যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে থাকছেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। সর্বশেষ ব্রিফিংয়েও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ। সেই সঙ্গে ভিসা রেস্ট্রিকশনে কারা পড়বে, সেই ক্রাইটেরিয়া আরও খোলাসা করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশ, বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা, ভোট কারচুপিতে জড়িতরা ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বে বলে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ২৪ মে ভিসানীতি ঘোষণায় জারি করা বিষয়গুলো এক এক করে আবারও খোলাসা করেছেন তিনি। স্পষ্ট করে বলেছেন, ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতার মাধ্যমে সংগঠন করার স্বাধীনতা হরণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেওয়ায়
জড়িতদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ হবে। রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা মিডিয়াকে তাদের মতামত প্রচার থেকে বিরত রাখার দিকেও ইঙ্গিত করেন মিলার। বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সবার মুক্ত ও স্বাধীন মতপ্রকাশকে সমর্থন করে। নিন্দা জানায়, যেকোনো ধরনের মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করার ঘটনায়।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতি উৎসাহের এমন ছাপ ছিল কম্বোডিয়া নিয়েও। যেখানে একতরফা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সাহায্য কর্মসূচি স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত ও দুর্নীতির অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে নিকারাগুয়া, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের ৩৯ ব্যক্তির ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নিকারাগুয়ার ১৩ জন, গুয়াতেমালার ১০ জন, হন্ডুরাসের ১০ জন ও এল সালভাদরের ৬ জনের নাম রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা জেনেশুনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। দুর্নীতি করেছেন বা দুর্নীতির তদন্তে বাধা সৃষ্টিতে লিপ্ত ছিলেন। মার্কিন এ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় এল সালভাদরের সাবেক দুই প্রেসিডেন্টও আছেন।
কম্বোডিয়া, নিকারাগুয়া, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের এ পরিণতির মাঝে বাংলাদেশের একটি মহল টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর রেখা দেখছে। একতরফা নির্বাচন করায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং একই সঙ্গে সেখানে কিছু বিদেশি সহায়তা কর্মসূচিও স্থগিত করছে যুক্তরাষ্ট্র। শক্তিশালী প্রতিপক্ষহীন একতরফা সাধারণ নির্বাচনে দেশটির ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী জয়ের দাবি করার পর আমেরিকা এই পদক্ষেপের ঘোষণা দিল। সেই সিনড্রোম এরই মধ্যে বাংলাদেশেও। এবারও বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের ভূত ঘুরছে সরকারের একটি অংশে। কম্বোডিয়ায় সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি-সিপিপি নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ভূমিধস বিজয়ের ঘোষণা দেওয়ার পর আমেরিকা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বিগত ৩৮ বছর ধরে ৭০ বছর বয়সী হুন সেন কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় আছেন। সেখানে সদ্য নির্বাচনে ৮৪ শতাংশ ভোট কাস্টিং দেখিয়েছে পরাক্রমশালী-কর্তৃত্ববাদী হুন সরকার। মাস দুয়েক আগে ‘কাগজে ত্রুটি থাকার’ অভিযোগে ক্ষমতাসীন সিপিপির একমাত্র প্রতিপক্ষ ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করানো হয়। এর নিন্দা করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাদের উদ্বেগকেও পাত্তা না দিয়ে আওয়ামী লীগ স্টাইলে দেশাত্মবোধ ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর আক্রমণাত্মক ভাষার ব্যবহারে ভিন্ন আবহ তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। এর নেপথ্যে ছিল চীনের ওপর তার বিশেষ ভরসা।
নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একদিকে চীন ও কম্বোডিয়ার গভীর বন্ধুত্ব, সম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করার ঘোষণা; আরেকদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘটমান বর্তমান। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের একনায়ক ও কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সঙ্গে চীন-রাশিয়ার বিশেষ রাখিবন্ধন প্রকাশ্য বিষয়। চলমান স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর ক্রমেই বাংলাদেশে বিশ্বমানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব এককাট্টা। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য আগাম পদক্ষেপ নিয়েছে। কম্বোডিয়া এবং অন্য পাঁচটি দেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নির্বাচনের পর। বাংলাদেশে নির্বাচনের আগেই স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বাংলাদেশে ফের একতরফা নির্বাচনের আগেই আরও কোনো পদক্ষেপ নেবে না কম্বোডিয়ার মতো নির্বাচনের পর পর্যন্ত অপেক্ষা করবেÑএ নিয়ে বিশ্লেষণের ধুম পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। গণতান্ত্রিক ধারায় সবকিছুর ফয়সালার চর্চা করেছে তারা।
বিপদ-আপদে আওয়ামী লীগের পরম বন্ধু ভারতের মতিগতিতে এবার বেশ ধোঁয়াশা। তার ওপর দেশটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক একাধিক কর্নারে বিএনপির এক্সক্লুসিভ যোগাযোগ সরকারকে বেশ ভাবাচ্ছে। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েতের বন্ধু ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছে। পঁচাত্তরের পর স্নায়ুযুদ্ধসহ নানা কারণে ২১ বছর ক্ষমতার মুখ দেখেনি আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। ভারত তখন তার বন্ধু রাশিয়াকে ফেলে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিতালি গড়ে। স্নায়ুযুদ্ধবিহীন ৩০ বছর (১৯৯২-২০২২) আওয়ামী লীগের দাপট ছিল দেখার মতো। অবিরাম নাস্তানাবুদ করেছে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে। স্নায়ুযুদ্ধবিহীন সময়ে ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যা চেয়েছে তা-ই করেছে। এখন নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এককাট্টা হয়ে গেছে। জাতিসংঘও একই ধাঁচে। ভারত এখনো রহস্যঘেরায়। নিজের ঘর সামলানোতে ব্যস্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নতুন করে যোগ হয়েছে মণিপুর কাণ্ড। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ মানুষের মৃত্যু এবং ৫০ হাজারের বেশি গৃহহীন মণিপুরে। ঠিক এ সময়েই বিএনপি এবং ভারতকে প্যাঁচিয়ে বোমা ফাটিয়েছেন শেখ হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিএনপি ভারত থেকে অস্ত্র সাপ্লাই আনছে বলে অভিযোগ ছুড়েছেন তিনি। মেঠো বক্তৃতা হলেও এ সময়ে তার এমন বক্তব্য রাজনীতিতে নতুন সন্দেহ ও জিজ্ঞাসা তৈরি করেছে।