। তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে পূজা কমিটি থেকে। আর তাঁতীবাজারের ঘটনা নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন সামাজিক মাধ্যমে সরব হয়েছেন। তিনি বলতে চেষ্টা করেছেন, তাঁতীবাজার পূজামণ্ডপে পেট্রোল বোমা নিয়ে হামলার চেষ্টা হয়েছিল, এমন কথা। সেটাও ধোপে টেকেনি। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে সেটা ছিল স্রেফ ছিনতাই চেষ্টা। পূজামণ্ডপের সঙ্গে যার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
না, চেষ্টা হয়তো এখানেই থেমে থাকবে না। পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত    চলবে। এরপর লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজাসহ অন্যান্য পূজাও রয়েছে, সেগুলোও সম্ভবত বাদ যাবে না। কারণ রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রত্যাবর্তন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন শুধু একটা রাস্তা বাকি, সে হলো সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জঙ্গি ফ্যাক্টরগুলোকে সামনে আনা। প্রমাণ করা ফ্যাসিস্ট রেজিম পতনের ফলে বাংলাদেশের ইসলামি এক্সিট্রিমিজমের উত্থান ঘটেছে। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন হারাবে বর্তমান কিংবা সম্ভাব্য ক্ষমতাসীনরা। আর এভাবেই সম্ভব হবে ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া। সুতরাং ওদের ভাষাতেই বলি, ‘সাধু সাবধান’।

কমেন্ট বক্স