কৈফিয়ত : এ প্রতিবেদনটি সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগের গুণকীর্তন করার জন্য নয়। পৃথিবীতে যত কার্যকর ও স্থায়ী গণতন্ত্র বিদ্যমান, সেখানকার সব দেশেই দুটি বৃহৎ দল পর্যায়ক্রমে জনমতের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসে। যেমন আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান, ব্রিটেনে লেবার-কনজারভেটিভ, ভারতে বিজেপি-কংগ্রেস ইত্যাদি। বাংলাদেশেও দ্বিদলীয় আওয়ামী লীগ-বিএনপি চর্চা ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু হাসিনা সরকার তা স্তব্ধ করে স্বৈরাচারিতা চালু করে। আবার ছোট ছোট দল নিয়ে গণতন্ত্র থাকলে মতদ্বৈধতা বা দল বেচাকেনার কারণে সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যেমন ইসরায়েলের ছোট ছোট দল নিয়ে গঠিত সরকার ভেঙে পড়ায় কোনো বছরে তিনবারও নির্বাচন দিতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ একটি বড় দল, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য এই বড় দলটির কি প্রয়োজন নেই? শেখ হাসিনা খুনি ও লোভী ছিলেন বলে ভবিষ্যতের কোনো সৎ নেতৃত্ব নিয়ে কি দলটি গণতন্ত্র-চর্চা করতে পারবে না? দলটির সুস্থভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যই এ প্রতিবেদন।)
পচে যাওয়া আওয়ামী লীগ : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের জন্য নতুন করে এক ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে। জনরোষের এই ইতিহাস ১৯৭৫ সালেও একবার দেখা গিয়েছিল, যদিও সে সময় এতটা তীব্র ছিল না। দুবার অপশাসনে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দলটি অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। দলীয় প্রধান ও প্রথম সারির নেতারা বিদেশে বা আত্মগোপনে, কেউ কেউ জেলে এবং সাধারণ কর্মীরা জীবনাতঙ্কে ভুগছে। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এমন সব ভয়ংকর অভিযোগ আছে বা আসছে, তা পিলে চমকে দেওয়ার মতো। তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে জয়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কমতি নেই। দলটির অপকর্ম এত গভীরে যে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই এমন সব লোকজনও, যেমন উচ্চ আদালতের বিচারপতিগণ, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ, সামরিক গোয়েন্দার লোকজন, এমনকি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবকেও পালিয়ে যেতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে পচে যাওয়া আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বহাল রেখে দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
কেন হাসিনাকে মাইনাস করতে হবে : যে মানুষটি একসময় গণতন্ত্রের মানসকন্যা ছিলেন, ১৫ বছরের শাসনে তিনি দেশের সবচেয়ে ঘৃণার পাত্র হয়ে জীবনের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন, তার নেতৃত্বে কি একটি দল চলতে পারে? তিনি যে শুধু দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়েছেন, তা নয়; আওয়ামী লীগের ৩৩ শতাংশ নিশ্চিত যে ভোটব্যাংক ছিল, সেটাও নষ্ট করে দিয়েছেন। তার তত্ত্বাবধানে করা নির্বাচনগুলোতে ভোটারের উপস্থিতিই তার প্রমাণ। তার মানে আওয়ামী লীগের বিরাট সংখ্যক সমর্থক এখনো আছে, যারা হাসিনার ভোট কারচুপি, গুম, খুন, অর্থনৈতিক তছরুপ, বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতেন। আরও একটু নির্দিষ্ট করে বা পরিসংখ্যান দিলে হিসাবটা এ রকম : ২০২৪ সালের ভোটের দৃশ্য, গণমাধ্যমের রিপোর্ট, এমনকি আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ও ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্কদের অন্যতম একজন শ্রী রাধা দত্তের মতে, সে ডামি ভোটে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সুতরাং, আওয়ামী