Thikana News
১৮ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪


 

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের পতন

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের পতন


লরেটা অ্যান রোজালেস ফিলিপাইনের একজন ইতিহাসের শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ফার্দিনান্দ মার্কোসের শাসনের বিরোধিতা করায় মিজ রোজালেসকে দুবার গ্রেপ্তার করা হয়। এটা সবার জানা, মার্কোসের শাসনামলে ফিলিপাইনের বহু বিরোধী মতের মানুষকে হত্যা, গুম, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মিজ রোজালেস সেসব নির্যাতিত মানুষের একজন। গ্রেপ্তারের পর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। তার শরীরে গরম মোম ঢালা, মুখে বেল্ট বেঁধে শ্বাসরোধ করা এবং হাতে-পায়ে তার জড়িয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। যে কারণে তিনি একাধিকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এত সব নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি নিজেকে এই ভেবে ভাগ্যবান মনে করেন, তাকে মেরে ফেলা হয়নি, যেটা অনেকের ক্ষেত্রে হয়েছিল। মুক্তির পর তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, তাকে যে ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, সে ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন যেন আর কাউকে সহ্য করতে না হয়।
তথ্যমতে, মার্কোস আমলে ফিলিপাইনে কমবেশি ১১ হাজার মানুষ মিজ রোজালেসের মতো নির্যাতনের শিকার হন। হত্যা, গুমের শিকার হন দুই হাজারের বেশি মানুষ।
১৯৮৬ সালে সেনাসমর্থিত এক গণবিপ্লবে মার্কোস শাসনের অবসান ঘটে। তেমনটি বাংলাদেশে ঘটেছে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা শাসনের ক্ষেত্রে। গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ের ওপর বসে থাকা হাসিনা নামের এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লাখ লাখ মানুষের আত্মাহুতির মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মার্কোসের প্রেতাত্মার আবির্ভাব হবে-সেটা কেউ আশা করেনি। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে হাসিনা গং নিজেদের ক্ষমতায় যেকোনো প্রকারে টিকে থাকার জন্য ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। কিন্তু তার শাসনজুড়ে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অনেকটা সে রকম ঘটনাই ঘটেছে। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনের জন্য সরকারি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিজ দলের গুন্ডাদের দিয়ে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হতাহত করেছে। নিহতের সংখ্যা সরকারিভাবে ১৫০ বলা হলেও সংখ্যা ৪০০-এর কম নয় বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়। আন্দোলন দমনের জন্য সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামানো হয়। কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। হেলিকপ্টার থেকে ছাত্রদের ওপর গোলা ও গরম পানি বর্ষণের অভিযোগ করা হয়। প্রাণরক্ষার্থে ছাত্র-জনতার কেউ কেউ দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলে ধাওয়া করে তাদের কাউকে কাউকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বহু এলাকা ঘেরাও দিয়ে রাতের বেলায় নিজ নিজ বাসা থেকে বহু ছাত্রকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সৃষ্টি করা হয় এক অবিশ্বাস্য রকমের ভয়-ভীতির পরিবেশ, যা একাত্তরের দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জন্ম হলেও এই আন্দোলন কিন্তু গণবিপ্লবে পরিণত হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের মানুষের মনে দীর্ঘদিনের জমে ওঠা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কাজ করেছে। গত দেড় দশকের অধিক সময় ধরে জনগণের অংশগ্রহণবিহীন চারটি প্রশ্নবিদ্ধ ছলচাতুরীর নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা গং ক্ষমতায় জেঁকে বসে।
ক্ষমতাবান হয়ে শেখ হাসিনা তার পথের কাঁটা বিরোধী দলগুলোকে ধংসের খেলায় মেতে ওঠেন। বাক, মতামত ও সমাবেশের সকল স্বাধীনতাকে টুঁটি চেপে ধরে নানা অজুহাতে সার্বক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হতে থাকে বিরোধী নেতাকর্মীদের। আন্দোলনকারী বহু নেতাকর্মীকে বাসা থেকে গভীর রাতে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে Mfxi iv‡Z †PvL †eu‡a Zz‡j wb‡q Joint Interrogation cell  (তথাকথিত আয়নাঘর)-এ তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। দুই পা বেঁধে উপরে তুলে ঝুলিয়ে তাদেরকে বেধড়ক পেটানো, লাথি মারাসহ বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়।
সাম্প্রতিককালে গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর এবং কোটা আন্দোলনের নাহিদসহ আরও কয়েকজন নেতার ওপর চালিত নির্যাতনের বীভৎস চিত্র দেখে মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। এর আগে গত দেড় দশক ধরে অসংখ্য বিরোধী নেতাকর্মী বিচার-বহির্ভূত হত্যা, গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন ভুয়া মামলায় হাজার হাজার মানুষকে জেলে পাঠানো হয়েছে। গত ১৭ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জন ছাত্র গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিপুল momentum সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে যেভাবে হত্যা করা হয়, তার ভিডিওচিত্র মিডিয়ায় প্রচারিত হলে তা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়।
আন্দোলনকালে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে মাঠে নামা নানা পেশার মানুষ ও নারী শিক্ষার্থীরাও পুলিশের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। যার ফলে আন্দোলন Point of No Return-এর পর্যায়ে চলে যায়। লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংকট মানুষকে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ করে তোলে। তা ছাড়া হাসিনাসহ সরকারি দলের একাধিক নেতার উসকানিমূলক বক্তব্য আন্দোলনে ঘি ঢালতে সহায়ক হয়। বারবার আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে রাজাকার ও রাজাকারের বংশধর এবং তাদেরকে দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট-মর্মে প্রদত্ত বক্তব্য আন্দোলনকে বেগবান করতে বিপুলভাবে সহায়তা করে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সে সরকারের মধ্যে অহংকার, দাম্ভিকতা ও স্বৈরাচারী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। চচেস্কু, হোসনি মোবারক, এরশাদ প্রমুখ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হাসিনা সরকারের মধ্যেও সে ধরনের মনোভাব সৃষ্টি হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তার মুখ থেকে শুনেছি, ১৯৮৯-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয় এবং বিক্ষোভকারীদের প্রতি গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে সে সময় পুলিশ কমিশনার ছিলেন রকিব উদ্দিন আহমদ। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে absorbed হন। বিক্ষোভকারীদের প্রতি গুলি ছুড়েও বিক্ষোভ দমানো যাচ্ছিল না। এরশাদ ক্ষুব্ধ হয়ে কমিশনার রকিবকে ফোন করে জনতার প্রতি গুলির পরামর্শ দেন। গুলি করে আমি কতজনকে মারব আর এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব হবে না বলে রকিব ফোন ছেড়ে দেন। এরশাদের পতন নিশ্চিত হয়ে যায়। হাসিনাও গুলি করে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। কিন্তু সেনাপ্রধান ও অন্যরা তাতে কর্ণপাত না করায় তাকে পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপে দেশে শান্তি ফিরে আসুক এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে, এই কামনাই করি।
লেখক : কলামিস্ট
 

কমেন্ট বক্স