কোটা সংস্কার আন্দোলনে বড় ধাক্কা খেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ পর্যন্ত দেশব্যাপী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ১৮৭ জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো ছাত্র আন্দোলনে এটাই সবচেয়ে বড় মৃত্যুর মিছিল। এত বড় ধাক্কা খেয়েও এখনো ক্ষমতার মসনদে সগৌরবে টিকে আছে শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটাও নজিরবিহীন ঘটনা। ক্ষমতা হারানোর সব রকম আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে কঠিন শাসনের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে গত ২২ এপ্রিল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান পরিস্থিতি ‘আরও শক্ত অ্যাকশন’ নিয়ে দমন করার কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে তাঁর কঠোর মনোভাবের ঘোষণা দিলেন, যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা সরকারকে চারদফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। অন্যথায় তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে কী কী বিষয় থাকতে পারে তা জানা যায়নি।
চলমান সহিংসতায় প্রধানমন্ত্রী এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে নিহতদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই ব্যবসায়ীদের এক সভায় তিনি সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা ও জনগণের জানমাল রক্ষায় ‘কঠোর’ শাসনের ইঙ্গিত দিয়েছেন স্পষ্টভাবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। গত ২১ জুলাই রোববার অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও অধিকতর সক্রিয় থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
চলমান সহিংসতায় জড়িতদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এই নির্দেশের পরই সারা দেশে পুলিশ ও র্যাবের চিরুনি অভিযান শুরু হয়েছে। গত ছয় দিনে কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা না হলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলছে, এই সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দেশে সহিংসতা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিদ্যমান সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে সরকার। এর আগে ২০১১ ও ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করেছিল বর্তমান সরকার। আগামী সংসদে আবারো আইনটি সংশোধন করা হতে পারে। সংশোধনীতে সরকারি স্থাপনায় হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হতে পারে।
চলমান সহিংসতার সরকারের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনসহ সরকারি স্থাপনা ধ্বংসের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর এ কারণে ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী যে কোনো কর্মসূচিতে উদারতা দেখাবে না সরকার। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। সূত্রটি বলছে, গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে জ্বালাও পোড়াও বা জানমালের ক্ষতিসাধনের কোনো সুযোগ নেই। জানমাল রক্ষায় সরকার ভবিষ্যতে অধিকতর কঠিন হবে। সরকারবিরোধী সভা-সমাবেশের অধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো অভিযোগ আমলে নেবে না সরকার। বরং সহিংসতায় জড়িত বিএনপি-জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে যে কোনো অ্যাকশনকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান হিসাবে তুলে ধরবেন বিশ্ব দরবারে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
এদিকে চলমান সহিংসতা দমনে সারা দেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন। এমনকী দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা, সারা দেশে সিনিয়র নেতা, এমনকী প্রবাসের অনেক নেতা চুপটি মেরে ছিলেন। লাখ লাখ কর্মী ও সমর্থক থাকার পরও দলের এই ব্যর্থতার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষুব্ধ করেছে। তিনি বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছেন ছাত্রলীগের ভূমিকায়। ছাত্রলীগে ঘাপটি মেরে থাকা শিবির কর্মীরা সময়মত দূরে সরে গেছে বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন, বিশেষ করে ছাত্রলীগে অধিকতর শুদ্ধি অভিযান চালানোর আভাস দিয়েছেন দলীয় প্রধান।
চলমান সহিংসতার শুরুতে শরীক দল নিয়ে গঠিত ১৪ দলের সঙ্গে বেঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তাদের কাছ থেকেও সহযোগিতা বা গঠনমূলক কোনো পরামর্শ পাননি তিনি। প্রশাসনের একচ্ছত্র সহায়তায় সহিংসতা পরিস্থিতি তিনি একাই সামাল দিতে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন। এমন আত্মনির্ভরশীল হয়েই তিনি ১৪ দলের সঙ্গে পরবর্তী বৈঠক বাতিল করেছেন বলে একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক : এদিকে গত ২২ এপ্রিল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বক্তৃতায় শেখ হাসিনার মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিন তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। অনেকটা শান্ত করে নিয়ে আসতে পেরেছি। অবস্থা আস্তে আস্তে আরও ভালো হবে। যতটুকু ভালো হবে কারফিউও শিথিল হয়ে যাবে।’
অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই নেতৃবৃন্দসহ দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষায় বলেন, ‘এবার অতো সহজে ছাড়া হবে না। ধ্বংসযঞ্জে চালিয়ে দেশকে ধ্বংস করবে? আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই যাতে দেশের ভাবমূর্তি ঠিক থাকে। ভাবমূর্তি ঠিক না থাকলে ব্যবসা লাটে উঠবে।’
সারাদেশে সহিংসতার জন্য বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরকে দায়ী করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিবির তো জঙ্গি। শিবির জামাত জঙ্গি। বিএনপির চেহারা বেরিয়ে গেছে। এই জঙ্গিদের দমন করা ও ভালো পরিবেশ তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে প্ল্যান করেই তারা (যারা সহিংসতা করেছে) ঢাকায় এসেছে। জেলায় জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে শিবির কর্মীরা ঢাকায় এসেছে।’
কোটা নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত ও সরকার পক্ষে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কি শুধু কোটা আন্দোলনের জন্য? ছাত্ররা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই তো রায় দিয়েছে আদালত। এরপরও আন্দোলন বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য কী?
কারফিউ ও সেনা মোতায়েনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি একটা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে। শেষ পদক্ষেপ হিসেবে আর্মি নামিয়েছি এবং কারফিউ দিয়েছি। জামাত- বিএনপি-শিবির যে কয়টা ঘটনা, যত খুন খারাবি, তারা এক সাথে করেছে।’
তিনি তার নামে ‘দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বা দেশ ছাড়ার’ যে গুজব ছড়ানো হয়েছে, তা উল্লেখ করে বলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না। পচাত্তর সালের পর ছয় বছর আসতে পারিনি। কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছি, ফিরে এসেছি। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও আমাকে আসতে দিবে না। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমি দেশে ফিরবো।’
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সারা দেশে নিম্নবিত্ত, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ২৩ জুলাই মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকাসহ ৪ জেলায় চলমান কারফিউ বলবৎ : চলমান পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ঢাকাসহ ৪ জেলায় চলমান কারফিউ বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বাকি জেলাগুলোয় কারফিউ এর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে জেলা প্রশাসন। ২৩ জুলাই মঙ্গলবার বিকেলে এ কথা জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২৪ জুলাই বুধ ও ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে কারফিউ চলবে। তবে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। এছাড়াও বাকি জেলাগুলোর কারফিউ এর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে জেলা প্রশাসন।