লীগের বাকি ২৩ শতাংশ সমর্থক শেখ হাসিনার শাসনকে সমর্থন করত না। এই ২৩ শতাংশ সমর্থককে পুঁজি করে বিকল্প নেতৃত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের জেগে ওঠার চেষ্টা করা খুবই যৌক্তিক। জনমতের বাইরে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে তার বিরুদ্ধে শত শত মামলা। মামলাগুলো রাজনৈতিক হলেও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, মানুষ গুম হয়েছে, টাকা পাচার হয়েছে, ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে, ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় হাসিনার নিজস্ব লোক বসানো হয়েছে, আইনের অপব্যবহার হয়েছে এবং যেসব লোক ব্যবহার করে এসব অপকর্ম করা হয়েছে, সেসব লোক বর্তমান ক্ষমতাসীন বা পরবর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এর মানে এই দাঁড়ায়, সেসব লোক নিজেদের বাঁচাতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে দ্বিধা করবে না। ফলে শেখ হাসিনাকে দোষী প্রমাণিত করে ফাঁসি দেওয়া কোনোভাবেই কঠিন হবে না। তৃতীয়ত, শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬ বছর। তিনি আগের মতো জৌলুশে থাকতে পারছেন না, তার আশপাশে তেমন কেউ নেই বা চাইলেও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের জন্য থাকতে পারছে না। পৃথিবীর অন্য কোথাও তার জায়গা হচ্ছে না, তার বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হতে পারেÑএসব মিলিয়ে তিনি ভুগছেন এক মানসিক যন্ত্রণায়, হয়তো এরপর আর বেশি দিন সুস্থ থেকে রাজনীতিতে সময় দিতে পারবেন না। এসব কারণে তাকে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে স্থায়ীভাবে সরে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
আওয়ামী লীগকে নিতে হবে সঠিক পদক্ষেপ : শেখ হাসিনা যতই অন্যায় করুক, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে তিনিই সব, বিশেষ করে পদ-পদবিপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে। আইন বা মিডিয়া যতই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রমাণ আনুক বা পাক, সেসবের দিকে তারা কোনো কর্ণপাত করবে না। সে বিচারে দলের মৃত্যু বা ঘুরে দাঁড়ানোটাও এককভাবে তার হাতেই ন্যস্ত। এখন তিনি যদি দলকে ভালোবাসেন, নিজে কম কথা বলবেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা অন্য কোনো দলের সমালোচনা থেকে বিরত থাকবেন, নিহতদের প্রতি সমবেদনা দেখাবেন অর্থাৎ তিনি নিজে এবং তার দল যে অনুতপ্ত, সেটা জনগণকে বোঝানোর একটা সংকেত দেবেন। তার আরও উচিত হবে কোনো কম বিতর্কিত লোককে দায়িত্ব দেওয়া, যিনি হাসিনাকে ভর্ৎসনা করে দেশ, গণতন্ত্র এবং বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আত্মসমালোচনা, ক্ষমা চাওয়া, দলীয় দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত ও দলে আর কখনো স্থান না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, দলের প্রথম সারির নেতা-নেত্রীদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো দিয়ে শুরু করবেন। কাজটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন, তাতে দলের ভাঙন, দালাল আখ্যা, এমনকি জীবননাশের হুমকিও থাকবে। ওইসব বিতর্কের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে কম বিতর্কিত শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে সভানেত্রী করে দল গোছানোর দায়িত্ব দিলে দলে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি হতে পারে। তিনিও তার মায়ের কর্মকাণ্ড থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন বা দলের প্রয়োজনে মায়ের সমালোচনা করতে পিছপা হবেন না। এককথায়, দল থেকে হাসিনা-ভূত তাড়াতে না পারলে জনগণের আস্থা পাওয়া যাবে না, আর গণআস্থা না থাকলে সে দল বেশি দিন টিকতে পারে না।
লেখক : কলামিস্ট