যথাসময়-যৌক্তিক সময়ের যন্ত্রণায় ভুগছে বিএনপি। দেখছে ধারণার বাইরের কিছু যন্ত্রণা। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন, নির্বাচন হবে কবে এ দুই প্রশ্নের জবাব না পাওয়া দলটির জন্য বিরক্তির, শঙ্কারও। ইউনূস সরকারকে সময় দেওয়ার ব্যাপারে অনাপত্তি দিয়ে রেখেছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীও একমত। কিন্তু এই একমতের মধ্যেও বেশ রকমফের। বিএনপি চায় যথাসময়-যৌক্তিক সময়ের ব্যাখ্যা। সেই দৃষ্টে রোডম্যাপ। আর জামায়াত নির্বাচনের জন্য উতলা নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকারকে যত ইচ্ছা সময় দিতে চায় তারা। মোটকথা জামায়াত নির্বাচনের জন্য আরও সময় চায়। দলটির এ ভূমিকার মাঝে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে বিএনপি।
এমনিতেই শেখ হাসিনার ভারতে অবসরে বা নির্লিপ্ত না থাকা বিএনপির জন্য একটি বড় ধরনের অশনিসংকেত। তার গতিবিধির খবর বিএনপি জানে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা বিএনপির কয়েক নেতাকর্মীর কাজকর্মকে ভালো চোখে দেখছে না। তারা বরং সন্তুষ্ট জামায়াত নেতৃত্বের আচরণে। যে কারণে সংস্কার কার্যক্রম প্রলম্বিত হওয়ার মাঝে বিএনপির ভয় আছে। ক্ষমতার প্রধান দাবিদার হিসেবে বিএনপির ছোট ভুলও বড় করে সামনে আনার পেছনে জামায়াত এবং সমন্বয়কদের কয়েকজনের সম্পৃক্ততা আঁচ করছে বিএনপি। সময় যত গড়াবে, তা সাধারণ ভোটারদের মনোজগৎকে প্রভাবিত করতে পারে। এর বিপরীতে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত শান্তি, সৌহার্দ্য ও সহিষ্ণুতার বার্তা দিচ্ছে। তা এরই মধ্যে জামায়াতকে বিএনপির প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। এ আবহটি বিএনপির অনেকের সাজানো সংসার উলটপালট করে দেওয়ার নমুনা। রাজনৈতিক সহযাত্রী জামায়াতের নব-উত্থান তাদের মধ্যে একটি স্নায়ুচাপ তৈরি করেছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব বেশি বেশি দাবি করতে গিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের কেউ কেউ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কোণঠাসা করে ফেলছেন। তারা মানতেই পারছেন না, ৫ আগস্টের পর নতুন বাংলাদেশে অন্য অনেকের মতো বিএনপিও কিছু সুবিধা এরই মধ্যে পেয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিধিনিষেধের শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছেন। বেশ কিছু মামলা বাতিল হয়েছে। কারাবন্দী নেতারা মুক্তি পেয়েছেন। জুলাই-আগস্টের নিপীড়নমূলক মামলাগুলো বাতিল হয়েছে। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। মিডিয়ায় প্রাপ্য প্রচার-সুবিধা পাচ্ছেন। বুকভরে শ্বাস নিতে পারছেন দলের নির্যাতিত নেতাকর্মীরা। বাসাবাড়িতে ঘুমাতে পারছেন। মামলার জালে আটকে তছনছ হয়ে যাওয়া লাখো জাতীয়তাবাদী পরিবারে স্বস্তির সুবাতাস বইছে। সাজা ও মামলার খড়গ থেকে বের করে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছে দলটি। সামনের প্রাপ্তিও তারা বেশ দ্রুত চায়। এসব করে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, জাতীয় নির্বাচন, পতিত হাসিনা সরকারের নিপীড়নমূলক মামলা ও সাজার নিষ্পত্তি, রাজনৈতিক সংস্কারের ধরনসহ বহু ইস্যুতে বিএনপি কিছু চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে। সম্ভাব্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিজেদের অবস্থান নিয়েও দোলাচলে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্র থেকে ব্যাপক কড়াকড়ি, শাস্তির পরও বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কিছু কুকর্মও বেশ সমালোচিত হচ্ছে। পাড়া-মহল্লা দখলদারির কিছু ঘটনা লন্ডনে তারেক রহমানের কানেও পৌঁছেছে। চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত এস আলমের গাড়ি সরিয়ে ফেলা এবং ওই গাড়ি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিনের ব্যবহারের ঘটনা টক অব দ্য কান্ট্রিতে রূপ নিয়েছে। সালাহউদ্দিন এ জন্য সংবাদ সম্মেলন ডেকে ক্ষমা চেয়েছেন। গত জুনে নারায়ণগঞ্জে একটা হত্যাকাণ্ডকে আগস্টের ঘটনা বানিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাকশিল্প গ্রুপ ফকির গ্রুপের শীর্ষ তিন কর্মকর্তাকে আসামি করেছেন বিএনপির স্থানীয় কয়েক নেতা। অভিযোগ আছে, আগে তাদের কাছে চাঁদা চেয়ে কাক্সিক্ষত টাকা না পেয়ে এই মামলা দেওয়া হয়েছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব চাঁদাবাজি-দখল-সহিংসতার বিরুদ্ধে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিলেও খুব একটা আমলে নিচ্ছে না বহু কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক নেতাকমী। দলীয় রাজনীতির বাইরে সাংবিধানিক কিছু বিষয়ও যোগ হয়েছে। অজ্ঞাত জায়গা থেকে ২ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা গ্রহণ করে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে।
এর মাঝে অনেক মানে বা হেতু দেখছেন সচেতনরা। তার ওপর সপ্তাহখানেক আগে সংবিধান আংশিক বা পুরোপুরি স্থগিত রাখার কথা বলেছেন। ‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে’ উল্লেখ করে জানিয়েছে, আলোচনার জন্যও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করেছেন সিইসি। রাষ্ট্রপতি বা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেননি। গণমাধ্যমেই ভরসা খুঁজেছেন। লেখায় ভালোমন্দ মিলিয়ে তার বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বিতাড়নে তার কষ্টের কথাও জানা হয়েছে পাঠকদের। তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আগাম বৈধতা নেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগকেই বিদায় করা হয়েছে। আপিল বিভাগের বিদায় যে স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখায় উচ্চ আদালতের বিতর্কিত ভূমিকা এবং নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণে ঘটেছে, তা উপেক্ষা করেছেন। আবার গণঅভ্যুত্থান কার্যকর করতে ‘আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না’, এ কথাও লিখেছেন। লেখায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি একধরনের শ্লেষ রয়েছে। এর বিপরীতে কেবল সংবিধান সংশোধন নয়, পুনর্লিখনের তাগিদ আসছে ভিন্ন মহল থেকে। যোগফলে সামনে সম্ভাব্য আরেকটি বিশৃঙ্খল অবস্থার কানাঘুষা চলছে।